ভালোবাসার ধূলিস্যাৎ
তাপস কুমার বর
সেদিন বিকেল বেলায় অমিত ফেলুদার গোয়েন্দা গিরি বইটি পড়ছিল। হঠাৎ কখন যে,অগোচরে মায়া এসে অমিত কে দেখছিল, তা অমিত লক্ষ করেনি। অমিত পাশ ফিরে তাকাতেই সে হতবাক মায়াকে দেখে। অমিত খুব গরিব পরিবারের ছেলে। বাবা দিনমজুর। সংসারটা বাবার দিন মজুরির উপর অনেকটা নির্ভর করে। মা বাবার প্রতি অমিতের গভীর ভালোবাসা আছে, যা বোলে বোঝানো সম্ভব নয়,...“এ এক নাড়ির টান..জন্মগত পাওয়া সেই রক্ত। কতটা ভালোবাসি? সে মহাসমুদ্রের কুলু কুলু ধ্বনির মতো”। অমিত ছেলেবেলা থেকে পড়াশোনায় ভালো। পড়ার ফাঁকে অমিত মায়ের নানা রকম কাজ করে দেয়। আর্থিক টানা পোড়েনের মধ্যে পড়াশোনা বেশি দূর এগোতে পারেনি। উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে,একটা কাজের সন্ধানে, সে কত না চেষ্টা করেছে। কিন্তু কপাল যে তার ফাটা, কিছুই জোটে না। এখন সে মা-বাবাকে সহযোগিতার জন্য একটা হোটেলে কাজ করে। মাস বেতন ৭০০০টাকা, খাওয়া দাওয়া বাদে। একদিন মায়া তার মা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে, অমিত যে হোটেলে কাজ করে যেখানে খেতে এসেছিল। তখন অমিতের সঙ্গে মায়ার পরিচয় ছিল না। সে এক চমকপ্রদ ঘটনা। হোটেলে মায়া ও তার মা বাবা খাওয়া দাওয়া সেরে টাকাটা প্রেমেন্ট করতে যাবে কিন্তু টাকার পাসটা কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছে খুঁজে পাচ্ছে না। এটার জন্য তারা ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়েছিল, তারা টাকাটা কি করে দেবে? অমিত সবটা বুঝতে পেরে উনাদের সব কথা শুনে সে টাকা নিজে প্রেমেন্ট করে দেয়। মায়া বলেছিল আমরা বাড়িতে গিয়ে আপনার একাউন্টে এই টাকাটা পাঠিয়ে দেবো এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। সেদিন থেকে কখন যে অগোচরে, মায়া অমিত কে ভালোবেসে ফেলেছে, সেটা অমিত টের পায়নি। কারন মায়া খুব ধনী পরিবারের মেয়ে। অমিতের ভাবনায়,---“ চাঁদ কি কখনো মাটিতে লুটো পুটি খায়? সে সব সময় মহাদেবের মস্তকে শোভাবর্ধন করে”।সেদিন থেকে মায়া কলেজ থেকে আসার পথে, অমিতের হোটেলের সামনে অমিতের জন্য অপেক্ষা করে। মনের অন্তঃকোনে ভালোবাসার এক জাল বিছিয়েছে,---“এ যেন এক কুঁড়ে ঘরের সঙ্গে রাজ প্রসাদের প্রেম”। অমিত কতবার মায়াকে বোঝাতে চেয়েছে,---“ভালোবাসা অর্থের সাম্রাজ্যে মোড়া এক রাজত্ব। যেখানে সেই অর্থ থাকেনা ভালোবাসা ও একদিন ভেঙে চুরমার হয়”। মায়া তা ও বুঝতে চায়নি। সে অমিত কে ভীষণ ভালোবাসে। একদিন মায়ার বাবা অমিতের সঙ্গে মায়ার ভালোবাসার কথা জানতে পারে। সেদিন কি না হইচই হলো? অমিতকে হোটেল থেকে বের করে এনে কতই না অপমান করলো। সেদিন অমিত কিছুই বলেনি। হোটেলের মালিক সেদিন অমিত কে ভুল বুঝে, হোটেল থেকে বের করে দিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে একদিন যে ছেলেটা তাদের মান-সম্মান রক্ষা করেছিল, আজ সে খুব খারাপ। চোখের জল সেদিন থামেনি। বাড়িতে গিয়ে মা বাবাকে কি জবাব দেবে? যে হোটেলে সে কাজ করে, সেই কাজটা আর নেই। আজ বিকেলে বাড়িতে যখন ফেলুদার গোয়েন্দা গিরি বইটি পড়ছিল অমিত,হঠাৎ মায়াকে দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। মায়া বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য অমিতের কাছে এসেছে। বাড়িতে মাত্র তিনটে প্রাণী অমিত ও তার মা-বাবা। পূজো সেরে যখন অমিতের মা বাড়িতে ডুকেছে হঠাৎ চমকে উঠলো। বাড়িতে যেন একটা আলোর রোশনাই জ্বলে উঠেছে। হঠাৎ বাড়িতে মেয়ে মানুষের আগমন দেখে অমিতকে ডেকে বললো “ খোকা কে রে মেয়েটা”? অমিত বলতে গিয়ে ও বলতে পারেনি,...“এ তো একটা যন্ত্রণার গহ্বরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রেম,বোলে কি বোঝানো সম্ভব”? অমিতের মা সবই বুঝে ছিল, তাই কিছু আর জিজ্ঞাসা করেনি। অমিতের মা বলেছিল ও মেয়ে তোর নাম কী? বলে ছিল আমার নাম “মায়া”। এ পর থেকে অমিতের পরিবারকে মায়া কত না ভালোবেসে ফেলেছে,...
“আমি এক নতুন জন্ম পেলাম, সত্যিকারের ভালোবাসা কাকে বলে”!এতো বড়ো ধনী পরিবারের মেয়ে গরিবের ঘরে ঠাঁই করে নিতে চায় অমিতের ভালোবাসার রোমান্টিকতার সাম্রাজ্যে। এ দিকে মায়ার পরিবার হন্ত দন্ত হয়ে মায়াকে খুঁজে তোলপাড় করে ফেলছে আকাশ বাতাস। শেষ পর্যন্ত মায়ার খোঁজ পেয়ে মায়াকে তাঁর বাবা-মা; কাকু-কাকিমা; জেঠিমা জোর করে মায়াকে সেখান থেকে নিয়ে চলে আসে। সেদিন অমিতের মা ও বাবাকে মায়ার পরিবার কতই না অপমান করেছে,...“গরিবের হাত ওই চাঁদের দিকে, নিজেকে নিজেকে আগে চেনো, তার পর চাঁদ ধরবে”।অমিত সেদিন বোবার মতো একটা পাথর হয়ে পড়েছিল,..“যে কথা বলতে পারেনা, চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু ঝরে”।সেদিন মায়ার পরিবার মায়াকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। অমিতকে তার মা ও বাবা শুধু শান্তনা দিয়েছে,..“গরিবের ঘরে চাঁদের স্বপ্ন দেখতে নেই খোকা। আমরা ভীষণ গরিব রে,হয়তো ভগবান আমাদের লীলা খেলায় শাস্তি দিচ্ছে। সেটার মধ্যে কোনো শান্তি নেই, আছে শুধু দুরাশার যন্ত্রণা”।সেদিন থেকে অমিত ভবঘুরে হয়ে একটা যাযাবর সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। এবং মানুষদের গল্প, কবিতা,নাটক, গান ও কিছু বিনোদন শুনিয়ে কিছু পয়সা পেলে সেগুলো বুড়ো মা ও বাবার হাতে তুলে দিয়ে আসে প্রতি মাসে,....“জীবন আজ ধূলিস্যাৎ এর অন্ধকার। একটা আশার ব্যঞ্জনাকে খোঁজে”।মায়ার সাথে কোনদিন কি দেখা হবে? অমিতের আজ প্রায় দীর্ঘ পনেরো বছর কেটে গেছে। স্মৃতির পাতা অনেকটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। এখন আর আগের মতো পরিশ্রমের ক্ষমতা নেই,---“নস্টালজিক প্রেম আজ মুখ থুবড়ে অমিতকে বন্যার সাগরে আজও ভাসিয়ে নিয়ে যায়”।অমিত যেন আজ একটা উন্মত্ত পাগল, এখন ও মায়ার স্মৃতিগুলো তাকে যন্ত্রণা দেয়। বুড়ো মা ও বাবা অমিতকে আর সংসারী করতে পারেনি। আজ সে ছন্নছাড়া যুবক,....“জীবনের ইতিহাসে অপমান বইতে বইতে মৃত্যুকে সে ডাকে”।একদিন একটা ফুটপাতে উন্মত্ত পাগল হয়ে পেটের খিদের জ্বালায় বার বার বলছে,...“বাবুরা দুটো পয়সা দাওনা, দু’দিন কিছু খাইনি,বুকে আমার খাদ্যের মর্মভেদী যন্ত্রণা”।কিন্তু কেউ সহযোগিতা করেনি।সমাজ যেন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত,...“ হয়’তো কত অমিত এইভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে ছন্নছাড়া,তা গুনে শেষ করা যাবেনা”।একটা আট বছরের শিশু অমিতের কাছে এসে বলছে, কাঁদছেন কেন? অমিত বললো বাবা দুদিন কিছু খাইনি,খিদের যন্ত্রণায় কাঁদছি। কিছু ক্ষণের জন্য শিশুটি উধাও, তার কিছুক্ষণ পর শিশুটি তার মা ও বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে বলছে,...“মা দেখো, ওই লোকটাকে কিছু পয়সা দাও,দু’দিন কিছুই খায়নি”।চোখের কোনে সেই অস্পষ্ট চাহনি, আজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যার জন্য সে আজ উন্মক্ত পাগল। আজ সেই মায়ার সম্মুখে,...“জীবনের ধূলিস্যাৎ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে”। অমিত সেদিন চিনতে পেরেছিল মায়াকে। সে পরিচয় দেয়নি কারণ জীবনের ধূলিস্যাৎ সে দেখেছে কতটা আগুনের মতো দগ্ধ, সেই যন্ত্রণা! অমিতকে কিছু পয়সা ও কিছু খাবার কিনে দিয়ে নিমেষের মধ্যে কোথায় যেন তারা উধাও হয়ে যায়,...“আজ সেই জীবন প্রবাহ, অমিতের মৃত্যুর পিরামিডে দাঁড়িয়ে, জীবনের অবজ্ঞা নিয়ে বেঁচে আছে”। এক সাথে বাটি হাতে ফুটপাতে বসে চিৎকার করে বলে,...“বাবুগো খাইনি কাল থেকে, দুটো পয়সা দাওনা বাটিতে”!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct