প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রায় দুই দশক ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যে শক্তিকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, গত ২৩ জুন তাতে প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খায়। রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বাধীন ভাগনার গ্রুপ সেদিন অভ্যুত্থান ঘোষণা করে বসে। অথচ এই ভাড়াটে সেনাদল ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। অভ্যুত্থানে যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ধরা দেয়, তা হলো রাশিয়ার রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্গত ও গভীর দুর্বলতা। লিখেছেন গুলনাজ শারাফুতদিনোভা।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রায় দুই দশক ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যে শক্তিকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, গত ২৩ জুন তাতে প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খায়। রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের নেতৃত্বাধীন ভাগনার গ্রুপ সেদিন অভ্যুত্থান ঘোষণা করে বসে। অথচ এই ভাড়াটে সেনাদল ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। অভ্যুত্থানে যে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ধরা দেয়, তা হলো রাশিয়ার রাজনৈতিক কাঠামোর অন্তর্গত ও গভীর দুর্বলতা।পুতিনের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে তাঁর আস্থাভাজন অনানুষ্ঠানিক শক্তিগুলো শাসনব্যবস্থার মূল কাঠামোয় অনুপ্রবেশ করে। অনানুষ্ঠানিক এই শক্তি ক্রেমলিনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জন্ম নিয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে। প্রিগোশিনের ক্ষেত্রে আমরা তা-ই দেখেছি। তিনি বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন নানা ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সেনা সংস্থা ভাগনার। ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযান শুরুর আগপর্যন্ত রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অভিযানে প্রিগোশিনের মতো শক্তির ভূমিকাকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যুদ্ধের কারণে যে চাহিদা ও চাপ তৈরি হয়, সেই প্রেক্ষাপটে প্রিগোশিনরা প্রকাশ্যে চলে আসেন এবং তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা জানান। ২০২২ সালে প্রিগোশিন শেষ পর্যন্ত ভাগনার বাহিনীর কথা ঘোষণা করেন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি ঝাঁ-চকচকে ভবনে এর সদর দপ্তর খুলে বসেন। তিনি নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজির হতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি এমন সংকেতও দেন যে তিনি রক্ষণশীলদের নিয়ে একটি আন্দোলন গড়ে তুলবেন, একটা রাজনৈতিক দলও গঠন করতে পারেন। সম্ভবত তিনি চাইছিলেন দক্ষিণপন্থী, জনতুষ্টিবাদী নেতা ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কির মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে। একটি ধারণা হলো, ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক হার হতে থাকলে ভাগনারসহ অনিয়মিত বাহিনীগুলোর উত্থান ঘটে। চেচেন নেতা রামজান কাদিরভকেও যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। পূর্ব ইউরোপের শহর বাখমুতের যুদ্ধে ভাগনাররা নিজেদের একমাত্র বিজয়ী সৈন্যের বাহিনী হিসেবে ঘোষণা দেয়।
এই সাফল্য প্রিগোশিনকে যুদ্ধে প্রভাব রাখতে সহায়তা করে এবং একপর্যায়ে যে প্রতিষ্ঠান তাদের এই দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিল, সেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রিগোশিন নিয়মিত যে ভাষণ নিয়ে ভিডিওতে হাজির হতেন, তাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর ভাষণে তিনি রাশিয়ার সেনানায়কদের তুলাধোনা করতেন। তাঁর হাত থেকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভও বাদ যাননি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত ভাগনারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এখন পর্যন্ত আপাতদৃষ্টে মনে হয়, পুতিন ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে ভাগনার বিদ্রোহের মতো অতর্কিত ঘটনা ঘটতে পারে, সেই বিষয়ে পুতিন এখন অনেকটাই সতর্ক। তবে দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনিশ্চিত অবস্থা প্রকাশ হয়ে গেছে প্রিগোশিনের কর্মকাণ্ডে। এই অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতেও জারি থাকবে। প্রিগোশিনের হঠাৎ মৃত্যুর মানে হচ্ছে, কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করতে পারে, এমন এক ব্যক্তির প্রস্থান। কীভাবে যুদ্ধ এগোচ্ছে কিংবা দুর্নীতি ও নিষ্ক্রিয়তার তথ্য রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করে প্রিগোশিন রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে হয়তো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি না বললে হয়তো পুতিন বা সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতেন না। সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা থেকে যুদ্ধের প্রভাবশালী প্রচারক বনে যাওয়া ইগোর গারকিনের গ্রেপ্তার, সেনা নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলায় জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে অপসারণ প্রমাণ করে যে ক্রেমলিন প্রভাবশালী কোনো সমালোচককেই সহ্য করতে পারছে না। যুদ্ধ নিয়ে যেকোনো ভাষ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে কঠোর অবস্থানে থাকা ব্যক্তি বা প্রিগোশিনের প্রতি সহানুভূতিশীল অংশকে পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হবে আবারও। যাঁরা এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করছেন কিংবা রাশিয়ার যুদ্ধরত সেনাদের রসদ সরবরাহের কাজে আছেন, তাঁদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। দেশের ভেতর যাঁরা যুদ্ধ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের হতাশা, মতদ্বৈধতা সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা কী, তা এখনো তাঁরা প্রকাশ করেননি। প্রিগোশিন বিপুল সম্পদ রেখে গেছেন। সেগুলো এখন ভাগ-বাঁটোয়ারার সময়। এর কিছুটা যাবে রাষ্ট্রের কাছে, কিছু অংশ বেসরকারি লোকজনের হাতে। কিন্তু যাঁরা প্রিগোশিনের উত্তরাধিকার, তাঁদের মধ্যে তাঁর মতো (প্রিগোশিন) দক্ষতা অথবা অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্বগুণ না-ও দেখা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত আপাতদৃষ্টে মনে হয়, পুতিন ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে ভাগনার বিদ্রোহের মতো অতর্কিত ঘটনা ঘটতে পারে, সেই বিষয়ে পুতিন এখন অনেকটাই সতর্ক। তবে দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনিশ্চিত অবস্থা প্রকাশ হয়ে গেছে প্রিগোশিনের কর্মকাণ্ডে। এই অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতেও জারি থাকবে।
সৌ: প্র: আ:
আল–জাজিরা থেকে
গুলনাজ শারাফুতদিনোভা লন্ডনের কিংস কলেজে রাশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct