উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার (ন্যাটো) নেতৃবৃন্দ সম্প্রতি লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে একটি বড় শীর্ষ সম্মেলনে একত্রিত হয়েছিলেন। অবশ্য এই সম্মেলনের মূল ফোকাস ছিল ইউক্রেন। ইউক্রেনের ব্যাপারে সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে একটি নতুন ন্যাটো ইউক্রেন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। লিখেছেন লুক কফি।
উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার (ন্যাটো) নেতৃবৃন্দ সম্প্রতি লিথুয়ানিয়ার ভিলনিয়াসে একটি বড় শীর্ষ সম্মেলনে একত্রিত হয়েছিলেন। অবশ্য এই সম্মেলনের মূল ফোকাস ছিল ইউক্রেন। ইউক্রেনের ব্যাপারে সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে একটি নতুন ন্যাটো ইউক্রেন কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে।
ন্যাটো জোট আরো সম্মত হয়েছে যে, ইউক্রেন এক দিন ক্লাবে যোগ দেবে। অনেকের হতাশার কারণে অবশ্য তাৎক্ষণিক আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ ইস্যু করা যায়নি। তুর্কিয়ের ভূমিকা সত্তেও শীর্ষ সম্মেলনের একটি দিক যেভাবে গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল তা পায়নি। প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার পর মনে হচ্ছিল, সমাবেশের সর্বত্র তিনি বিচরণ করবেন এবং সবার সাথে বৈঠকে বসবেন। তার নতুন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক টিম অবশ্য কাজ শুরু করে দিয়েছে। শীর্ষ সম্মেলনের শুরু থেকেই তিনি সঠিকভাবে পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। আর সেখানে ঘোষণা করা হয় যে, তুর্কিয়ে সুইডেনের ন্যাটোতে প্রবেশকে চূড়ান্তভাবে সমর্থন দেবে। হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পর থেকে এই বারই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার তুর্কি প্রতিপক্ষ এরদোগানের সাথে প্রথম বৈঠকে মিলিত হন। এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, বৈঠকের আগে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা হিমশীতল ছিল। আশা করা যায় যে, তাদের মধ্যকার বৈঠক তাদের জাতির মধ্যে উন্নত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে। তারা অবশ্যই একে অপরকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং মার্কিন-তুরস্ক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ বিষয়ে ইতিবাচক কথা বলেছেন। এমনকি এরদোগান গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার সময় তার আমেরিকান প্রতিপক্ষকে ‘আমার প্রিয় বন্ধু’ বলে বর্ণনা করেছেন। তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি বড় অগ্রগতিও হয়েছে- যখন, কয়েক মাস অনিশ্চয়তার পরে, অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-তুর্কিয়েকে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান বিক্রি করতে সম্মত হয়। শীর্ষ সম্মেলনের সময় গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিটসোটা কিসের সাথেও এরদোগান ইতিবাচক বৈঠক করেছেন। উভয়পক্ষ এই বসন্তে গ্রিসের সোলোনিকিতে তুর্কি-গ্রিস উচ্চ পর্যায়েরই সহযোগিতা পরিষদের একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করাতে সম্মত হয়েছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক কতটা উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল- তা বিবেচনা করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত ভালো একটি অগ্রগতি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উভয় দেশই ন্যাটো সদস্য হওয়ার কারণে এই বৈঠকটি সম্ভব হয়েছিল। এটা কূটনৈতিক ফ্রন্টে জোটটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা স্মরণ করিয়ে দেয়।
যখন এরদোগান তার আমেরিকান, গ্রিক ও সুইডিশ প্রতিপক্ষের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন তিনি বিনা কারণেই এই উষ্ণ সম্পৃক্ততা দ্বিমুখী রাস্তায় হবে বলে মনে করেন না।
উদাহরণস্বরূপ সুইডেন ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য তুরস্কের সমর্থনের বিনিময়ে ইইউ সদস্য পদের জন্য আলোচনা আবার শুরু হলে আঙ্কারাও সম্ভবত কিছুটা প্রতিদান আশা করে। এরদোগান ইইউর সাথে ভিসা উদারীকরণ চুক্তির ক্ষেত্রেও অগ্রগতি আশা করেন।
এরদোগান মে মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে যাবে সে ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল। এমনও উদ্বেগ ছিল যে, আঙ্কারা মস্কোর সাথে খুব উষ্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে।
এরদোগান তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার দৌড়ের আগে ফেব্রুয়ারিতে বিধ্বংসী ভূমিকম্পের কারণে একটি স্থবির অর্থনীতির নেতৃত্বে ছিলেন। ভালো হোক বা খারাপ হোক এমন সময়ে রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য এটিই ছিল তুরস্কের প্রধান প্রণোদনা যদিও তখন পশ্চিমা দেশগুলো মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তুর্কিয়েকে ন্যাটোর একটি সদস্য দেশ হিসেবে বিবেচনা করে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে অনেকেই বিশেষভাবে সমস্যাযুক্ত হিসেবে অভিমত প্রকাশ করে। কেউ যখন বর্তমান পরিস্থিতির দিকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে তাকাবেন, তখন এটি স্পষ্ট হবে যে, আঙ্কারা মস্কোর সাথে জোটবদ্ধ নয়। আর ঐতিহাসিক কারণে তুরস্ক কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান উপভোগ করে। এর অর্থ হলো, তুর্কিয়ে এবং রাশিয়া হলো অনেক সময় ধরে এই অঞ্চলের প্রতিদ্বদ্বী এবং কখনো কখনো প্রতিপক্ষ ছিল। কিছু হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, দেশ দু’টি ১৫০০ এর দশক থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১২টি বড় যুদ্ধ করেছে।
ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতি আঙ্কারা এবং মস্কোর মধ্যকার বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার একটি ভালো উদাহরণ। এমনকি তুর্কিয়ে কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে ঘোষণা না দিলেও তুর্কিয়ে যে, ইউক্রেনকে বেশ কিছু অস্ত্র সিস্টেম সরবরাহ করেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সশস্ত্র ড্রোন, লেজার গাইডেড মালটিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম, কয়েক ডজন সাঁজোয়া যান এবং স্বচালিত আর্টিলারি সিস্টেম। এটাও জানা গেছে, তুর্কিয়ে গত বছর ইউক্রেনকে গুচ্ছ যুদ্ধাস্ত্র দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও ওই ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করতে চূড়ান্তভাবে সম্মত হওয়ার কয়েক মাস আগে তুরস্ক এসব অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এ ছাড়াও তুর্কিয়ে ইউক্রেনের জন্য দু’টি করভেট তৈরি করছে এবং ইউক্রেনের নির্মিত ইঞ্জিনগুলো তুর্কিয়ে ড্রোনের সর্বশেষ প্রজন্মে ব্যবহার করা হবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার বড় ধরনের আগ্রাসনের পর দ্রুত তুর্কিয়ে বিদেশী যুদ্ধ জাহাজের সাথে ভূমধ্যসাগরে কৃষ্ণসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী জলপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এটা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে রাশিয়ার স্বার্থকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এগুলোকে ‘একটি রুশপন্থী’ সরকারের নীতি বলাটা দুর্বোধ্য। এই নীতিগুলো কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে কোনো দেশের বিশেষ এবং ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে তীব্র সচেতনতারই পরিচায়ক। তা সত্তেও তুর্কিয়ে নিজেকে একমাত্র আন্তর্জাতিক অভিনেতা হিসেবে দেখায় যে যুদ্ধে লিপ্ত উভয়পক্ষের সাথে কথা বলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ইউক্রেনের শস্য রফতানির ব্যাপারে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হলো তুর্কিয়ে। তুর্কিয়ে কিয়েভ এবং মস্কোর মধ্যে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বন্দিবিনিময় করেছে এবং তুর্কিয়েই হলো একমাত্র দেশ যে শত্রুতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেন ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একই আলোচনার টেবিলে বসাতে সক্ষম হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটি এরদোগানের শেষ মেয়াদ। তিনি তুর্কিয়ে প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসের অংশ হিসেবে একটি দীর্ঘ মেয়াদি উত্তরাধিকার তৈরি করতে এটা যে, তার শেষ সুযোগ সে ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। ন্যাটো সম্মেলনের পর তিনি আন্তর্জাতিক বিষয়ে শুভ সূচনা করেছেন। তিনি ন্যাটোতে সুইডেনের প্রবেশের ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে সবুজসঙ্কেত দেয়ায় এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে প্রবেশের প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন দানের কারণে পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছেন। এমনকি জার্মানির একটি বড় সংবাদপত্র তাকে ‘সুপারম্যান’ হিসেবে বর্ণনা করে লিখেছে যে, ‘তাকে ছাড়া কিছুই করে না।’ জার্মান একটি সংবাদপত্র থেকে এই প্রশংসা এসেছে- যেটা সাধারণত এরদোগানের তীব্র সমালোচনা করে থাকে, এটি সত্যিই উচ্চ প্রশংসা। এই শীর্ষ সম্মেলনটি তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুরস্কের কূটনীতির ঊর্ধ্বগতির একটি স্পষ্ট উদাহরণ। এরদোগানের চূড়ান্ত মেয়াদে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুরস্কের আরো বেশি কূটনীতি আশা করা হচ্ছে।
লেখক : হাডসন ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো, আরব নিউজ থেকে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct