ভারতে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের মাত্র মাসখানেক হল। এই জোটের সাফল্য–ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করছে আগামী এক দশকে ভারতের রাজনীতি ও সমাজ কোন পথে এগোবে। ভারত আরও গভীরভাবে ধর্মকে আঁকড়ে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ করবে, নাকি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে—তা অনেকটা নির্ভর করছে ২০২৪ সালের নির্বাচনের ওপর। এই নির্বাচনের পরপরই ২০২৬ সালে ভারতে ‘ডিলিমিটেশন’ বা নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হবে। বিজেপি জিতলে তারা নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমানা এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করবে, যাতে ভবিষ্যতে হারের শঙ্কা না থাকে। কিন্তু বিজেপিবিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটে নানা সমস্যা মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি–বিরোধী সর্বদলীয় ‘ইন্ডিয়া’ জোট গঠিত হয়েছে গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি। মাসখানেক যেতে না যেতেই এই জোটে চিড় ধরেছে। কোনো কোনো দল এই জোট ছেড়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স) জোটে যোগ দিয়েছেন। কেউবা চরম বিভ্রান্ত। আবার রাজ্যস্তরে জোট শরিকদের মধ্যে রয়েছে ঝামেলা। রাজ্যে জোটের একে অন্যের প্রধান প্রতিপক্ষ। যেমন পশ্চিমবঙ্গে একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস, অন্যদিকে সিপিআইএম-কংগ্রেস। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে তারা আবার পরস্পরের মিত্র। বর্তমান জোট–রাজনীতির গুরুত্ব বোঝাতে প্রথমেই ইতিহাস থেকে দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বিরোধী রাজনীতিতে জোটের গুরুত্ব কোথায়, এই উদাহরণ থেকে তা হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে। দুটি ঘটনাই প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯৩০ দশকের প্রথমার্ধের। প্রথমটি ঘটে ১৯৩১ সালে চিনে। ওই সময় জাপান চিনে আক্রমণ করেছিল। সে সময়ে জাতীয়তাবাদী জেনারেল চিয়াং কাই-শেকের গুওমিন্দাং দলের সঙ্গে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির পথে-প্রান্তরে লড়াই চলছিল। গুওমিন্দাংয়ের হাতে তুলাধোনা হচ্ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এর এক বছর আগে ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে–তুংয়ের প্রথম স্ত্রী ইয়াং কাইহুইকে হত্যা করেছিলেন গুওমিন্দাং। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী জাপানকে রুখতে চিয়াং কাই-শেকের দলের সঙ্গে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং চিনা কমিউনিস্ট নেতা মাও সে–তুং। যদিও দলে শ্রেণিশত্রু গুওমিন্দাংয়ের সঙ্গে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গড়ে তোলার বিষয়ে দ্বিমত ছিল।পরে ১৯৩৭ সালে গুওমিন্দাংয়ের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রশ্নে মাও বহু আলোচিত প্রবন্ধ ‘অন কন্ট্রাডিকশন’ (দ্বান্দ্বিকতা) লিখেছেন, ‘জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়ে গুওমিন্দাং এবং দেশীয় সামন্তশক্তির ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টি মধ্যপন্থী নীতি নিয়েছিল। কারণ, গুওমিন্দাং জাপানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।’যুদ্ধের সময় মাও শত্রুকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন—প্রধান ও অপ্রধান। চিনে জাপানের আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শত্রু গুওমিন্দাং অপ্রধান শত্রুতে পরিণত হয়। এই অপ্রধান বা দ্বিতীয় শত্রু গুওমিন্দাং হয়ে ওঠেন প্রধান মিত্র। সেই মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে জাপানকে হারাল কমিউনিস্ট পার্টি। জাপানকে হারানোর পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার গুওমিন্দাংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। তাদের হারিয়ে ১৯৪৯ সালে চিনে সফল বিপ্লব হল। চিনের ক্ষমতায় এল কমিউনিস্ট সরকার। এই সরকার আগামী অক্টোবরে ৭৫ বছরে পড়বে। এটাই হচ্ছে জোটের সাফল্য।এবার জোট গঠন না করার একটি ব্যর্থতা দেখে নেওয়া যাক। প্রায় একই সময়ে ১৯৩২ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন নাৎসি পার্টি ৩৩ শতাংশ ভোট পেল। কিন্তু জার্মানির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও মধ্যপন্থী ক্যাথলিকরা জোট গঠন করতে ব্যর্থ হল।ইতিহাসবিদ টিমোথি রাইব্যাকের কথায়, ‘তাঁরা পরস্পরকে প্রায় ততটাই অবিশ্বাস করতেন, যতটা তাঁরা নাৎসিদের ভয় পেতেন। বিরোধী ঐক্য তাঁরা গড়ে তুলতে পারলেন না।’ফলে ১৯৩৩ সালের জুলাই মাস শেষ হওয়ার আগেই জার্মানিতে সব দল নিষিদ্ধ হয়ে গেল। একমাত্র স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে ময়দানে রইল নাৎসি পার্টি। বিরোধীদের জোট গঠনের অক্ষমতার জেরে পরের চারটি নির্বাচনে হিটলার পেলেন যথাক্রমে ৪৩ (মার্চ ১৯৩৩), ৯২ (নভেম্বর ১৯৩৩), ৯৮ (১৯৩৬) ও ৯৯ (১৯৩৮) শতাংশ ভোট। বাকিটা তো ইতিহাস।
পশ্চিমবঙ্গের চিত্র
বিশ্বের এই দুই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে ভারতের অভিজ্ঞ নেতা–নেত্রীরা নিশ্চয়ই সচেতন। তাই তাঁরা জুলাইয়ের মাঝামাঝি বেঙ্গালুরুতে বিজেপিবিরোধীরা হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এখন কার্যত পরিস্থিতি ভিন্ন। এক দলের সঙ্গে অন্য দলের রাজনৈতিক স্বার্থের বিরোধ বেশ গভীর। এখন তাঁদের অবস্থা দেখে কেন যেন মনে হচ্ছে, জার্মানির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাস্তায় হাঁটছেন তাঁরা, মাও সে–তুংয়ের রাস্তায় নয়।ভারতের প্রধান বাম দল সিপিআইএমকে (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসিস্ট) দিয়েই শুরু করা যাক। গত জুনে পাটনায় বিরোধীদের প্রথম বড় সমাবেশে প্রধান শত্রু তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির ছবি প্রকাশ্যে আসার পর সিপিআইএমের ভেতরে তীব্র মতবিরোধ শুরু হয়েছে। অবস্থা যে এমন হতে পারে তা খানিকটা আন্দাজ করেই ২০২২ সালের এপ্রিলে সিপিআইএম শেষ পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তাবে লিখেছিল, আগামী দিনে দলের ‘প্রধান কাজ হল বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন ও পরাজিত করা।’পার্টি কংগ্রেসে বলা হয়েছিল, বিজেপিকে হটাতে সিপিআইএম সংসদের ভেতরে–বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তির সঙ্গে ‘সহযোগিতা’ করবে। এই বছরের এপ্রিলে সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটি আবার একটি বিবৃতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।কিন্তু দলের ভেতরে এসব নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি মাথায় রেখে আরেকটি লাইনও যোগ করেছিল, ‘এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিস্থিতি যেহেতু ভিন্ন, তাই যেকোনো ব্যবস্থা রাজ্য-নির্দিষ্ট হতে হবে।’ কেন্দ্রীয় কমিটি বললে বা চাইলে কী হবে। রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে বিরোধ যে থামছেই না। আগস্টের গোড়ার দিকে সিপিআইএমের বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির একাংশ কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের প্রশ্ন, দীর্ঘ সময় তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে মার খেয়ে কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে তাদের সঙ্গে জোট করা সম্ভব? এতে কি দলের নেতা-কর্মীরা আশাহত হবেন না? বিশেষত যখন সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ হয়ে গেছে। দলের রাজ্য কমিটির যুক্তি মেনে সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে তাই মাঝেমধ্যেই বলতে হচ্ছে—তাদের দুই শত্রু, কেন্দ্রীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ও রাজ্যস্তরে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct