জনদরদি মানুষ গৌর সাহা
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
সারা বিশ্বের সাথে বাংলার সমাজের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। এখানে যে পার্থক্যটা দেখব, সেটা অতিশয় প্রকট শহরাঞ্চল, বিশেষত কলকাতা শহরতলী এবং তার আশেপাশের শহরগুলোতে। এখানে কিছু বিশেষ ফর্মুলায় সমাজে জনদরদী তথা জনপ্রিয় হিসাবে পরিচিত থাকা যায়। এখানে স্থানীয় ক্লাব যদি কারুর পাশে থাকে, তখন তার সামাজিক পরিস্থিতি ও পরিচিতি যথেষ্ট অনুকূলে থাকে। কিন্তু এইভাবে পরিচিত মানুষটির আসল বা ভেতরের রূপটা অনেকেরই নজরে আসেনা। এইরকম এলাকার একটি স্টেশনারী দোকান। স্টেশনারী দোকান হলেও এখানে প্যাকেট করা তরল(লিকুইড ) দুধও পাওয়া যায়। শহূরে বাবুরা নিজে বা চাকর পাঠিয়ে ভোরবেলা এখান থেকে দুধ নিয়ে যান। দোকানের মালিক গৌর সাহা একজন জনদরদী মানুষ বলে পরিচিত। এলাকায় তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। এর জন্য অবশ্যই কিছু কারণ আছে। তাঁর দোকানের কাছের “নবযুগ” ক্লাবের যুবকদের তিনি ফুটবল এবং ক্যারাম কিনে দিয়েছেন। সেবার ক্লাবের ছেলেরা রক্তদান শিবির করেছিল। তাতে রক্তদাতাদের খাওয়াবার জন্য ক্লাবকে তিনি বিনামূল্যে ৩০ প্যাকেট দুধ এবং ৬০ টা ডিম দান করেছিলেন। এলাকায় তাই তিনি জনদরদী মানুষ বলেই পরিচিত ছিলেন। রক্তদান শিবিরের পাশে একটি মঞ্চ বানানো হয়েছিল। সেখানে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তব্য রাখলেন। তাঁদের কেউ কেউ উচ্চ মুখে গৌরের প্রশংসা করলেন। যেমন একজন বললেন, “ গৌর সাহার মত মহৎ হৃদয় মানুষেরা আছেন বলেই আজও মানবতা বেঁচে আছে। অন্যের জন্য এইসব মানুষের মন কাঁদে, তাই জন্যই রক্তদানের মত মানুষের সেবামূলক কাজে এইভাবে একটি ক্লাবকে তিনি এতটা সাহায্য করতে পেরেছেন “।
৪৪ বছর বয়স্কা শেফালী বেরা ওই অঞ্চলের কয়েকটা বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করত। দুনিয়াতে তার নিজের লোক বলতে ছিল রোগা চেহারার এবং দেখতে বোকা,বোকা ১৮ বছরের একমাত্র ছেলে সোনু। ওদের নিজস্ব কোনও বাড়ি ছিলনা। বস্তির একটা ছোট ঘরে তারা ভাড়া থাকত। সোনু, গৌর সাহার দোকানে কাজ করত।সকাল সকাল দোকানে গিয়ে, বাবুদের দুধ দেওয়ার কাজটা সোনুই করত। সেবার সোনুর গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়ল। কাজের চাপে চিকিৎসার দেরী হয়ে যাওয়ায় সেটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে গিয়েছিল। যাই হোক, দেরী করেও তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল এবং অপারেশন করে তার পাথর বের করা হল। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর ছুটি পেয়ে, কোনও এক সোমবার সোনু বাড়ি এলো।সব সময়ই এই ধরণের বড় অপারেশনের পর টানা বিশ্রামের দরকার হয়।সোনুর বেলায়ও ডাক্তাররা তাকে একটানা ১০ দিনের সম্পূর্ণ বিশ্রামের কথা লিখে দিয়েছিলেন।কিন্তু কেবল মঙ্গল,বুধ এবং বৃহস্পতি মাত্র ৩ দিন বিশ্রাম নিয়ে শুক্রবারই সে দোকানের কাজে জয়েন করে গেল। শেফালীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে সে জানালো যে গৌর তাকে ফোনে ধমকেছেন, যেন তাড়াতাড়ি সে কাজে জয়েন করে, অন্তত সকালবেলায় এসে দুধ বিলির ব্যাপারটা সামাল দিয়ে যায়।গৌরের মতে ওটা খুব একটা ভারী কাজ নয়। সোনুদের বাড়ি থেকে গৌরের দোকানটা ছিল প্রায় ১ কি.মি. দূরে। ছেলের আর কয়েকদিন বিশ্রামের জন্য শেফালী অনুরোধ করতে গেলে গৌর তাকে বলেছিলেন, “ওকে তুমি কোলে শুইয়ে রেখে সারা জীবন খেতে দাও “। গৌর কোনও বিরল চরিত্র নন, আমাদের সমাজে এইরকম আরও অনেক গৌর আছেন, যাঁরা স্থানীয় ক্লাবের ছেলেদের খেলার জন্য ফুটবল, ক্যারাম ইত্যাদি কিনে দিয়ে তাদের উৎসাহিত করেন। পাশাপাশি ওই ক্লাব সদস্যের উদ্যোগে হওয়া রক্তদান, বস্ত্রদান ইত্যাদি সামাজিক তথা সেবামূলক কর্মকান্ডে আর্থিক সাহায্যও দিয়ে থাকেন। ফলত, তাঁদের পরিচয় হয় একজন জনদরদী ব্যক্তিত্ব হিসাবে। এলাকায় তাঁরা থাকেন জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁদের আসল রূপটা ক’জন দেখতে পায় ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct