মহবুবুর রহমান : মাদের শিক্ষানবিশী চলতেই থাকে। জীবনভর। আমরা প্রতিদিন শিখি। যাপন ও জীবনের রোজনামচা আমাদের প্রায় প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় কত কিছু যে শিখতে বা শিখে নিতে বাধ্য করে। আমরা ঠেকে শিখি। ঠকে শিখি। ভুল করি বিস্তর। আবারও ঠিক করে ফেলি। পরবর্তী অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনে ছাত্রাবস্থায় শেখা অনেক ভাল জিনিস কাজে লাগে। অনেক কিছু কিন্তু আবার লাগেও না। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সেই শেখাটা কিন্তু ঠিক ছিল—কিন্তু নানা প্রতিকুলতা ও চাপের কাছে হয়তো সে আদর্শের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। দেওয়ালে কখনও পিঠ ঠেকে গেলে এও মনে হয়েছে, ধ্যুস জীবনে কিছুই শেখা হল না আজও। বলতে গেলে নার্সারি বা স্কুলে ভর্তি জীবনের আগে পর্যন্ত তো আমরা বাড়িতেই অ আ ক খ বা ইংরাজি বর্ণমালা, ১ থেকে ১০০, ছড়া, রং চেনা, পশুপাখিদের ছবি দেখে চিনতে শেখা, রামায়ণের গল্প আরও কত কি বাড়িতেই শিখে যাই বাবা মায়ের কাছ থেকেই। হামাগুড়ি বয়স থেকেই হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা সবই তাদের কাছেই। এক্কেবারে কচি বয়স থেকে আমাদের শিক্ষার হাতেখড়ি তাদের হাত ধরেই। আমাদের বাবা ও মা-ই আমাদের প্রথম ও পরম গুরু।জীবনযাপনের অন্যতম শিক্ষক।পরবর্তীতেও প্রিয় শিক্ষক তাঁরাই। তাঁদের স্নেহে, প্রশ্রয়ে, শিক্ষায়, সহমর্মিতায়, মরমী সমালোচনায়, চরিত্র গঠনের দৃঢ় শিক্ষায় আমরা ঋদ্ধ হতে থাকি ক্রমশ। আমাদের প্রতিটি আচরণের বহির্প্রকাশ ঠিক কী হবে, শিশুবয়স থেকেই উচিত-অনুচিতের বোধ আমরা শিখতে থাকি তাদের কাছেই। আমাদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ, আমাদের দায়বদ্ধতা বিশ্বাস, অন্যকে মাণ্যতা দেওয়া, গুরুজনকে সম্মান জানানো, নিজেদের পারিবারিক রীতিকে মর্যাদা দেওয়া, রক্ষণশীলতাকে টিকিয়ে রাখা এই সমস্ত কিছুই শিখি বাড়ির গুরুজন অভিভাবকদের থেকেই। আমাদের আদর্শ আমাদের চরিত্রগঠন সব কিছুর প্রাপ্তি তাঁদের থেকেই।তাই জীবনভর তাঁদের তরে আমরা চার ঋনি। জীবনভর তাঁরাই আমাদের পরম স্মরেণ্য ও বরেণ্য।পরম শ্রদ্ধার শিখরে তাঁরাই।তবে এর পরেই কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্ররুগণের অবস্থান। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষক হলেন মেরুদণ্ড সচল-সুস্থ রাখার তথা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা জ্ঞানের আলো দ্বারা যুগের সব অন্ধকার দূর করে মানুষের জন্য সভ্য পৃথিবী সৃজন করেন। মানুষের আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও নৈতিক বিকাশ অব্যাহত রাখতে সমাজে শিক্ষকের গুরুত্ব অপরিসীম।
সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষকরা মানুষের ভেতর সত্যিকারের মানুষ সৃজন করেন। তাই শিক্ষককে বলা হয় সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা। সত্যি তো, জন্মদাতা পিতা শুধু জন্ম দিয়েই থাকেন; কিন্তু তাকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলেন তার শিক্ষক। জ্ঞান বা বিদ্যার্জনের জন্য শিক্ষকদের ভূমিকাকে দ্বিতীয় জন্মদাতার সঙ্গে তুলনা করে শাহ মুহম্মদ সগীর কবিতার ছন্দে লিখেছেন,‘ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়,দোসর জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার।’শিক্ষকের মর্যাদা নামে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতা পড়েছি ছেলেবেলায়। বাদশা আলমগীরের শিক্ষকের মর্যাদা দেবার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই কবিতা। শিক্ষকের প্রতি বাদশাহর অপরিসীম শ্রদ্ধার প্রতিফলন ঘটেছে কবিতায়। সভ্য মানুষ তথা প্রকৃত মানুষ তৈরির মহান কারিগর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা জাতিসংঘের শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও সনদেও স্বীকৃত। যারা শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত বা শিক্ষাদান করেন তাদের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও যৌথ উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদাবিষয়ক সনদ তৈরি করেছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই মর্যাদাবিষয়ক সনদটি গৃহীত হয়।যুগে যুগে, কালে কালে স্মরণীয়, বরেণ্য ব্যক্তিরা তাদের শিক্ষকদের প্রতি সবিনীত শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (রাহ.) শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমার শিক্ষক ইমাম হাম্মাদ (রাহ.) যত দিন বেঁচেছিলেন, তত দিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। আমার মনে হতো, এতে যদি শিক্ষকের প্রতি আমার অসম্মান হয়ে যায়। ভবিষ্যৎ বংশধরদের যোগ্য-দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলোতে তাই বেতন ও সামাজিক অবস্থানে শিক্ষককে অনেক উপরে রাখা হয়।
নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, একটি দেশের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে একটি লাভজনক বিনিয়োগ। শিক্ষায় বিনিয়োগ হলে শিক্ষিত ও চৌকস জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। নতুন নতুন গবেষণার ফলে দেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গন আলোকিত হবে। ভারত সরকার মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় টানতে বেতনকাঠামোতে সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি ও উপযুক্ত মর্যাদা প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। ভারতের ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশে শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘Teachers in various categories should be given incentives by way of advance increments and higher grade pay to compensate them for higher qualifications at the entry point. Also, it would be a significant incentive for more meritorious scholars to join the teaching profession, particularly at this juncture when both the corporate sector and foreign educational institutions are luring the young talented persons away with higher salaries and better pay packages’. ১৮৫০-এর দশকে বাঙালিদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন, বিদ্যাসাগর তাদের অন্যতম। তা সত্ত্বেও কেবল শিক্ষানীতিতে সরকারের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না বলে, আদর্শের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাধারণ লোকেরা তখন নাকি তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়লে খাবেন কী করে?’ তার উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, তিনি আলু, পটোল বিক্রি করবেন, তা-ও ভালো। কিন্তু আপস নয়। একটা সময় ছিল যখন অন্যের সন্তানকে মানুষ করার অদম্য প্রয়াস ছিল শিক্ষকের মাঝে। পেশা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। পেশাই ছিল ধ্যান-জ্ঞান আর নেশা। তাদের নীতি ও আদর্শ সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল। বই-পুস্তকে সর্বদা ডুবে থাকতেন। জানার পরিধি বাড়ানোর এক অনমনীয় নেশায় ব্যস্ত থাকতেন। ছাত্রের মাঝে নিজের জ্ঞানটুকু ছড়িয়ে দিতে কত না আন্তরিক ছিলেন। দিনে দিনে শিক্ষককে নানা দুর্নাম পেয়ে বসেছে। নোট-গাইডের বদনাম। কোচিং-বাণিজ্যের বদনাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বদনাম। প্রশ্নফাঁসের বদনাম। বই-পুস্তকের সঙ্গে অনেক শিক্ষকের কোনো সখ্যই নেই। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটুকু পড়ে এসেছেন, তা দিয়েই শিক্ষকতা চালিয়ে নিতে চান। খুব কম শিক্ষক পাওয়া যায় যারা বই পুস্তকে লেগে থাকেন। চাণক্য শ্লোকে রয়েছে, ‘শিক্ষককে কখনো অবহেলা করা উচিত নয়। সৃষ্টি ও ধ্বংসের দুয়েরই বীজ লুকিয়ে রয়েছে শিক্ষকের মধ্যে।’ জাতিকে ভাবতে হবে যে, জাতির মেরুদণ্ডের চালিকাশক্তিকে বঞ্চিত করে, সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করে, সমাজ-রাষ্ট্রে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা যায় না। যেদিন এমন হবে ব্যাংকার ব্যাংকের চাকরি বাদ দিয়ে, পুলিশ পুলিশের চাকরি বাদ দিয়ে এমনকি লোভনীয় প্রশাসন ক্যাডার ছেড়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যাবে; সেদিন বুঝব অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। মনীষী ইবনে খলদুনের তার ‘আল মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘শিক্ষকও একজন মানুষ। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো শিক্ষকেরও ব্যক্তিগত জীবনে বেঁচে থাকার উপকরণের প্রয়োজন আছে।’ মেধাবীদের শিক্ষকতায় ফিরিয়ে আনা গেলে, শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা গেলে, গবেষণা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে, অবকাঠামো আরও উন্নত হলে, জবাবদিহি বৃদ্ধি করা গেলে এবং রাষ্ট্র শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি আরও মনোযোগী হলে শিক্ষা ও ঘাটতি অনেকখানিই পূরণ করা সম্ভব হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাসী।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct