আপনজন ডেস্ক: শাশুড়ি এবং বৌমার মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা টক ও মিষ্টি। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই ধারা। তবে সর্বক্ষেত্রে এক নয়। যদিও এই সম্পর্কটি বড় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার। কিন্তু কোথায় যেন গিয়ে তা মিলিয়ে যায়। তাই শাশুড়ির সঙ্গে সুসম্পর্ক চাইলে মেনে চলতে পারেন কিছু নিয়ম। কিছু সম্পর্ক একটু বেশি স্পর্শকাতর হয়। তাতে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনই সম্পর্ক হয় শাশুড়ি ও বৌমার। মা ও মেয়ের মত, এই দুটি শব্দের ভারসাম্য একটু বিগড়ে গেলে সংসারে অশান্তি অবধারিত। কোনো পরিবারে বউ নমনীয়, তো শাশুড়ি খুবই রূঢ়। আবার কোনো পরিবারের পরিস্থিতি তার ঠিক বিপরীত। কিন্তু যেই সম্পর্কটি সবচেয়ে মধুর হওয়ার কথা, সেখানেই কেন এত গলদ চোখে পড়ে। সম্পর্কটি মধুর নাহলে কত জটিলতার সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে পাঠক মাত্রেই জানেন। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা সব চলে যায়। বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে পরিবারের সদস্যদের। বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব মূলত মনস্তাত্ত্বিক। প্রথমত, শাশুড়ির দিক থেকে তিনি ভাবতে থাকেন তার এতদিনের সংসার-সন্তান; সেখানে অন্য কেউ এসে প্রভাব বিস্তার করতেই পারবে না। দ্বিতীয়ত, বউ ভাবতে থাকে, কাবিন করে স্বামী তার করেছে, পরিবার-পরিজন ছেড়েছে, তাহলে রাজত্ব তো তারই! প্রধানত এই দুই মানসিকতায় দ্বন্দ্ব ঘোরতর হয়। এছাড়া টুকিটাকি নানারকম পারিপার্শ্বিক ইস্যু তারা গড়ে তোলে। মাঝখান থেকে বিপদে পড়ে যায় পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। বিশেষ করে স্বামীরা। শাশুড়ি প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে আপন রাজত্বে রাজ করেন। ফলে এটা তার স্বভাবজাত ক্ষমতা থাকেই। নিজের মতো করে সংসারটাকে আগলে রাখা, জিনিসপত্র, রান্নাবান্না সব বিষয়ে সাধারণত তার একচ্ছত্র আধিপত্য চলে। ফলে শাশুড়ি কোনোভাবেই নিজের অবস্থানের ভিন্নতা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। তাই ঘরে ছেলের বউ এলে শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য বেশি তৈরি হয়। কারণ শাশুড়ি যেভাবে রান্না করেন, ঘরটা গুছিয়ে রাখেন, ছেলেকে শাসনে রাখতে পারেন, সেটা অন্যের ঘরের মেয়ে আসার পারেন না। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাপনে যে ছন্দপতন, তাই পরবর্তী সময়ে দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। এক্ষেত্রে শাশুড়ির মনে ধীরে ধীরে বউমার প্রতি কোমল ও মায়া-মমতার সৃষ্টি না হয়ে বরং উল্টোটা ঘটে। আবার অনেক শাশুড়ির মধ্যে এটাও লক্ষণীয়, তিনি তার বউ হয়ে আসার কালটা স্মরণ করিয়ে বউমার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তিনি যখন নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন, তখন শাশুড়ি তাকে কতটা শাসনে রেখেছিলেন, কী কী তিনি নিজের মর্জি মতো করতে পারেননি, সেটাও বউমাকে কন্ট্রোলে রেখে নিজের না পাওয়ার প্রতিশোধ নেন। তাই দ্বন্দ্ব কমে না। বরং বাড়তে থাকে। বউ ও শাশুড়ির দ্বন্দ্ব তাই ঘোরতর হয়। আবার ছেলের প্রতি মায়ের যে আদর-আহ্লাদ-শাসনের ছেদ পড়ে, সেটাও বেশিরভাগ মা মেনে নিতে পারেন না।
সব শাশুড়ির কমন একটা ধারণা, সমাজে প্রচলিত বিয়ের পর ছেলে বউয়ের আঁচলে বাঁধা পড়ে যায়। বউয়ের কথায় উঠে-বসে! এক্ষেত্রে মায়ের দিক থেকে যতটা জটিল মনস্তত্ত্ব কাজ করে, অন্যদিকে বউও ততটা নিজের কব্জায় আনতে উঠেপড়ে লাগে। গৃহিণী হলে বউয়ের কর্তৃত্ব একরকম থাকে, আর চাকরিজীবী হলে আরেক রকম। গৃহিণী বউমা যেহেতু সবসময় শাশুড়ির নজরদারিতে থাকে, সেহেতু তার প্রতিটি স্টেপ শাশুড়ি আত্মস্থ করে। ঠিক বউমাও তাই। দুজনের আচার-আচরণ সবই। তবে এক্ষেত্রে দুজন যতটা নিজেদের বোঝে, তত উল্টো পথে চলতে শুরু করে। হয়তো শাশুড়ি তরকারি রান্না হলে তেলটা কম দেন, পেঁয়াজ কম দিতে চেষ্টা করেন কিন্তু বউমা সেই পথ অনুসরণ করেন না। তিনি তার নিজের মর্জি অনুসারে চলেন। কারণ মেয়েরা যেহেতু পরের ঘরের সম্পদ, তাই বাবা-মা একটু বেশি আদরে-আহ্লাদে মানুষ করেন। কিন্তু বউমার এই আচরণ তিনি শাশুড়ির কাছেও আশা করেন। আবার শাশুড়ি যেভাবে ঘরটা নিজের মতো গুছিয়ে রাখে বউমা হয়তো উল্টো করলেন বা একটু ভিন্ন করলেন। কারণ দুটি মানুষ ভিন্ন। তাদের রুচি ভিন্ন। কালটাও ভিন্ন। তাই রুচি-সময় অনুযায়ী কিছুটা ভিন্ন হবে, এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিকতাকে অস্বাভাবিক করে তোলাই বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। শাশুড়ি যেমন তার সংসার-সন্তানকে বউমা আসার আগের মতোই বহাল তবিয়তে দেখতে চান, ঠিক বউমাও নতুন সংসারকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে গুছিয়ে নিতে চান। তিল তিল করে তিনিও চান তার নিজের সংসারটা নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে। এক্ষেত্রে বউমার মনস্তত্ত্ব শাশুড়ির সঙ্গে কোনো অংশেই মেলে না। কারণ বউমা হয়তো ছেলের টাকাকে শুধু নিজের অংশ ভেবে সবকিছু নিজের মতো গোছাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শাশুড়ি চান, ছেলে মানুষ করেছেন, তাই টাকা উপার্জন করলেও সেটা যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন, ততদিন তাদের সংসার অর্থাৎ আরও ভাই-বোন থাকলে সবাইকে মিলে সে টাকার ব্যবহার হবে। ফলে দ্বন্দ্ব আবারও হয়ে পড়ে ঘোরতর। কিন্তু বউমা ভাবেন নিজের স্বামী, নিজের টাকা; তাই সব নিজের মতো করেই আয়-ব্যয় হবে। শাশুড়ি-বউয়ের মনস্তাত্ত্বিক এই দ্বন্দ্ব প্রায় বাঙালি ঘরেরই চিত্র। কিছুটা হয়তো ব্যতিক্রম আছে। বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব থেকে সংসারে তৈরি হয় অশান্তি। কিন্তু একটি বার যদি একে অন্যকে বোঝার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায়, তবে বিষয়টা মধুর হয়ে উঠবে। বউ-শাশুড়ির এই বিষাদময় সম্পর্ক মধুর সম্পর্কে রূপ নেবে। প্রত্যেকটি মানুষ ভিন্ন। তার রুচি-চাহিদা-আচার-আচরণ-বেড়ে ওঠার সংস্কৃতি ভিন্ন। কেউ তরকারিতে ঝাল কম খাবে, কেউ বেশি, কেউ ঘুরতে পছন্দ করে, কেউ একা ঘরে বন্দি হয়ে জীবন কাটাতে পছন্দ করে। মানুষের সঙ্গ ভালো লাগে না। এই বিচিত্র স্বভাবের মানুষের জগতে তাই একমাত্র যে যেমন তাকে সেভাবেই গ্রহণ করা উচিত। তাকে সুযোগ করে দেওয়া উচিত নিজের মতো বাঁচার৷ তবে প্রসঙ্গ যেহেতু বউ-শাশুড়ি তারা তো ভিন্ন মত-পথের হবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই দুজনকেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বউমাকে শাশুড়ির ভালো-মন্দ সম্পর্কে একটু তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। কারণ বউমা যখন মেয়ে ছিলেন ঠিক তখন নিজের বাবা-মায়ের মতো অনুসারে কিন্তু জীবন পরিচালনা করেছেন।তাহলে শ্বশুর-শাশুড়ি তারা তো আরও দূরের। জীবনযাপনের বিষয়টাও তাই তাদের অনুসারে করা উচিত। এক্ষেত্রে একে -অন্যের মতকে গুরুত্ব দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এটা যে শুধু পরিবারে এমনটা নয় বরং একটি নতুন চাকরি, একটি নতুন প্ল্যাটফর্মে নিজেকেই উদ্যোগ নিতে হয়, তাদের মতো হয়ে গড়ে ওঠার জন্য। যেহেতু বাইরে কাজের তাগিদে আমরা তাদের মতো হয়ে উঠি, সেই নিয়ম পালন করে জীবনযাপন করি, তবে পরিবারের শান্তির জন্য কেন নয়! কয়েক ঘণ্টার জন্য যদি কর্মস্থলে রুটিন বেইজড লাইফ লিড করতে পারি, তবে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সংসার জীবনে কেন নয়?শাশুড়ি-বউয়ের একে অন্যকে বুঝতে হবে, সে অনুযায়ী পরস্পর কিছু ছাড় দিয়েই জীবন পরিচালনা করতে হবে। কারণ মানুষ একে অন্যের থেকে আলাদা হবেই। তাই শতভাগ কখনোই মিল আশা করা বোকামি। তবে পরস্পর সহযোগিতায় ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct