ভারতে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের মাত্র মাসখানেক হলো। এই জোটের সাফল্য–ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করছে আগামী এক দশকে ভারতের রাজনীতি ও সমাজ কোন পথে এগোবে। ভারত আরও গভীরভাবে ধর্মকে আঁকড়ে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ করবে, নাকি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে—তা অনেকটা নির্ভর করছে ২০২৪ সালের নির্বাচনের ওপর। এই নির্বাচনের পরপরই ২০২৬ সালে ভারতে ‘ডিলিমিটেশন’ বা নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হবে। বিজেপি জিতলে তারা নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করবে, যাতে ভবিষ্যতে হারের শঙ্কা না থাকে। কিন্তু বিজেপিবিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটে নানা সমস্যা মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
সিপিআইএম এভাবে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে একই সারিতে বসানোতে মমতা যে খুশি নন, তা বলাই বাহুল্য। জুলাইয়ে জোট হওয়ার পরে মমতা একমাস কংগ্রেস বা সিপিআইএম—কাউকেই জোরালো ভাষায় আক্রমণ করেননি। ২১ আগস্ট মমতা আবার নতুন করে সিপিআইএমের বিরোধিতা শুরু করেছেন। নতুন করে তাঁর রাজনৈতিক আক্রমণ যে সার্বিকভাবে ‘ইন্ডিয়া’ জোট ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভারতের চিত্র
দিল্লিতে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি (আপ) ও কংগ্রেসের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ শুরু হয়েছে। আপ-এর হাত থেকে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া নিয়ে সম্প্রতি এই বিরোধের সূত্রপাত। দিল্লির কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ আপকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ এবং চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দল বলে মনে করে। ফলে, আপ–এর সঙ্গে সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেই বিভাজন রয়েছে। অবশ্য আপ–এর সঙ্গে তাদের বিরোধ নতুন কিছু নয়। এসব বিরোধকে কেন্দ্র করে দিন কয়েক আগে আপ ‘ইন্ডিয়া’ জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছে। এখন অবশ্য সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক আছে। তবে স্থায়ী হবে কিনা, তা আগামী কয়েক মাসে বোঝা যাবে। আবার এরই মধ্যে উত্তর প্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি) ‘ইন্ডিয়া’ জোট ছেড়ে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে যোগ দিয়েছে। আরএলডির প্রভাব প্রধানত উত্তর প্রদেশ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল ও রাজস্থানে। দল হিসেবে তারা খুব বড় নয়, আসনও বেশি পায় না। তবে তাদের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। আরএলডি জাঠ সম্প্রদায়-নির্ভর দল। জাঠেরা ভারতে প্রভাবশালী সম্প্রদায়। তারা প্রধানত কৃষিনির্ভর। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কৃষির বিভিন্ন উপকরণ—যেমন সার, রাসায়নিক, বীজ প্রভৃতির দাম বেড়েছে। কৃষির সার্বিক সংকট কংগ্রেস–নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের আমলের চেয়ে ঢের বেড়েছে। এ ছাড়া, বিজেপি বছর কয়েক আগে কৃষি বিল পাশ করানোর চেষ্টা করেছিল, যা বড় কৃষক বিশেষ করে জাঠদের স্বার্থবিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই জাঠরা বিজেপির কাছ থেকে অনেকটা সরে গেছে।লোকসভা নির্বাচনের আগে আরএলডির সঙ্গে যদি বিজেপির হাত মেলানো হয় জাঠরা তা ভালোভাবে নেবে না। তারপরও বিজেপির সঙ্গে তাদের হাত মেলানো জাঠ ভোটকে প্রভাবিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উত্তর প্রদেশে গত বিধানসভা (২০২২) ও লোকসভা (২০১৯) নির্বাচনে বিজেপির গড়ে ১৫ শতাংশ আসন কমেছিল। তাই লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যস্তরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ছোট শরিকদের ভাগিয়ে নিতে বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই আরও জোর দেবে। এতে বিরোধীদের বিপদ আরও বাড়বে। অনেক রাজ্যেই এতদিন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গ বা দিল্লি। এই একই সমস্যা দেখা দিতে পারে আরও কয়েকটি রাজ্যে। যেমন উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে, মহারাষ্ট্রে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, কংগ্রেস ও শিবসেনার মধ্যে, বিহারে লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেডের মধ্যে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আসন সমঝোতা করতে গেলে এই বিরোধ আরও বাড়বে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
একটি রাজনৈতিক দলকে শুধু ওপরের দিকে জোটের কথা ভাবলেই হয় না। নিচের দিকের ক্যাডার ও নেতা–নেত্রীদের কথাও মাথায় রাখতে হয়। জোটের স্বার্থে নেতা–নেত্রীদের কেন নিজের আসন ছাড়া প্রয়োজন এবং ভারতের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানে কেন নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেওয়া দরকার, সেটা বোঝাতে হয়। মাঝারি বা নিচের স্তরের নেতা–কর্মী এবং ক্যাডারের ওপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এই কাজ করা অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে সেই নিয়ন্ত্রণ হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তামিলনাড়ুতে ডিএমকের আছে। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যে যেখানে কংগ্রেস প্রধান ও বিজেপি বিরোধী দল (কিংবা উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি), সেসব রাজ্য তাদের ক্যাডার-কর্মীদের ওপর সেই নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, বলা মুশকিল। জোর দিয়েই একটি কথা বলা যায়, অধিকাংশ বড় দলেরই নেতা–কর্মীদের ওপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সেটি বিজেপি ভালো করেই জানে। ফলে ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠন হওয়ার পর থেকেই বিজেপি প্রবল উদ্যমে কখনো প্রলোভন দেখিয়ে; আবার কখনো ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের নেতা–কর্মীদের কখনো টানতে শুরু করেছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠনের ঠিক আগে শারদ পাওয়ারের দল ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা অজিত পাওয়ারসহ আটজন বিধায়ককে টেনে নিয়েছে মহারাষ্ট্রের বিজেপি জোট। উত্তর প্রদেশেও নেতা–নেত্রীদের টানতে শুরু করেছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠনের এক পক্ষকালের মধ্যে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির অন্তত ১২ জন স্থানীয় নেতা–নেত্রীকে তুলে নিয়েছে বিজেপি। গোটা রাজ্যে তাঁরা ভোট প্রভাবিত করতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু একেবারে স্থানীয় স্তরে একটি-দুটি আসন প্রভাবিত করার মতো যোগ্যতা রাখেন। বিজেপি যেখানে–যেখানে দুর্বল, বেছে বেছে সেখানেই তারা এই স্থানীয় নেতা–নেত্রীদের আগামী দিনে আরও বেশি করে তুলে নিয়ে যাবে। পরিস্থিতি দেখা বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের চ্যালেঞ্জ অনেক বাড়বে। শুধু জার্মানির উদাহরণ দিয়ে, আদর্শের কথা বলে, ছোট দল ও স্থানীয় নেতা–নেত্রীদের ধরে রাখতে পারবে না ‘ইন্ডিয়া’ জোট। বিশেষত জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা নরেন্দ্র মোদি যখন প্রচারে নামবেন, তখন চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। আশা করা যায়, বিষয়টি মাথায় রাখছেন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের নেতৃত্ব।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct