জানা যাচ্ছে যে ইউক্রেনীয় সেনারা নিপার নদী অতিক্রম করেছেন এবং পূর্ব তীরে একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর চলমান গ্রীষ্মকালীন পাল্টা আক্রমণ অভিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। তবে কতজন সেনা নিপার নদী পার হয়েছেন আর সেনাঘাঁটিতে কতজন অবস্থান করছেন, সেটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করে জানা যায়নি। লিখেছেন ভেরোনিকা পনিস্কজাকোভা।
জানা যাচ্ছে যে ইউক্রেনীয় সেনারা নিপার নদী অতিক্রম করেছেন এবং পূর্ব তীরে একটি ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর চলমান গ্রীষ্মকালীন পাল্টা আক্রমণ অভিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। তবে কতজন সেনা নিপার নদী পার হয়েছেন আর সেনাঘাঁটিতে কতজন অবস্থান করছেন, সেটা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার করে জানা যায়নি।ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন পাল্টা আক্রমণ নিয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর আগে শরৎকালীন পাল্টা আক্রমণের মতো সফলতা এতে দেখা যায়নি। এই বিবেচনায় নিপার নদী পেরিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করতে পারা নিঃসন্দেহে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বড় অর্জন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে তারা যে সাফল্য পাচ্ছে, কিয়েভের ওপর সেটা প্রমাণ করার চাপ রয়েছে। কেননা, পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকেই তারা বেশির ভাগ অস্ত্র পায়।গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের অভিযানের তুলনায় এবারে ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ ধীরগতির হওয়ার পেছনে কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। জুন মাসে কাখোভকা বাঁধ ধ্বংসের কারণে যে বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যায় প্লাবিত হয়, তাতে নিপার নদী অভিমুখে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা থমকে যায়। এ ছাড়া নিপার নদীর ওপর অবস্থিত সেতু ধ্বংস হওয়ায় সেনা ও সাঁজোয়া যান নিয়ে আসাটা অনেক বেশি কঠিন হয়েছে।ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা ধীরে হলেও ধারাবাহিকতা রয়েছে। প্রতিদিনই খবর আসছে, যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ বাহিনী যেসব এলাকা দখল করে নিয়েছিল, সেখান থেকে গ্রামের পর গ্রাম ধারাবাহিকভাবে পুনর্দখলে নিচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। কিন্তু আজভ সাগর অভিমুখে রুশ বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে ইউক্রেনীয় বাহিনীর যে দ্রুতগতির অভিযাত্রা পরিচালনা করার কথা ছিল, সেটা কার্যকর হয়নি। ফলে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা এখনো বাস্তবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে না।ইউক্রেন সংঘাতের ইতিহাসের দিকে যদি ফিরে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে, নিপার নদী কতটা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবহন, জ্বালানি কিংবা খাদ্য, যা-ই হোক না কেন, ইউক্রেনের মানুষের জীবনের অনেক ক্ষেত্রে নিপার নদীর অবদান বিশাল। যুদ্ধ শুরুর আগে নিপার নদী ইউক্রেনের মানুষের মাছের চাহিদার অর্ধেকটার জোগান দিত।ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর নিপার নদী কৌশলগতভাবে কেন্দ্রীয় গুরুত্বে চলে এসেছে। যুদ্ধের শুরুতেই রুশরা এর কৌশলগত গুরুত্ব বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে ইউক্রেনকে যদি বিভক্ত ও জয় করতে হয়, তাহলে নিপার নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। কেননা, এই নদী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করে।২০২২ সালের শরৎকালের পাল্টা আক্রমণের সময় নিপার নদীর পূর্ব ও দক্ষিণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রাশিয়ার কাছ থেকে পুনর্দখলে নিয়েছিল ইউক্রেন। নিপারের পশ্চিম তীর থেকে তারা রুশদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নিপারের পূর্ব তীরে এখন পর্যন্ত আধিপত্য করছে রাশিয়া। এ কারণেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর নিপার নদী পেরোনোর খবর এতটা তাৎপর্যপূর্ণ।কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনীর এই সাফল্যকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানাতে হবে। এর আগেও ইউক্রেনীয় বাহিনী নিপার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু রুশ বাহিনী ইউক্রেনীয়দের সেখান থেকে হটিয়ে দিয়েছিল।কিন্তু এবারে নিপার নদীর পূর্ব তীরে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সফল হতে পারে, সেই আশা রয়েছে। ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে ১৪ আগস্ট যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী নিপার নদীর পূর্ব তীরে রুশ বাহিনীর অধিকৃত এলাকা অবরোধ করেছে অথবা নতুন একটি সেনাঘাঁটি স্থাপন করেছে। এর আগে জুন মাসে ইউক্রেনীয় বাহিনী নিপার নদীর পূর্ব তীরে খেরসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল নেয়। নিপার নদীর পূর্ব তীরের এই দুটি অবস্থান ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য গেম চেঞ্জার বা দাবার ঘুঁটি উল্টে দেওয়ার মতো ব্যাপার হতে পারে। কেননা, এখান থেকে দক্ষিণ দিকে রুশ বাহিনীর অধিকৃত এলাকায় অভিযান পরিচালনা তারা করতে পারবে।
পরবর্তী ধাপ
যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাবে, তা কয়েকটি ঘটনার ওপর নির্ভর করছে। খবরে জানা যাচ্ছে, রুশ বাহিনী নিপার নদীর পূর্ব তীর ও খেরসনের গুরুত্বপূর্ণ শহর রক্ষার জন্য সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে।বাখমুত অঞ্চলেও ভীষণ যুদ্ধ হচ্ছে। গত এক বছরের যুদ্ধে সেখানে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছেন। দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকেও প্রতিদিন খবর আসছে সেখানে রুশ বাহিনী ও ইউক্রেনীয় বাহিনী একেকটা এলাকা পাল্টাপাল্টি দখল করছে।ইউক্রেনীয় বাহিনী কমপক্ষে আরও তিনটি সেক্টরে জোরালোভাবে যুদ্ধ করছে। সেগুলো হলো উত্তর-পূর্ব দোনেৎস্ক, পশ্চিম জাপোরিঝঝিয়া ও লুহানস্কে প্রবেশের রাস্তা।এতগুলো ফ্রন্টে একসঙ্গে যুদ্ধ চলায় রাশিয়ার সমর পরিকল্পনাবিদেরা কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। নিপার নদীর পূর্ব তীরে, নাকি যুদ্ধ ফ্রন্টে সেনা ও সামরিক শক্তি কেন্দ্রীভূত করবে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।নিপার নদীর পূর্ব তীরে খেরসন অঞ্চলে ইউক্রেন যদি বড় সাফল্য পায়, তাহলে ক্রিমিয়া অভিমুখে তাদের অভিযাত্রা অনেক সহজ হয়ে উঠবে। এরই মধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে পশ্চিম জাপোরিঝঝিয়ায় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর ইউরোঝাইন পুনর্দখলে নিয়েছে ইউক্রেন। এর ফলে আজভ সাগর অভিমুখে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।কিন্তু ইউক্রেনীয়দের পাল্টা আক্রমণ নিয়ে বিপরীত চিত্রও আছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে যে ‘দীর্ঘ প্রত্যাশিত ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ কিছু ছোট গ্রাম পুনর্দখলে নেওয়ার মতো ফল নিয়ে আসছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে যুদ্ধের গতি বাড়ানো কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে।’সুতরাং, পাল্টা আক্রমণ অভিযান থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী ধীরগতির হলেও ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা অর্জন করলেও তাদের সাফল্য চূড়ান্ত অর্থে নির্ভর করছে পশ্চিমা মিত্রদের সামরিক ও আর্থিক সমর্থনের ওপর।কিন্তু ইউক্রেনকে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে, এ রকম কয়েকটি দেশে এরই মধ্যে যুদ্ধজনিত ক্লান্তি ভর করেছে। উদাহরণ হিসেবে স্লোভাকিয়ার কথা বলা যায়। জরিপে দেখা যাচ্ছে, আগামী মাসে হতে যাওয়া নির্বাচনে ক্রেমলিনপন্থী প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন। ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা প্রত্যাহার ও রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এই দুই অ্যাজেন্ডা নিয়ে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন।
ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর মধ্যেও যেন এই প্রবণতা গেঁড়ে বসতে না পারে, সেই প্রার্থনা এখন ইউক্রেনকে করতে হবে।
ভেরোনিকা পনিস্কজাকোভা যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র টিচিং ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct