পশ্চিম আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয় মূলত দুর্বল রাষ্ট্র ও দুর্বল নাগরিক সমাজের কারণে। গণতন্ত্র এমন একটি আদর্শ, যা অধিকাংশই প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আফ্রিকায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে আফ্রিকায় আরেকটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। লিখেছেন অ্যান্ড্রু এম মিউয়েন্ডা।
পশ্চিম আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয় মূলত দুর্বল রাষ্ট্র ও দুর্বল নাগরিক সমাজের কারণে। গণতন্ত্র এমন একটি আদর্শ, যা অধিকাংশই প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আফ্রিকায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে আফ্রিকায় আরেকটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এবার গ্যাবনে। এ দেশে এর আগে কখনো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেনি। দেশটি ৫৬ বছর ধরে একটি পারিবারিক রাজবংশের অধীনে রয়েছে। বুরকিনা ফাসো, গিনি, সুদান, মালি, জিম্বাবুয়ে ইত্যাদির পর নাইজার, এখন আবার গ্যাবনে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং এরপর আর কোনো দেশে যে অভ্যুত্থান ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদ নিয়ে বাসি তর্ক বাদ দিয়ে আফ্রিকার রাজনীতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবা উচিত। উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতা, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির বৈধতা—যার মাধ্যমে নতুন নেতার উত্থান ঘটে—তার ওপর ভিত্তি করে আফ্রিকার রাজনীতির চিন্তা-ভাবনা ঢেলে সাজাতে হবে। আগে মনে করা হতো ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা স্বৈরাচারী নেতাদের দ্বারা অভ্যুত্থান হয়ে থাকে। কিন্তু মালি, গিনি, নাইজার ও বুরকিনা ফাসোতে যে সরকারগুলো উৎখাত করা হয়েছে, সেগুলো ছিল গণতান্ত্রিক, যেখানে একটি বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করেছিল।পশ্চিম আফ্রিকার শুল্ক ইউনিয়ন ও ইকোয়াস (ECOWAS) নাইজারে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে এবং দাবি করছে যে সেখানে সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটা সরকারকে উত্খাত করেছে। এখন গ্যাবনের সৈন্যরা দাবি করছে যে তারা গণতন্ত্র রক্ষায় হস্তক্ষেপ করেছে। কারণ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। এখানে ইকোয়াসের অবস্থান কী হবে? এবং যদি পশ্চিম আফ্রিকায় অভ্যুত্থান চলতে থাকে, তাহলে কি ইকোয়াস গণতান্ত্রিক সরকার পুনরুদ্ধার করতে সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করবে, যারা সামরিক উত্থান থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অক্ষম?
অবশ্যই ইকোয়াস বেশ কিছু পরাশক্তি, বিশেষ করে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় কাজ করছে, যারা ঐ সব দেশের ইউরেনিয়ামের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ খোঁজে। পশ্চিম আফ্রিকার এই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কেউ কেউ বিদেশি আধিপত্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। তারা সফল হতে পারবে কি না, সেটা অন্য বিষয়।গণতান্ত্রিক জিহাদিস্ট জেফরি স্মিথ আশঙ্কা করছেন যে আফ্রিকায় স্বৈরাচারী শাসকদের উত্থান ঘটছে। স্পষ্টত তার কাজ হলো আফ্রিকানদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করা। স্মিথ একজন প্রকৃত আদর্শবাদী হতে পারেন, কিন্তু এখানে তার অন্য উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। গণতন্ত্র প্রচারের নামে তিনি পশ্চিমা শক্তি ও তাদের করপোরেশনগুলোকে আফ্রিকান দেশ এবং তাদের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জনে সহায়তা করছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে খ্রিষ্টান মিশনারিরা আফ্রিকানদের পরিত্রাণের জন্য এসেছিলেন বলে দাবি করত। এটা শুধু তাদের স্বদেশি সরকারকে আফ্রিকানদের ওপর আদর্শিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল, যা সবশেষে ঔপনিবেশিকতার জন্ম দেয়। গণতন্ত্র খ্রিষ্টধর্মকে মতাদর্শগত অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এটাকে পশ্চিমারা তাদের সাম্রাজ্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছে।নতুন ঔপনিবেশিকতা কাজ করার জন্য একটি খ্রিষ্টীয় সমাচারসংক্রান্ত যাজকত্ব প্রয়োজন। এই যাজকত্ব কার্যকর করার জন্য এর আদর্শগুলো একদম খাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে স্মিথের মতো লোকদের এখানে অন্য উদ্দেশ্য আছে। যদি তারা তাদের দেশের সরকার ও করপোরেশনগুলোর অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সুস্পষ্ট এজেন্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে তারা স্থানীয় মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। ডা. ডেভিড লিভিংস্টোন আফ্রিকা জুড়ে তার অন্যান্য সতীর্থের মতোই শয়তান থেকে আফ্রিকান মানুষের আত্মার ‘মুক্তি’র জন্য সত্যিকারের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্মগুরু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আফ্রিকানদের ওপর আদর্শিক আধিপত্য অর্জনের জন্য ইউরোপীয়দের প্রয়োজন আফ্রিকানদের আত্মা জয় করা। এর একটা মাধ্যম হলো আফ্রিকানদের ধর্মকে শয়তানি হিসেবে প্রচার করা, বর্তমানে যেমন আমাদের নেতাদের দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী এবং আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘স্বৈরাচারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে।আফ্রিকার অনেক নেতা ও সরকার অযোগ্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। পশ্চিমারা এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলো কাজে লাগাতে চায়, আফ্রিকানদের মুক্ত করতে নয়, তাদের হস্তক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য, যেমনটা লিবিয়ায় করেছিল, যা পরবর্তীকালে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে নিয়ে এসেছিল। অনেক আফ্রিকান অভিজাত শ্রেণি এই ভ্লামি বুঝতে পারে না। নিজেদের মুক্ত করার জন্য নিজেদেরই যে চেষ্টা করতে হবে, এই প্রয়োজনীয়তাকে অনেকেই উপলব্ধি করতে পারে না। কোনো বহিরাগত শক্তি আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন বা ইতালিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেনি। তার পরও সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে কেন শ্বেতাঙ্গ গণতন্ত্রের প্রচারকেরা মনে করে যে আফ্রিকার গণতন্ত্রীকরণের জন্য পশ্চিমা বহিরাগত পরাশক্তির সাহায্য প্রয়োজন?
একটি সর্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্রকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিমে খ্রিষ্টীয় যাজকের উত্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে শুরু হয়েছিল। এটি মূলত সম্ভব হয়েছিল ইউরোপে আন্তঃযুদ্ধের সময়ে কমিউনিজম, নািসবাদ ও ফ্যাসিবাদের অধীনে শক্তিশালী ও সর্বগ্রাসী শাসকের মাধ্যমে। এখানে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে শক্তিশালী রাষ্ট্র দ্বারা কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পশ্চিমে গণতন্ত্রের প্রচারকদের আবির্ভাব ঘটে।কিন্তু আফ্রিকায় এই প্রেক্ষাপট উলটো। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর চাওয়া অনুযায়ী ব্যক্তিস্বাধীনতা রুদ্ধ করা নয়, বরং দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে ব্যক্তিজীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে সীমাবদ্ধ করা নয়, বরং দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর সক্ষমতা তৈরি করা, যাতে তারা একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারে। গণতন্ত্রের প্রসারকে তার মিশনারি কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য বানিয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের নিজস্ব পরিস্থিতি চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা বেশির ভাগ সময়ই নেতিবাচক ফল বয়ে আনে।পশ্চিম আফ্রিকায় সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয় মূলত দুর্বল রাষ্ট্র ও দুর্বল নাগরিক সমাজের কারণে। গণতন্ত্র এমন একটি আদর্শ, যা অধিকাংশই প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য আফ্রিকায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। আফ্রিকান দেশগুলোতে কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম সবচেয়ে সংগঠিত দল হলো সেনাবাহিনী। আফ্রিকার সৈন্যরা আফ্রিকান সমাজেই বেড়ে ওঠে। তারা অন্যান্য আফ্রিকানের ছেলে, স্বামী, ভাই ও প্রতিবেশী। তারা অন্যান্য নাগরিকের মতো একই সমস্যায় ভোগে। তাই তারা প্রায়ই অন্যান্য আফ্রিকান নাগরিকের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে।বুদ্ধিগতভাবে সাধারণ মানুষ সরকারগুলোকে গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী হিসেবে দেখে। কিন্তু এটা একটি পাশ্চাত্য ধারণা। আফ্রিকার সরকারগুলো মূলত প্রথাগত ব্যবস্থার ওপর চলে। তাদের চরিত্র, অভ্যাস ও আচরণ আফ্রিকান মানুষের সামাজিক চেতনায় খচিত বিবর্তিত নিয়ম, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অকার্যকর কর্মকাণ্ডের দোহাই দিয়ে অশিকাংশ সময় পশ্চিমারা আফ্রিকান দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।গণতন্ত্র সব সময় আফ্রিকান সমস্যার সমাধান হতে পারে না। নির্বাচন সব সময় রাষ্ট্র ও তার রাজনৈতিক নেতাদের বৈধতা প্রদান করে না। গণতন্ত্র মাঝে মাঝে সামাজিক বিভাজন তীব্র ও রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে। রুয়ান্ডায় গণহত্যার উদ্ভব হয়েছিল দেশটিকে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উন্মুক্ত করার প্রচেষ্টা থেকে। সামরিক ব্যক্তিরা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিচারক হিসেবে কাজ করতে পারেন, যদিও তাদের হস্তক্ষেপ সমস্যার সমাধান না করে, উলটো রাষ্ট্রের সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে। অভ্যুত্থান শুধু গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদের জন্য নয়, রাষ্ট্রের বৈধতার বিবাদের কারণেও ঘটতে পারে।
সৌ: ইত্তে:
[উগান্ডা থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট’ ইংরেজি দৈনিক থেকে অনূদিত]
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct