পুতিনের অধীনে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা একধরনের অসুস্থ চলমান রসিকতায় পরিণত হয়েছে, যেখানে পুতিনবিরোধী ব্যক্তিরা হরহামেশা সহিংসতা, অপহরণ অথবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এটাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিরক্ষা বলা যায়? রাশিয়ার বর্তমান রাজনীতিতে রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াগনার প্রধান প্রিগোশিনের মৃত্যু তার উজ্জ্বল উদাহরণ। এ নিয়ে লিখেছেন নাথান হজ।
যদি ইয়েভজেনি প্রিগোশিনের শেষ অধ্যায়টি সত্যিই লেখা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি ঠিক সেভাবেই মারা গেলেন, যেভাবে তিনি জীবন যাপন করেছিলেন—অত্যন্ত সহিংসতা, জাঁকজমকপূর্ণ এবং চক্রান্তের মধ্য দিয়ে।প্রকৃত ঘটনা মাত্র পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। গত বুধবার বিকালে ওয়াগনার প্রধান প্রিগোশিনের নামে নিবন্ধিত একটা এমব্রার লেগাসি বিজনেস জেট আকাশ থেকে রাশিয়ার ভের অঞ্চলের কুজেনকিনস্কো গ্রামের ঠিক দক্ষিণে বিধ্বস্ত হয় এবং বিমানে উপস্থিত ১০ জনই নিহত হন।কিন্তু ইন্টারনেটে এ বিষয়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের উদ্ভব ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। প্লেনটাকে কি গুলি করে ধ্বংস করা হয়েছে? অথবা প্লেনের মধ্যেই বোমা স্থাপন করা হয়েছিল? আর সত্যিই কি প্রিগোশিন মারা গেছেন? রাশিয়ান প্রোপাগান্ডিস্ট ভ্লাদিমির সলোভিওভ ঠিক এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি টেলিগ্রামের মাধ্যমে এক বিবৃতিতে পরোক্ষভাবে জানিয়েছেন, ওয়াগনার প্রধান প্রিগোশিনের মৃত্যু ঘটার আগেই এই খবর ছড়াতে শুরু করে!রাশিয়ার একটি টিভি চ্যানেল ‘রোশিও ২৪’-এর এক প্রতিবেদনে সলোভিওভ বলেন, ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা আগে থেকেই প্রিগোশিনের মৃত্যুর ব্যাপারে ভুয়া খবর প্রচার শুরু করেছিল।সলোভিওভ, যিনি দুর্বল ওলটাপালটা তথ্য প্রচারের জন্য সুপরিচিত, প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর দ্রুত তার কথার মোড় পরিবর্তন করেন। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা এবং সেইসঙ্গে গত জুন মাসে ক্রেমলিনের সঙ্গে প্রিগোশিনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব্ব ঐ দ্বিতীয় সারির থ্রিলার কাহিনির পাতা থেকে ছিঁড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। রাশিয়ার মস্কোতে যখন প্রিগোশিনের সৈন্যরা চুপিসারে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল, তখন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল প্রকাশ করে যে, প্রিগোশিনের গ্যাংস্টার টাইপের বাসভবন থেকে তার কয়েকটা পাসপোর্ট এবং ছদ্মবেশ ধারণের বিভিন্ন উপকরণ পাওয়া গেছে।এটা প্রিগোশিনের জন্য অবাস্তব কিছু না। কারণ, ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য তিনি যখন তার কুখ্যাত ‘ট্রোল ফার্ম’ চালিয়েছিলেন, তখন তিনি নিজের মৃত্যুর নাটক করে বিশ্বকে বোকা বানিয়েছিলেন। রাশিয়ার তদন্ত সংস্থা প্রকাশ করেছে যে, প্রিগোশিন তার সঙ্গে সব সময় অন্তত একজন বডি ডাবল নিযুক্ত রাখতেন।রোমাঞ্চকর বটে, কিন্তু প্রিগোশিনের অভিনয়ের চেয়ে মোটেও বেশি নয়। ইনি সেই ব্যক্তি, যিনি নিজের সৈন্যদের ছিন্নভিন্ন লাশের ছবি পোস্ট করে ইউক্রেনে তার বাহিনীকে আরো বেশি প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলার চেষ্টা করতেন। তার এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি রাশিয়ার মিলিটারির মধ্যে নিজেকে একটা ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।রাশিয়ার শীর্ষ আইনপ্রণয়নকারী সংস্থা উক্ত বিমান বিধ্বংসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্ত শুরু করেছে। রাশিয়ান ফেডারেশনের ক্রিমিনাল কোডের আর্টিকেল ২৬৩-এর অধীনে তদন্ত চলছে।
আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশনের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত তদন্ত আশাব্যঞ্জক স্বচ্ছ ফলাফল আনতে পারবে না। কারণ, এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্ব্বীকে নিয়ে তদন্ত করছে। এখানে একটা নিরপেক্ষ তদন্ত রিপোর্টের আশা করা মানে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলকে ক্রেমলিনের বিপক্ষে বিবৃতি প্রদানের আশা করার সমান। বিমান বিধ্বংসের প্রকৃত কারণ জানা যাবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু চলমান তদন্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের দিকে ইঙ্গিত দেয় প্রিগোশিন এবং তার উচ্চপদস্থ লেফটেন্যান্ট মারা গেলে কার উদ্দেশ্য হাসিল হবে? উত্তরটা একদম সোজা। বিভিন্ন পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রথম এবং একমাত্র উত্তর হল পুতিন। পুতিনের গত দুই দশকের শাসনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—প্রিগোশিনের নেতৃত্বে ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের মাত্র দুই মাস পর বিমান দুর্ঘটনায় প্রিগোশিনের মৃত্যু।ওয়াগনারের বিদ্রোহের কয়েক দিন পরই ক্ষিপ্ত পুতিন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, তিনি এটিকে দেশদ্রোহ হিসেবে দেখছেন। যদিও সেসময় তিনি প্রিগোশিনের নাম নেননি। তিনি বলেছিলেন, ওয়াগনার রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু ক্রেমলিন থেকে ওয়াগনারের বিপক্ষে সঙ্গে সঙ্গেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর নির্দেশে তারা বিদ্রোহ করেছিল—এমন বিবৃতি দিয়ে ওয়াগনার বাহিনী প্রতিবেশী দেশ বেলারুশে স্থানান্তর করে। তখনো প্রিগোশিন ওয়াগনারের প্রধান হিসেবে নিজের নাম প্রকাশ করেননি। পরবর্তী সময়ে সেইন্ট পিটার্সবার্গে তিনি ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, যদিও তিনি জানতেন আশপাশে তার শত্রু অভাব নেই। যদি সত্যিই এমব্রার জেট ধ্বংসের পেছনে রাশিয়ার হাত থাকে, তাহলে এটা বলা যায় যে, রাশিয়া একটা সংকটময় সময়ের মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছে, যেমনটা ইতিপূর্বে কিছু পর্যবেক্ষক ওয়াগনার বিদ্রোহের সময় পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। রাশিয়াতে সংকটময় মুহূর্ত সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকের এমন একটা সময়কে ইঙ্গিত করে, যখন রাশিয়ায় অনাচার, অনিয়ম এবং সহিংসতার ধারাবাহিকতার একটি সংকট বিরাজমান ছিল।কিছুটা হলেও এই বিমান বিধ্বংসের ঘটনা ১৯৯০-এর রাশিয়ার বিশৃঙ্খল এবং সহিংস বাজার অর্থনীতি রূপান্তরকরণের সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়, যে সময়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড পত্রিকার নিত্যদিনের শিরোনাম ছিল।পুতিনের অধীনে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা একধরনের অসুস্থ চলমান রসিকতায় পরিণত হয়েছে, যেখানে পুতিনবিরোধী ব্যক্তিরা হরহামেশা সহিংসতা, অপহরণ অথবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এটাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিরক্ষা বলা যায়? রাশিয়ার বর্তমান রাজনীতিতে হাই-প্রোফাইল কেসগুলোতে রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।রাশিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক আরটেম বোরোভিক মস্কোর সেরেমেতিয়েভো বিমানবন্দর থেকে কিয়েভের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলে মধ্যপথে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এটা ২০০০ সালের ঘটনা। এরপর ২০০২ সালে রাশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট এবং আঞ্চলিক গভর্নর জেনারেল আলেকজান্ডার লেবভদ একটি হেলিকপটার দুর্ঘটনায় মারা যান। রাশিয়ার রাজনীতিতে একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে কৌশলে অপসারণ করে দেওয়া হয়।তাই অপরাধের দায়ের ব্যাপারে প্রশ্নটা থাকে : ‘ওয়াগনার প্রধান প্রিগোশিনের মৃত্যু থেকে কে লাভবান হচ্ছে’? অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনেও এ প্রশ্ন উদয় হবে।রাশিয়ায় ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহের পর ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের উপলব্ধিমূলক গবেষণাপত্রে ভান্দা ফেল্বাব ব্রাউন উল্লেখ করেছেন যে, প্রিগোশিনের কিছু কর্মকাণ্ডকে কার্যকরভাবে পুনর্গঠন করা, অথবা ঐ সব কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণ নতুন একটা ব্যবস্থাপনার অধীনে নেওয়া ক্রেমলিনের জন্য বেশ কার্যকর হবে। তিনি আরো বলেন, ওয়াগনার গ্রুপকে আফ্রিকা, অথবা মিডল ইস্টে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করার চেয়ে রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের মাধ্যমে ওয়াগনার বাহিনীকে দুর্বল করা ক্রেমলিনের জন্য বেশি সুবিধাজনক হবে।এই ধরনের পুনর্গঠন রাশিয়ানদের জন্য মঙ্গলজনক হবে, যদি তারা আরেকটা বিদ্রোহ এড়াতে চায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ক্রেমলিন সেই পথে হাঁটবে কি না? সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করলে ক্রেমলিনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি প্রিগোশিনের আসলেই মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে নতুন প্রিগোশিনের উত্থান ঘটবে নতুন নেতার রূপে।
লেখক :ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মস্কো প্রতিনিধি
সিএনএন থেকে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct