ম্যাথু সাসেক্স: রাশিয়ার কুখ্যাত ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোশিনের বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনার উত্তাপ কমেনি। রহস্যময় এ ঘটনার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হলো, এটা এমন এক সতর্কবার্তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, মাস দুয়েক আগে যা উচ্চারিত হয়েছিল খোদ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখে। পুতিনের আশঙ্কা ছিল, বেসামরিক সংঘাতের (সিভিল ওয়ার) দ্বারপ্রান্তে রাশিয়া! প্রেসিডেন্ট পুতিনের আশঙ্কাবাণীর ঠিক দুই মাসের মাথায় বেঘোরে মারা পড়েন ওয়াগনারের প্রধান। এ ঘটনাকে বাস্তবিক অর্থেই ‘রহস্যজনক’ না বলে উপায় নেই।ওয়াগনার বাহিনী যখন বিদ্রোহের ঘটনা ঘটায় মহাপ্রতাপশালী পুতিনের বিরুদ্ধে, তখনই ধরে নেওয়া হয়েছিল, প্রিগোশিনের হাতে আর বেশি সময় নেই! রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উদ্ভট এক বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে প্রিগোঝিন বাহিনী যখন সাঁজোয়া যান নিয়ে দক্ষিণ রাশিয়ার মধ্য দিয়ে মারমার কাটকাট ভঙ্গিতে অনেকটা বিনা বাধায় অগ্রসর হচ্ছিল, তখনই সবাই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, প্রিগোশিন এরপর যে কদিন জীবিত থাকবেন, তাকে বেঁচে থাকতে হবে ‘ধার করা সময়ে’। বাস্তব ক্ষেত্রে ঘটেছেও সেরকমটাই। পুতিনের কঠোর নিয়মের মুখে পড়ে থেমে যেতে হয়েছে ওয়াগনারের প্রধানকে।এখন প্রশ্ন হলো, ‘পুতিনের রাশিয়ায় বেঁচে থাকার কঠোর নিয়ম’ ঠিক কী? পুতিনের স্বঘোষিত এই নিয়ম মোটাদাগে দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এক, নৌকায় উঠে বাধ্য ছেলের মতো বসে থাকতে হবে আপনাকে; কোনোমতেই আপনি নৌকায় চড়ে দোলাদুলি করতে পারবেন না। দুই, কোনো অবস্থাতেই জারের (মহা প্রতাপশালী রুশ অধিপতি) প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবেন না আপনি। অর্থাত্, কোনো পরিস্থিতিতেই শাসকের মতের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। পুতিনের নিয়মকে কঠিনই বলতে হয় বইকি।মজার ব্যাপার হলো, প্রিগোশিনকে দ্রুতই নির্মূল করা হবে—এই আশঙ্কা যখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে, ঠিক একই সময়ে রাশিয়ার ভেতরকার ‘একটি কঠিন বাস্তবতা’ও সামনে এসেছে নতুন করে। এটা আর আজকের দিনে অবাক হওয়ার মতো কোনো সংবাদ নয়, পুতিনের রাজনীতি আরো দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়েছে। প্রিগোশিনকে ধ্বংস করা গেছে বটে, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এতে কি পুতিনের প্রবল শক্তিমত্তা প্রকাশ পেল, নাকি কর্তৃত্ববাদী পুতিনের দুর্বলতা আরও ঘনীভূত হওয়ার আলামত স্পষ্ট হলো? নিরেপক্ষভাবে বলতে গেলে দ্বিতীয় বাক্যটিকেই বেছে নিতে হবে। এর পেছনে স্পষ্ট যুক্তিও দাঁড় করানো যায়।
প্রথমত, পুতিনের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বাহিনীটির শীর্ষ কয়েকজন ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনা রুশ অভিজাত শ্রেণির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, প্রেসিডেন্টের কথার বাইরে গেলেই ‘নির্ঘাত বিপদ’! এই কথার বাস্তব অর্থ হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণি এখন আর পুতিনের কথায় বিশ্বাস রাখতে চাইবে না।মনে থাকার কথা, একটা সময় ছিল, যখন ক্ষমতা ও প্রভাবের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা পুতিনের খুব কাছের লোক ছিলেন। পুতিনের শাসনাধীনে পাকাপোক্তভাবে সুরক্ষিত ছিলেন তারা। কিন্তু হঠাত্ করে সেই অবস্থান থেকে ক্রেমলিন সরে এসেছে যেন। পুুতিন জামানার আজকের চিত্র হলো, যতক্ষণ পুতিনের নিয়ম মেনে চলা হবে, ততক্ষণ নিরাপদ থাকা যাবে। এর ব্যতয় ঘটাতে গেলেই মহাবিপদ। বহু বছর ধরে পুতিনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে আসা প্রিগোশিন যেই না তার কথার বাইরে চলে গেলেন, তখনই তাকে বরণ করতে হলো করুণ পরিণতি।বলে রাখা দরকার, ওয়াগনার বিদ্রোহের পর পুতিন আশ্বাস দিয়েছিলেন এই বলে যে, প্রিগোঝিন ও তার ওয়াগনার সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। তবে পুতিনের এই কথায় বিশ্বাস রাখতে পারেননি বেশির ভাগ মানুষ। বরং ক্ষ্যাপাটে পুতিনের এমন আশ্বাস জনসাধারণের কাছে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়েছিল শুরু থেকেই। এদিক থেকে বিচার করলে রুশ জনগণের বিরাট একটা অংশের কাছে ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ হারিয়েছেন পুতিন—এ কথা মানতেই হবে।প্রিগোশিনের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে রাশিয়ান বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতকে দায়ী করা হয়েছে ওয়াগনার গ্রুপের টেলিগ্রাম চ্যানেলের পক্ষ থেকে। এ দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে রিপোর্ট করেছে চ্যানেলটি। এর সরল অর্থ, এটা পাতানো ঘটনা নাকি নিছক দুর্ঘটনা, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; বরং এক্ষেত্রে বিবেচ্য হলো, এখন কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন যে, প্রতিশোধ ছাড়া অন্য কিছু ছিল এটা।হয়তো ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘোরাতে নতুন কোনো ফন্দি আঁটছে ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য কিছুটা বিরতি দিয়ে হয়তো ‘বিকল্প কোনো গল্প’ খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব প্রচেষ্টাতে যে কাজের কাজ কিছুই হবে না, তা একপ্রকার নিশ্চিত। পরিষ্কার কথা, পুতিনের সন্ত্রাসের রাজনীতির স্বধ্বংসাত্মক ত্রুটি প্রকাশ্য হচ্ছে অবিরতভাবে। মূলত ভীতি প্রদর্শন ও ধাপ্পাবাজি—এই দুইয়ের ওপর ভর করেই টিকে আছে পুতিনের শাসন। এর ফলে যে সব রুশ নাগরিক আগামী দিনে অনিবার্য লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন, তারা পুতিনের খেলার নিয়মে (পুতিনের শাসনের নিয়ম সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে) পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে মাঠে নামবেন—প্রকাশ্যে বা ভেতরে ভেতরে।
আরেকটি বিষয়, প্রিগোশিনের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে যে রাশিয়ার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্জলর (পিএমসি) কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিতে সক্ষম হয়েছেন কৌশলী পুতিন, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং এর বিপরীতে আগামী দিনে পিএমসি আরো বেশি প্রসারিত হতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। ইউক্রেনের পাশাপাশি বর্তমানে রাশিয়ায় বেশ জোর গতিতে কাজ করছে কয়েকটি রুশ ভাড়াটে সেনাদল। এমনো জল্পনা রয়েছে, ওয়াগনার গ্রুপের শূন্যতা পূরণ করার পদক্ষেপ হিসেবে মাঠে নামতে পারে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলা রেডুট গ্রুপের মতো বাহিনী।একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে পিএমসি। সম্ভবত ‘পুতিনের রাষ্ট্র’ থেকে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিতের চিন্তা থেকে পিএমসিকে ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী হিসেবে ব্যবহারের পথে হাঁটতে পারে রাশিয়ার প্রভাবশালী শ্রেণি। এর ফলে কী ঘটতে পারে? যুদ্ধবাজ সমাজে যে সব সময় একধরনের ভীতি কাজ করে মানুষের মধ্যে, তা প্রমাণিত হবে বারবার।এ কথা সত্য, প্রিগোজিনের মৃত্যু ইউক্রেন যুদ্ধে সম্ভবত খুব একটা প্রভাব ফেলবে না রাশিয়ার ওপর। তবে ওয়াগনার গ্রুপের জন্য দুঃসংবাদ, বাহিনীটির সিনিয়র কমান্ড কাঠামোকে স্থায়ীভাবে ধূলিসাত্ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও আফ্রিকা অঞ্চলে মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রভাব মোকাবিলার প্রশ্নে ক্রেমলিনের জন্য এখনো ওয়াগনারই অন্যতম ভরসা। মালি ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের আঞ্চলিক স্বৈরশাসকদের সমর্থন করার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে এই ভাড়াটে সেনাদল।যা হোক, এই ধাঁধার উত্তর কখনোই মেলানো যাবে না—প্রিগোশিনকে শাস্তি দিতে মাস দুয়েক সময় নিল কেন ক্রেমলিন? এ বিষয়ে শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে কথা বলা যায়। তবে মনে করা যেতে পারে, রুশ গোয়েন্দা পরিষেবা হয়তো কিছুটা সময় নিয়ে থাকতে পারে এটা আবিষ্কার করার জন্য যে, ওয়াগনার বাহিনী কিংবা ওয়াগনারপন্থিদের শেকড় কতটা গভীরে? এবং সশস্ত্র বাহিনীসহ অন্যান্য শক্তিকাঠামোতে কতটা প্রভাব বিস্তার করে বসেছিল এই বাহিনী?লক্ষণীয়, মৃত্যুর মতো প্রিগোশিনের কর্মজীবনের গতিপথও বেশ রহস্যময়। প্রথম জীবনে তিনি একজন দোষী সাব্যস্ত অপরাধী। এরপর সেখান থেকে প্রেসিডেন্টের ‘আপন লোক’ হয়ে ওঠা। তারপর রাশিয়ার প্রধান ‘বিভ্রান্তিকর ব্যবসায়ী’ এবং সব শেষে একটি বেসরকারি সামরিক কোম্জলর ধনী ও নৃশংস প্রধান ব্যক্তি। এখানে যে বিষয়টি চোখে পড়ার মতো তা হলো, একটা সময়ে এসে রাশিয়ার নিজস্ব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরাজিত করতে বিদ্রোহ করে বসা এবং রহস্যজনকভাবে নিহত হওয়া—তাও আবার নিজের দেশের মাটিতেই। প্রিগোশিনের রঙিন জীবনের চিত্র একদিকে যেমন আমাদের রহস্যের জগতে নিয়ে যায়, মস্কোর আকাশসীমার ভেতরে এভাবে তার হঠাত্ ‘নেই’ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও হতবাক করে একইভাবে। এ ঘটনায় দিন শেষে পুতিনের লাভ হলো না ক্ষতি, তার হিসাবে প্রায় সবাই বলবেন একই কথা—অবস্থা এমন, স্বার্থে আঘাত লাগলে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গলায় ছুরি চালাতেও দুই বার ভাবছেন না পুতিন!
সৌ: ইত্তে:
লেখক: গ্র্রিফিথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এএনইউ) স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স স্টাডিজ সেন্টারের ফেলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct