বিবর্ণ গোধূলি
মুহাম্মদ সেলিম রেজা
১- মাঘ মাসের এক শিশির ধোয়া সকাল। চা-জলখাবার খেয়ে ছাদে বসে সূর্যের তাত নিচ্ছিল সুরফুল সেখ। ক’দিন থেকে তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। থেকে থেকে জ্বর আসছে, শরীর ঝিমঝিম করছে। মোড়ের ফার্ম্মেসী থেকে ট্যালেট কিনে এনে খেয়েছে। ঔষধ দেবার সময় দোকানদার ছেলেটা বলেছিল তিনদিন ট্যাবলেট খাবার পরও যদি জ্বর না ছাড়ে তাহলে ব্লাড টেস্ট করাতে হবে। আজ তিনদিন পূর্ণ হল সে জ্বরাক্রান্ত। তবে কী এবার সত্যি সত্যি ব্লাড টেস্ট করাতে হবে? নাকি বড় কোন ডাক্তারের পরামর্শ নেবে? বসে বসে এইসব কথায় ভাবছিল সে। এমনসময় চারচাকার একখানা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। বিদ্যুৎদপ্তরের অফিসাররা এখন মাঝে মাঝেই গ্রামে হানা দিচ্ছে। গেল হপ্তায় হুকিং করে পাম্প চালোনোর অপরাধে তিনজনকে মোটা টাকা ফাইন করেছে। সুরফুল ভাবল তারাই হয়তো এসেছে। যদিও তার ভয় নেই, বৈধ কানেকশন আছে তাদের। তাহলে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল কেন? কৌতুহলী হয়ে ছাদের কিনারায় গিয়ে দেখল সে যা ভেবেছিল তা নয়, গাড়ি করে ছোটভাই আসরাফুল এসেছে।তিন বছর পরে বাড়ি এল আসরাফুল। কিছুটা অভিমান, কিছুটা বিতৃষ্ণা মিলেমিশে অজানা একটা অনুভূতি খেলে গেল সুরফুলের শিরদাঁড়া বেয়ে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এসে ভাইয়ের মুখোমুখি হল, কেমন আছিস? - ভালো। ছোট করে উত্তর দিয়ে আসরাফুল জানতে চাইল, ফুফা আসেননি? তাঁকে আসতে বলেছিলাম।সুরফুল কিছু বলার আগে তার ছেলেমেয়েরা ‘ছোটআব্বা এসেছে, ছোটআব্বা এসেছে’ চিৎকার দিতে দিতে এসে হৈ চৈ ফেলে দিল। আসরাফুল বিরক্ত হয়ে বলল, এই তোরা চিল্লাস নাতো। যা এখান থেকে।বাচ্চাদের পিছন পিছন তাদের মাও এসেছিল দেখা করতে। দেওরের বিতৃষ্ণ ভাব তার চোখ ধরা পরে যায়। কিছুটা বিস্মিত হয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে আসু ভাই? কোন বিপদাপদ?- না ভাবী তেমন কোন ব্যাপার নয়। তোমরা এখন এস। বড়ভাইয়ের সাথে আমার জরুরী কথা আছে।
২- ফুফা এলে আলোচনা শুরু হল। সব শুনে তিনি বললেন, আসু তোমার মেলা রোজগার। এই জমিটুকুর ভাগ না নিলেই পার। এমনতর কথা শুনে আসরাফুল অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, তা বল্লেতো হবে না। আমিও বাপের ছেলে, বাপের সম্পত্তিতে আমারও সমান অধিকার আছে। নুরুজ্জামান মিয়া, অবসরপ্রাপ্ত ইসিএল কর্মী। সম্পর্কে তাদের ফুফা। বাপ মারা যাবার পর ছেলেরা তাঁকেই মুরুবি মানে। আসরাফুলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আবারও বললেন, তোমার জন্য সুরু অনেক করেছে। ও দরাজ হাতে খরচ না করলে তোমার লেখাপড়া হত না। তোমার উপর তারও কিছু দাবী আছে নাকি?আসরাফুল কোন উত্তর করল না। মিয়া বলতে থাকলেন, বসতবাড়ি বাদে তিনবিঘা চাষজমি আর মাঠের একটি পুকুরের কিছু অংশ তোমার বাপের নামে আছে। এটুকুর ভাগ না নিলেই কী তোমার একেবারেই চলছে না?- মাত্র তিনবিঘা! বলছেন কী ফুফা?- তবে নাতো কী? সুরু দলিল বার কর দেখি? সুরফুল একটি প্লাসটিকের ফাইল ফুফার হাতে তুলে দিল। তিনি সেটা আসরাফুলের হাতে দিয়ে বললেন, নিজের চোখেই দেখে নাও কত সম্পত্তি আছে তোমাদের।কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখে আসরাফুল ভুরু কুঞ্চিত করে বলল , সাঁকোভাঙার মাঠে ছত্রিশ কাটার একটা প্লট ছিল। সেটার কাগজ দেখছি নাতো?- ওই জমিটা বিক্রি হয়ে গেছে ভাই। বলল সুরফুল।- কে বিক্রি করল? বিক্রি করার আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল না? ফাইলসহ কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসরাফুল আরও বলল, তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি বড়ভাই। পাকা রাস্তা লাগোয়া জমি, অনেক দাম তার। সমান সমান না হোক কিছু টাকা অন্তত আমাকে দিতে পারতে। ভাই দোষারোপ করছে শুনে সুরফুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, ওই জমিটা আমি বেচেছি ঠিকই। কিন্তু.... কথা শেষ করতে পারল না সে। একদলা আক্ষেপ অন্তঃস্তল মথিত করে উঠে এসে কন্ঠ চেপে ধরল।
৩- মনিরুদ্দিন সেখের দুনিয়াবি শিক্ষা ছিল না, কুরআন পাঠ করতে পারতেন। শুধু পাঠ করতেন, অর্থ বুঝতেন না। হুজুররাই বা ক’জন অর্থ বুঝে কুরআন পড়েন? মসজিদে ইমামতি করছেন, মিলাদ মহফিল-জলসায় লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের কাছে দশটি আরবি শব্দের অর্থ জানতে চাইলে ছ’জায়গায় হোচট খান। সেখানে মনিরুদ্দিন আটপৌরে সংসারি মানুষ, তাঁর কাছে কতটুকুই বা আশা করা যায়? ধর্মকর্ম বলতে তাঁদের মতো মানুষের কাছে হুজুরদের মুখে কথায় সম্বল।দুনিয়াবি শিক্ষার কোন মূল্য নেই। মেয়েদের ড্যাং ড্যাং করে স্কুলে যাওয়া হারাম। হুজুরদের মুখে এইসব কথা শুনে পরকালে পতিত হবার ভয়ে মেয়েদের স্কুলের ধারে কাছে ঘেঁষতে দেননি। বারো-তের বছর বসয় অতিক্রম করার আগেই জমি জায়গা বেচে তাদের শ্বশুরবাড়ির পথ দেখিয়েছেন।ছেলে আলেম তৈরী হলে বাপ-মায়ের জান্নাত লাভের পথ প্রশস্ত হয়, এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে বড়ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন। অকৃজ্ঞ ছেলে বাপের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে মাস ছয়েক বাদে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি ফিরে এসে বলেছিল, মাদ্রাসায় পড়ব না। এতিমের মতো লোকের দুয়ারে খেতে যেতে ভাল্লাগে না। বাড়ি বাড়ি চাঁদা চাইতে যেতে লজ্জা করে।কথা শুনে বাপ মারমুখী হয়ে উঠলে সুরফুল আরও বলেছিল, কী হবে আলেম হয়ে? সেইতো লোকের দয়ার উপর বাঁচতে হবে। তার চেয়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ অনেক সম্মানের।শেষপর্যন্ত রাজমিস্ত্রীর পেশাকেই আপন করে নিয়েছিল সুরফুল। গাঁ-ঘর ছেড়ে পাড়ি দেয় মুম্বাই। সেখানে কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে ঠকে দুনিয়াবী শিক্ষার মূল্য উপলব্ধি করে সে। তার জেদেই আসরাফুলকে স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হন বাপ। ছেলেটি মেধাবী, কোন পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি। আশি শতাংশ নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছিল, উচ্চমাধ্যমিকে জেলার টপার। তারপর সর্বভারতীয় নিট পরীক্ষায় সাফল্য, ডাক্তারি লাইনে পদার্পণ।
৪- মনিরুদ্দিন সেখের দুই ছেলে, তিন মেয়ে। সুরফুল সবার বড়, মাঝে তিন মেয়ে। আসরাফুল ছোট। বিঘা আটেক জমি চাষবাদ করার পাশাপাশি গরুর পাইকারি করতেন। মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে আগেই তিনবিঘা জমি হাত ছাড়া হয়েছে। বাকি থাকে পাঁচ বিঘা। তার থেকে যে রোজগার হয় তা দিয়ে কোনরকমে সংসার প্রতিপালন করা যায়, লেখাপড়ার বিলাসিতা করা যায় না। আসরাফুলকে আর পড়াতে পারবেন না, জবাব দিয়েছিলেন তিনি। হাল ছাড়েনি সুরফুল। রাতদিন পরিশ্রম করে ছোটভাইয়ের পড়ার খরচ জুগিয়েছে। ভাই মেডিকেলে চান্স পেল ততদিনে বাপ ইন্তেকাল করেছেন। ভর্তির টাকা কো’থেকে জোগাড় হবে ভেবে কুলকিনারা না পেয়ে ফুফার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল সে। সেদিন মিয়া বলেছিলেন, আমি তোমাকে বাধা দিব না সুরু। কিন্তু জমি বেচার আগে আসুর সাথে একবার কথা বলে নিও, পরে যাতে জমিজায়গা ভাগবন্টন করতে গিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব না হয়। জমি বেচার কথা শুনে পাছে ডাক্তারি পড়ায় না করে, এই আশংকায় ভাইকে কিছুই জানায়নি সুরফুল। সাঁকোভাঙা মাঠের ছত্রিশ কাঠার প্লটটি বেচে ভর্তির টাকা তিন লাখ টাকা ভরেছিল। তারপরের লড়াই ছিল আরও কঠিন। রোজগার বাড়াতে দু’-তিন শিফট কাজ করেছে। সংসার খরচ কাটছাঁট করেছে। চাওয়ার আগেই ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে টাকা ভরে দিয়েছে। সে এক চরম সময় গিয়েছে। সংসার আর চলতে চায় না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এক কাপড়ে বছর কাটাতে হয় স্বামী-স্ত্রীকে। পালপরবে ছেলেমেয়ের নতুন পোষাক হয় না। খালিদাবানু হাপিয়ে উঠে একদিন বলেছিল, একবার নিজের সংসারের কথা ভাব। পেটের পোকাগুলোকে মানুষ করতে হবে নাকি?সেদিন সুরফুল স্ত্রীকে বলেছিল, আর ক’টা দিন সবুর কর খালিদা। আসু ডাক্তার হলে আমাদের আর কোন অভাব থাকবে না।আসরাফুল ডাক্তার হয়েছে। নাম করা প্রসূতি বিশেষজ্ঞ। সরকারি চাকরি পাশাপাশি পাঁচ-ছ’টা নার্সিংহোমের সাথে জড়িত। প্রথমদিকে শত ব্যস্ততার মাঝে সময় বার করে গ্রামের বাড়িতে আসত। টাকা দিয়ে সংসারে সাহায্য করত। ঈদে ভাই-ভাবী, ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসত। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে করেছে আসরাফুল। ভালোবাসার বিয়ে। ভিনজাতের শহুরে পরিবেশে লালিতপালিত মেয়ে। গ্রামীণ পরিবেশে মানিয়ে চলতে পারবে না ভেবে তাকে কোনদিন বাড়িতে নিয়ে আসেনি। ধীরে ধীরে আসরাফুলেল আসা-যাওয়া কমে এল। সুরফুল মাঝে মাঝে ভাইয়ের বাসায় যায়। ঘরের করা সরু চাল, শাক-সবজি, পুকুরের টাটকা মাছ ইত্যাদি দিয়ে আসে। সম্পর্ক হল এমন একটি বন্ধন উভয়পক্ষ সক্রিয় না হলে তা টিকিয়ে রাখা যায় না। একসময় সুরফুল উপলব্ধি করে একহাতে তালি বাজানোর অপচেষ্টা করছে সে। ভাই বউ তার আসা-যাওয়া পছন্দ করে না। ভাইও আর আগের মতো আগ্রহ দেখায় না। বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেও যাতায়াত বন্ধ করে দেয়।
৫- দ্যাটস ফ্রড ইন ফ্যাক্ট। আমি আদালতে যাব। আসরাফুলের কথা শুনে নুরুজ্জামান মিয়া তির্যক হেসে বললেন, শিক্ষিত হয়েছ মানুষ হওনি আসু। কার বিরুদ্ধে তুমি মামলা করবে, যে ছেলেটা তোমার জন্য নিজেকে নিংড়ে দিয়ে ছোবড়ায় পরিনত হয়েছে তার বিরুদ্ধে? বাহারে দুনিয়া বাহা! যার জন্য চুরি করলাম সেই বলে তুমি চোর। থামলেন মিয়া। দম নিয়ে পুনরায় বলতে থাকলেন, সুরু এখন আর তেমন খাটাখাটনি করতে পারে না। এদিকে মেয়েরা বড় হচ্ছে, তাদের বিয়ে দিতে হবে। এই অবস্থায় তুমি তার পাশে না দাঁড়িয়ে সম্পত্তির অংশ দাবি করছ? - তাহলে বলছেন বাপের সম্পত্তির ভাগ পাব না আমি?- তুমি দাবী ছাড়বে না তখন আর কী করা যাবে। যে টুকু অবশিষ্ট আছে দু’ভাইয়ে ভাগ করে নাও। খালিদাবানু ঘরের চৌকাঠে বসে কথোপকথন শুনছিল। সে বলল, ফুফা আমাদের চলবে কী করে?- রিযিকের মালিক আল্লাহ। তাঁর উপর ভরসা রাখ মা। বললেন নুরুজ্জামান মিয়া।৬ উকিল ঠিক করা ছিল। আসরাফুলের ফোন পেয়ে দশ মিনিটের মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে হাজির হলেন তিনি। ডিজিটাল যুগ, এখন আর দীর্ঘ সময় ধরে বসে বসে দলিল লিখতে হয় না। দাতা-গ্রহীতার নাম-ঠিকানা, দাগ-খতিয়ান, পরিমান ইত্যাদি কয়েকটি জায়গা ফাঁকা রেখে ফরম্যাট সঞ্চয় করে রাখা হয়। উকিল সাহেব উভয়পক্ষের থেকে জেনে নিয়ে শূন্যস্থান ভরাট করে দিয়ে কাজ সারেন।আসরাফুলের দলিলে পরিমানের ফাঁকা জায়গা ভরাট করা হল সেইভাবে, পুকুরের তিন আনার অংশের অর্ধেক দেড় আনা এবং জমি বিঘা তেত্রিশ শতক হিসাবে নিরানব্বই শতকের অর্ধেক সাড়ে ঊনপঞ্চাশ শতক, তার সাথে বসতবাড়ির মূল্য বাবদ আরও তিন শতক যোগ হয়ে মোট সাড়ে বাহান্ন শতক। ৭ পরের মঙ্গলবার রেজিস্ট্রির দিন নির্দিষ্ট করে উকিল সাহেব বেরিয়ে গেলেন। ফুফা আগেই চলে গিয়েছিলেন জামাতে জোহরের সালাত আদায় করার জন্য। আসরাফুল উঠতে গেলে খালিদা বলল, ভাই দু’টো ভাত খেয়ে যাও। তোমার জন্য মোরগের গোস্ত রেঁধেছি। আসরাফুল হ্যাঁ-না কিছুই বলতে পারল না। মুহূর্তের জন্য ভাবীর দিকে তাকাল। অতঃপর চোখ নামিয়ে নিয়ে হনহন করে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct