সজল মজুমদার: থিবীর অন্যতম জীববৈচিত্রের আধার বা আঁতুড়ঘড় হলো সুন্দরবন। এটি বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা আমাদের দেশ এবং প্রতিবেশী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বরাবর অবস্থিত। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকা কে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। 4264 বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই অঞ্চলের বিস্তার। সুন্দরবন মানেই অগণিত ম্যানগ্রোভ গাছপালা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নোনা জলের কুমির, হরেক রকম কীটপতঙ্গ, প্রজাপতি, পাখি, এবং সরীসৃপ সমৃদ্ধ এক অজানা জঙ্গলমহল। “অজানা” শব্দটি প্রসঙ্গে বলতে হয়, বায়ুমন্ডলের নীল কার্বন বা ব্লু কার্বন শোষণ করে বায়ুকে সচ্ছ রাখতে এখানকার ম্যানগ্রোভের ভূমিকা অপরিসীম। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতির মাধ্যমে। সুন্দরবন অঞ্চলের সি গ্রাস এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে। কারণ সি গ্রাস অগভীর জলেও সালোকসংশ্লেষ করে থাকে। এখানকার ম্যানগ্রোভ বায়ুমণ্ডলে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইড সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ বা শোষণ করে এবং নিজের মধ্যে জমা রাখে। এই কার্বন উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ জমা হয়। যাই হোক, ম্যানগ্রোভ এবং ব্লু কার্বনের ভূমিকার বিষয়ে বিশদে কথা হচ্ছিল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক ড : আশীষ কুমার পালের সাথে। তিনি ব্লু কার্বনের বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, “ সুন্দরবনের নোনা জলাভূমিতে যেসব স্থানে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ জন্মায়, সল্ট মার্চ জাতীয় গাছ দেখা যায়, টাইডাল মাড ফ্লাড দেখা যায়, জোয়ারের জলে কোন কারণে ডুবে যাওয়া এবং ভাটা পড়া এসব স্থানে ব্লু কার্বন সঞ্চয়ের বিশেষ ভূমিকা দেখা যেতে পারে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ সাধারণত নোনা জলে, কর্দমাক্ত পরিবেশে বিস্তার লাভ করে, বৃদ্ধির হার ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন হতে পারে। সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের কার্বন ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের পাতা, কাণ্ড ছাড়াও মূলের মধ্যে সঞ্চয় করে রাখে। পরবর্তীতে মূলের মাধ্যমে মৃত্তিকার মধ্যে এই কার্বন সঞ্চিত থাকে। এই কার্বন কেই ব্লু কার্বন বলে। এই ব্লু কার্বন ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মাধ্যমে যত বেশি পরিমাণে মাটির মধ্যে সঞ্চিত হবে, বুঝতে হবে বায়ুমণ্ডল থেকে তত বেশি পরিমাণে কার্বন শোষিত হচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা পরোক্ষ ভাবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মূল কর্দমাক্ত মাটির অনেক নিচে প্রবেশ করার ফলে, কার্বনের সঞ্চয় অনেকটাই সম্ভব হয়। অন্যদিকে স্থলজ উদ্ভিদ শক্ত মাটির উপরে অবস্থান করার ফলে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শোষণ করলেও সাধারণত সেটি উদ্ভিদের কান্ড, পাতায় সঞ্চিত হয়।এই কার্বন কে গ্রীন কার্বন বলে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ব্লু কার্বন বিষয়টি নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে গবেষণা চলছে। কার্বন নিয়ে ট্রেডিং চালু হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। অর্থাৎ যদি কানাডা, আমেরিকা বা অন্যান্য উন্নত দেশগুলো ভাবে বায়ুমণ্ডলের কার্বনকে তারা শোষণ করাতে পারবেনা, কারণ সেসব দেশে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ সেভাবে নেই, সেই পরিবেশও নেই।সেসব ক্ষেত্রে এসব দেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বলতেই পারে জমির আয়তন হিসেবে অথবা হেক্টর হিসেবে যত বেশী ম্যানগ্রোভ রোপণ করা যাবে ,সেটা প্রতি হেক্টর ইউনিটে বা প্রতি কিউবিক ইউনিটে প্রতিবছর পরিমাপ করে উন্নত দেশগুলোকে যথাসময়ে রিপোর্ট পাঠালে বিনিময়ে সে সব দেশ তৃতীয় বিশ্বের এই দেশগুলোকে ইনসেন্টিভ বা কমিশন দেবে। ফলে উন্নত দেশগুলোতে শিল্পায়নের ফলে যে অতিরিক্ত দূষিত কার্বন উৎপাদন হচ্ছে, সেই ভারসাম্য তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ম্যানগ্রোভ রোপণ করিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে।এটাই কার্বন ট্রেডিং। এই কার্বন ট্রেডিং বিশেষ করে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ,থাইল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস এসব দেশ গুলোতে চালু আছে। সুতরাং এসব কারনেই ম্যান গ্রোভ এবং ব্লু কার্বনের বিষয়টি এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়।” অন্যদিকে সুন্দরবনের ব্লু কার্বনের ভূমিকা সম্পর্কে সুন্দরবনেরই ভূমিপুত্র উমা শংকর মণ্ডলের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি এ বিষয়ে জানান, “ শুধু সুন্দরবনেই ম্যানগ্রোভ নেই, সারা পৃথিবী জুড়ে এই ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে। বাংলাদেশ ,ভিতর কনিকা, ভারতের তামিলনাড়ু উপকূলে, আন্দামান, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকার উপকূলে, কেপ টাউনে প্রভৃতি জায়গায় এই উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। তবে একটানা বৃহৎ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বলতে এই সুন্দরবন। সুন্দরবনের মোট আয়ত ন 25000 বর্গ কিমি। তবে সব ম্যানগ্রোভ এর বায়ুমন্ডলের ব্লু কার্বন শোষণ ক্ষমতা কিন্তু সমান নয়। কেওড়া, ধানী ( সি গ্রাস ) ,কাকড়া , বাইন, এগুলোর কার্বন শোষণ ক্ষমতা সব থেকে বেশি। তাই সুন্দরবনের ম্যান গ্রোভ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতেও বিরাট ভূমিকা পালন করছে। পৃথিবীর গড় উষ্ণতা এখন ১৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এক্ষেত্রে উষ্ণতা আর বাড়তে থাকলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে পৃথিবী। সেক্ষেত্রে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ সামান্য হলেও ব্লু-কার্বন শোষণ করে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।” তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমানে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র নগরায়ন, কৃষিকাজ তৎসহ অন্যান্য পরিবেশ বিরুদ্ধ কাজের ফলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং পুনর্ জীবন দানের জন্য বেশি বেশি পরিমাণে ম্যানগ্রোভ রোপন এবং ব্লু কার্বন শোষিত করা ভীষণ প্রয়োজন। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের ব্লু কার্বন শোষন করার ব্যাপারে বর্তমানে প্রাসঙ্গিক গবেষণার একান্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষকরা ব্লু কার্বন বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে ব্লু কার্বন বিষয়টি উদ্ভাবন স্তরে বিচার করে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করা যেতে পারে। মোদ্দা কথা,মনে রাখতে হবে পৃথিবী এবং পরিবেশকে যেভাবেই হোক, রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব কিন্তু আমাদের কাঁধেই বর্তায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct