বিচ্ছেদ
সামসুন নিহার
পুজোর ছুটি এলেই আমার মন উদাস হয় আজও। মনে পড়ে বহুকাল পূর্বে হারিয়ে যাওয়া আমার শহুরে বিদ্যালয়ের প্রথম সদাহাস্য সেই বন্ধুটির কথা। পুজোর ছুটিতেই তাকে হারিয়েছিলাম কী না! মফস্বলের বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্যই আমাদের মফস্বলবাসী হতে আসা। বিদ্যালয় ও সেখানের দিদিমণিদের দেখে বিস্ময়ও কম ছিল না। আমি যেন এক অপরিচিত ভিন্ন জগতে এসে পড়েছি। এখানের সহপাঠীরা কত মার্জিত। তাদের কথা বলার ধরন ও চালচলন একেবারে অন্য জগতের মনে হত আমার। পোষ্টমাস্টারের কথা ভাবুন। কলকতা থেকে গ্রামে এসে তার যে অবস্থা হয়েছিল আমার গ্রাম থেকে মফস্বলে এসে সেই অবস্থা হল। এখানে এসে আমি প্রথম জানলাম মা-চাচিদের মত মহিলারা বিদ্যালয়ের দিদিমণি হন। তাদের ‘দি’ বলে ডাকতে হয়। ক্লাসে নাম ডাকার সময় উপস্থিত বলা যায় না। প্রেজেন্টপ্লিজ বা প্রেজেন্টম্যম বলতে হয়। না হলে হাসির খোরাক হতে হয়। আড়চোখে বাকিরা তাকায় আর হাসাহাসি করে। সহপাঠীদের গল্পের আসরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই তারা চুপ করে যেত। বুঝলাম মফস্বলের মার্জিত বন্ধুদের দলে আমি বড় বেমানান। নতুন বিদ্যালয়ে ভর্তির আনন্দ বিষন্নতায় পরিণত হতে সময় লেগেছিল কয়েক দিন মাত্র। প্রথম প্রথম না বুঝলেও ধীরে ধীরে বুঝলাম আমাকে ওরা এড়িয়ে যায়। মনের কোণে বিষন্নতার মেঘ জমলেও সকলের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। বুঝলাম বহুর মধ্যে থেকেও আমি বড় একা। এসবের মধ্যেই একমুঠো শীতল হাওয়া নিয়ে এসেছিল সেই বড় বড় টানাটানা মায়াবী চোখ ও ববকাট চুলের অধিকারী সদাহাস্যজ্বল সেই বালিকা। বাবার বদলির চাকরি বলে বেশ দেরিতে সে ক্লাসে এসেছিল। পুজোর ছুটির ঠিক মাস খানেক আগে। প্রথম দিনই সে এসে বসেছিল একেবারে আমার পাশে। শ্যামবর্ণের সেই বালিকাটির সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল তার মুখের অনবদ্য অনাবিল হাসি আর তার হৃদয়ের সৌন্দর্য। একমুখ হাসি নিয়ে জানতে চাইল আমার নাম। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে উঠল, আমি অস্মিতা রায়। তার কথার স্নিগ্ধতা ও আন্তরিকতায় আমি অবাক হয়ে ছিলাম। মনে ভাবলাম এমনও হয়! সহপাঠীদের উন্নাসিক ভাব ও আচরণের জন্য আমি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম। একটা হীনমন্যতা আমাকে গ্রাস করছিল। তাই অস্মিতার সহজ সরল আন্তরিক ব্যবহারের সত্ত্বেও তার সঙ্গে অনায়াসে মেলামেশার ব্যাপারে সহজ হতে আমার একটু সময় লাগল। প্রথম প্রথম কিছুতেই ওর সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মিশতে পারি নি। ভয় হত পাছে অপদস্ত হতে হয়!
তবে অস্মিতার আন্তরিক ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের আবেগ আমার মনের আবেগকেও ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলেছিল। কীভাবে আমাদের সম্পর্কটা সহপাঠী থেকে সখীতে উত্তীর্ণ সেটাকে ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত শব্দ আমার ভাণ্ডারে নেই। সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত বিদ্যালয়ের বাগানে। সেখানে সে আমাকে অনেক নতুন নতুন ফুল ও ফলের গাছ চিনতে শিখিয়েছিল। একসময় আমরা একে অপরের টিফিনের অংশীদার হয়ে উঠলাম। চালের আটার রুটি, ডিমের হালুয়া ও চানার ডালের হালুয়া খেয়ে অস্মিতার চোখে মুখে সে কী আনন্দ ও তৃপ্তি। আমার মনটা খুশিতে উথলে উঠেছিল তার চোখমুখে সেই অভিব্যক্তি দেখে। আন্তরিকতার সঙ্গে আবেগ মিশিয়ে মুখে হাসি খেলিয়ে চোখ কপালে তুলে জানতে চাইল, কাকিমা খুব ভাল রান্না করেন তাই না রে? আমাকে নিয়ে যাবি তোদের বাড়ি? ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম কবে যাবি বল? বুকের ভেতরটায় এক ভালোলাগার এক অচেনা আবেগে জারিত হয়েছিল। যদিও সেই অবকাশ তার হয় নি। আমাদের এই সহজ সরল সম্পর্কটা আমাদের মফস্বলি সহপাঠীরা সহজ ভাবে নিতে পারেনি। তাই তারা অস্মিতার সঙ্গেও ভাল ব্যবহার করত না। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া অস্মিতাকেও কখনও দেখি নি ওদের সঙ্গে ভাব জমানোর কোন চেষ্টা করতে। ওদের কোন কথা বা আচরণকে ও পাত্তাই দিত না। ও নিজের খেয়ালে নিজের মত নিজের জগতে আমাকে নিয়ে গল্প জমাত। বাগানে ঘুরে বেড়াত। ওর সাহচর্যে এসে আমিও আস্তে আস্তে বিদ্যালয় জীবনের সকল হীনমন্যতা ও একাকিত্ব কাটিয়ে জীবনের স্বাভাবিক গতি ফিরে পেয়েছিলাম। উচ্ছ্বসিত আমি রোজ বিদ্যালয়ে আসার একটা গভীর টান অনুভব করতাম। গ্রামীণ জীবনের গণ্ডীর বাইরে এসে সেই প্রথম বন্ধুত্বের স্বাদ অনুভব করতে শিখলাম। বড় মায়াতে বেঁধে ছিল অস্মি আমায়। শিউলি ফুটে ওঠার মধ্যে দিয়ে শরতের আগমন ধ্বনিত হল। বিদ্যালয়ের বাগানে পড়ে থাকা শিউলি হাতে তুলে ও বলে উঠল, বাহ্ শিউলি ফুটতে শুরু করেছে। সেইদিন আমি কমলা বোঁটাওয়ালা ওই ছোট্ট সাদা ফুলটির নাম জেনেছিলাম।
দিন কয়েক পরে সে জানাল পুজো উপলক্ষে সে চারটি পোশাক পেয়েছে স্বজনদের কাছ থেকে। সেই পোশাকগুলোর বর্ণনা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জানাল কোনটা কোন দিন পড়বে। পুজোর ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাচ্ছে সেটাও জানাল। এসব কথা বলার সময় তার আহ্লাদে তার মুখে ছড়িয়ে পড়ত উজ্জ্বলতা। হাসিতে লাগত মায়াবী সুর। ওর মুখের সব কথাই আমার শুনতে খুব ভাল লাগত। কী সোহাগ মাখিয়ে বলে ও সব কথা। জান জুড়িয়ে যায়। তাই নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করে আমার মন তৃপ্ত হত। মহালয়া ঘোষণা করল আর দেরি নেই। দুর্গা এল বলে। শুরু হল অস্মির দিন গোনার পালা। চারপাশে পুজো পুজো গন্ধ ভাসায় ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে দিদিমণিদের মধ্যেও কেমন একটা আলুথালু ভাব দেখা গেল। এরইমধ্যে একদিন বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের বাইরে বাংলা দিদিমণির পড়ানোর সময় দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন ঘন্টাদিদিমণি। যিনি প্রার্থনা শুরুর ঘন্টা বাজিয়ে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন সূচনা ও সমাপ্তির ইঙ্গিত দেন। পড়নে আটপৌরে ইঞ্চি পাড়ের সাদা শাড়ি। হাতে মোটা সবুজ রঙের মলিন খাতা। ভিতরে আসার অনুমতি পেয়ে, এসে খাতাটি টেবিলে রাখলেন। দিদিমণি পড়ানো থামিয়ে চিহ্নিত পাতাটি খুলে পুজোর ছুটির বিজ্ঞপ্তি ছাত্রীদের পড়ে শোনালেন। হইহই বর উঠল ক্লাসে। দিদিমণি সকলকে থামিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। ঘন্টার ধ্বনি জানান দিল পাঠ দানের সময়ের অবসান ঘটেছে। দিদিমণি বেড়িয়ে যেতেই আনন্দের হুল্লোড় শুরু হল। বাড়ি যাবার সময় অস্মি জানিয়েছিল, এই ক্লাসে এই মফস্বলে আমি তার প্রথম বন্ধু। ছুটিতে সে আমাকে খুব মিস করবে। পরের দিন ক্লাস বিরতির সময় জানাল ছুটিতে ওরা প্রথম নিজের শহরে যাবে। সেখানে বাড়ির পুজো হয়। পুজো শেষ হলে দক্ষিণভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাবে। ছুটির পরে আবার আমদের দেখা হবে। পুজোর ছুটিতে আমিও গেলাম মামার বাড়ি, গ্রামের বাড়ি। সেখানে গিয়ে ফেলা আসা বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে মজা করে ছুটি কাটিয়ে ফিরে এলাম। গ্রামের বন্ধুদের জানতে ভুলি নি অস্মিতার কথা। তবে অন্য সহপাঠীদের আচরণের কথা সযত্নে গোপন করে গেলাম। যথা সময়ে বিদ্যালয় খুললে খুব উৎসাহ নিয়ে গেলাম বিদ্যালয়ে। কতদিন পরে দেখা হবে অস্মিতার সঙ্গে! একে অপরকে দেখে সে কী আহ্লাদ। আহা! অস্মি তার গল্পের ঝুলি উজার করল ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে। আবারও জমে উঠল আমাদের আলাপচারিতার মজলিস। দিন কয়েক পরে সবকিছু কেমন গোলমেলে হয়ে গেল। একদিন ও এসে জানল ওরা এখান থেকে চলে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ে সে আর বেশিদিন আসবে না। পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে। বিদ্যালয়ের প্রধান দিদিমণির সঙ্গে ওর বাবার সব কথা হয়ে গেছে। কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি কেমন হারিয়ে গেলাম। মনে হল যেন স্বপ্ন দেখছি। অস্মি জড়িয়ে ধরতে বুঝলাম স্বপ্ন নয়। বিশ্বাস করতে বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল মনে। ও আরও কীসব বলে যাচ্ছিল আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না। শূন্য মন নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরলাম। পরপর দুই দিন বিদ্যালয়ে গেলাম না শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে। দুই দিন পরে গিয়ে ওর দেখা পেলাম না। তারপর দিনও না। পরে সহপাঠীদের একজনের কাছ থেকে জানতে পারি, যে-দুটি দিন আমি আসি নি সেই দুটি দিন ও এসেছিল কেবল আমাকে দেখা করার জন্য। এক অব্যক্ত কষ্টে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। নিজের প্রতি খুব রাগ হল। নিজেকে নিজেই এই বলে সান্ত্বনা দিলাম যে, যাক এখন দেখা হল না তো কী আছে। ফাইলান পরীক্ষা দিতে তো আসবে, তখন দেখা হবে। কিন্তু হায়! বার্ষিক পরীক্ষাও তো সে দিতে এল না!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct