পানবিবি কালাচাঁদ ও হাবু
হেদায়েতুল্লাহ
সে উত্তর এখানে এসে পেয়ে যায় শুকুর। সাইকেলের ক্যারিয়ারের পেছনে বসে সব কথা খুলে বলেছে মিনু। আজকে পালানোর কারণও তাই। মামা তার সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দিতে চায় নিজের লাভের আশায়। পাশের চাঁদপুর গাঁয়ের সোলেমান বদ্দির সাথে ষড় করেছে। শুকুর হাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলে,তাকে তো চিনি! তার বৌ প্যারালিসিসে ভুগচে। সেজন্যে আবার বিয়ে করতে চায়। মিনু নিচু গলায় বলে। শুকুর বলে,সে তো বুজলুম কিন্তু আমার জবাব তো পেলুম না। চঞ্চলবাবু এতক্ষণ শ্রোতার ভূমিকায় ছিলেন। এবার বলেন,কী জবাব,শুকুর সাহেব?আপনি দু’জন হাবিলদার পাঠান। তার ইঙ্গিত ধরতে অসুবিধে হয় না মেজোবাবুর। কোকিলপুরে মোটর বাইক নিয়ে ছোটে দুজন সেপাই। মোমিন থানায় এসে তড়পাতে শুরু করে,দেকচ শুকুর ভাই!দুধ-ভাত দে কালসাপ পুষেচি। রাতদুপুরে আমাকে থানায় টেনে এনেচে। সেতো বুজেচি কিন্তু তুমি আমাদের পঞ্চায়েত সিদ্ধান্তটা ভেঙে দিলে কেন?মোমিন একটু থমকে যায়। তারপর বলে,তা তোমাকে তো বলেচি। কিন্তু সবটা তো খুলে বলোনি। তার মানে?সোলেমান বদ্দির যে তোমার ভাগ্নির চেয়ে বড়ো বড়ো দুটো ছেলেমেয়ে রয়েচে। তাতে কী?মোমিন মরিয়া হয়ে বলে,তার ইঁটভাঁটা আছে। বাজারে রেশানের দোকান। মেয়েটার মত নিয়েচ?তার আবার মত কী? খেয়ে পরে বাঁচবে। তা ঠিক!তুমিও বাঁচলে! কী—কী—বলতি চাইচ,শুকুর ভাই? তার গলা যেন কেঁপে যায়। যা বলতি চাইচি তা না বোঝার মতো বোকা তুমি না। মোমিন কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকাই বোধহয় তার কাছে বু্দ্ধিমানের কাজ। শুকুর কিন্তু শেষ করে না। বলে,তোমাকে চিনতে বাকি নেই। মরা বোনের বিয়েতে যা খরচ করেচ তা এবার সুদে আসলে তুলে নেবে তাইতো?চঞ্চলবাবু টেবিলে ঘুঁষি মেরে বলেন,বাড়ি থেকে তুলে এনেছি। সত্যি কথা বলো নইলে হাজতে ভরে দোব। সোলেমান জোড় হাত করে বলে,হুজুর!আমি সুগারের রুগী। বাইরে যাব। বলতে বলতে সে বাইরে ছুটে বেরিয়ে আঁধারে গা ঢাকা দেয়। আপদ বিদেয় হয়েছে। এবার চঞ্চলবাবু আর শুকুর আলি ওদের দিকে নজর ফেরালেন। দেশের আইনকানুন সব কড়া হচ্ছে। সাবালক হলে জোর করে কিছু চাপানো যাবে না। চঞ্চলবাবু হাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন,এবার তোর বিপদটা বল! সে তো,স্যার,আপনারা সমাধান করে দিলেন। শুকুর আলি এবার গম্ভীর গলায় বলে,হাবু তোকে একটা মুচেলেকা দিতি হবে। কেন,চাচাজি? ভয়ে ভয়ে বলে সে। জীবনে কোনদিন নেশা করবিনে। সেতো কবেই ছেড়ে দিয়েছি। লিখে দিতি আর আপত্তি কি! উচ্ছেবিবির খুব পছন্দ হয়েছে। অন্য বৌদের মতো না। মা মরা মেয়েটা তার ভারি ন্যাওটা। নিজের মায়ের মতো তাকে যত্নঅ্যাত্তি করে। সে আর বকবক করে না। নিশ্চিন্ত মনে ধর্মকর্ম করে। হাবু এখন মুখ লুকিয়ে চলে না। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে যায়। ফরিদকে সে ভোলেনি। তাকে মাইনে পেয়ে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিয়েছে। কালোবিবির হাতের মুড়ো ঝাঁটা নিশপিশ করে। কিন্তু মোমিন তাকে বুঝিয়েছে,সেবার বেঁচে ফিরেছে। এবার বেচাল দেখলে হাজতবাস কেউ ঠেকাতে পারবে না। লতুর বৌ রেখা আর সতুর বৌ চন্দনা হিংসায় ফেটে পড়ে। তারপর একটা কান্না গলার কাছে দলা পাকায়। তাদের বিয়ের সময় বাপ ভাইয়ের কী অবস্থা! ধার দেনা জমি বন্দক। আর এই উটকো মেয়েমানুষটা এসেই শাশুড়ির মাথা চিবিয়েছে। নাম করতে ঘেন্না হয়। কী আছে তার? না বাপ দিল একটা টাকা,না মামা দিল। সতু আর লতু বলে বেড়ায়,হাবু সেরকমই বোকা রয়ে গেল। এভাবে কেউ বে করে?হাবু সকালে বেরোয় রাতে ফেরে। মালিক মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছে। ওভার টাইমও দেয়। রাতটুকু বাড়ি থাকে। এসব কথা তার কানে যায় না। কিন্তু মিনু শুনতে পায়। বলব না বলব না করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আজ হাবু একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সে বলে,ভাসুরেরা কী বলে জানো?কী?বিয়ে করে তুমি নাকি ঠকে গেচ?ছোটবেলায় তুমি যখন মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি আসতে তখন কী বলে ক্ষেপাতুম?মনে পড়চে। চোখ দুটো সজল হয়ে ওঠে। কাঁদচ নাকি?পুরোনো কথা মনে করালে মায়ের মুখ যেন ভেসে ওঠে। হাবু চুপ করে যায়। মিনুর বাঁদিকের কপালে একটা সবুজ রঙের জোতুক—ঠিক পান পাতার মতো। ছোটবেলার ভালো লাগা যে সফল হবে কোনদিন ভাবেনি। সে বলে,বিয়েতে আবার ঠকা জেতা কি? ভালোবাসার কোন দরদাম হয় নাকি?সত্যি বলচ? চোখ মুছে বলে মিনু। একটা আপশোস রয়ে গেল। কী? দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করে মিনু। কালাচাঁদকে যৌতুক হিসেবে পেলে মন্দ হত না। কী যে বল!তার পিঠে গুম করে কিল বসিয়ে দেয় মিনু। হাবু তাকে জড়িয়ে ধরে পানপাতার ওপর চুমু খায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct