মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মানুসারী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাব আর মিলে মিশে থাকার ঐতিহ্য বহমান ছিল। আজও তা বহুলাংশে বহাল রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণির ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা এই মানবীয় পরিবেশকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলেও তা কখনও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনকালে শৈব ও বৌদ্ধ জন গোষ্ঠীর অবস্থানও ছিল সাধারণত স্বাভাবিক। সেই শহরের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ইতিহাস বেত্তা খাজিম আহমেদ।
১৯৩৭ সালে কম্যুনিস্ট লীগ-এর উদ্যোগে বেলডাঙ্গায় ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সমাজের প্রগতিশীল ব্যক্তি এবং কংগ্রেসের কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এই সম্মেলনের সাফল্যে অংশ নিয়েছিলেন। যদিও দক্ষিণপন্থী অংশ এই সম্মেলনের বিরুদ্ধাচারণ করেন। হাজার হাজার গরীব নিঃস্ব হিন্দু মুসলমান কৃষক এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে অশেষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির স্থাপন করে। কংগ্রেসের শশাংক শেখর সান্যাল, মৌলভী আব্দুস সামাদ, রাধাপদ প্রামাণিক এবং ছত্রপতি রায় সমাবেশের সাফল্যের জন্য যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। এই কৃষক সমাবেশের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন জাতীয়তাবাদী মুসলিম যুবনেতা মোহাম্মেদ খুদা বখশ। খুদা বখশ পরবর্তীকালে এমএলএ এবং এমপি-ও নির্বাচিত হন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। অসাধারণ এই কৃষক সমাবেশে ৭টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। দুটি প্রস্তাব সাম্প্রদায়িক সমঝোতার পক্ষে খুবই জরুরি ছিল। (১) সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হচ্ছে বিটিশ সরকার প্রবর্তিত ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর সৃষ্টি। একে বাতিল কর। (২) হিন্দু-মুসলিম কৃষক মূলত একই গোত্রের, তাঁরা চাষি। ধর্ম এখানে বিবেচ্য নয়। ১৯৩৮ সালে কান্দিতে ‘কম্যুনিস্ট লীগ’-এর নেতৃত্ব দ্বিতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন শৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শশাংক শেখর সান্যাল এবং খান বাহাদুর এক্রামুল হক। উক্ত সালের অক্টোবর মাসে সাটুইতে বিশাল সমাবেশে অজস্র হিন্দু মুসলিম কৃষক এবং ক্ষেতকর্মী জমায়েত হয়েছিলেন। তাদের সামনে বক্তব্য রেখেছিলেন খানবাহাদুর এক্রামুল হক (প্রাক্তন এমএলসি), সাতকড়ি চ্যাটার্জী এবং বামনদাস মুখার্জী। হিন্দু-মুসলিম কৃষকবর্গের এই যুগ্ম জমায়েত সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতৃবর্গের প্ররোচনা সত্ত্বেও ১৯৩০-১৯৪৭ সময়কালে মুর্শিদাবাদ জেলায় বড় রকমের কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। এই কৃতিত্বের সিংহভাগ নবাব ওয়াসিফ আলি মীর্জার প্রাপ্য। তাঁর পুত্র প্রিন্স কাজেম আলি মীর্জার ঘোরতর বাধা সত্ত্বেও তিনি তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে এক বিন্দুও পেছনে সরেননি। তিনি দেশভাগের বিরোধী ছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলা পাকিস্তানের কবজা থেকে বের করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপোষহীন যোদ্ধা। সে লড়াই-এ নবাব ওয়াসিফ সফল হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে ‘অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগ’-এর প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুরে। খোদ মহম্মদ আলি জিন্নাহ মুর্শিদাবাদের মুসলমানদের মনে রাজনৈতিক উচ্চাশার বীজ পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলেন। এমনতরো পরিস্থিতিতে নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার ভূমিকা ছিল অবর্ণনীয় ভাবে প্রশংসার যোগ্য। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর ও নিরলস লড়াই ছিল তাঁর জীবনের মহৎ কৃত্য বিষয়। ১৯৩৭ সালে নবাব বাহাদুর ওয়াসিফ আলি মীর্জা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি অ্যাসোসিয়েশন’। স্মরণযোগ্য বিষয় তাঁর উদ্যোগে হাজারদুয়ারী এবং ইমামবাড়ার মধ্যবর্তী বিশাল প্রাঙ্গণে হিন্দু মুসলিম ঐক্য সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। প্রায় দশ হাজার হিন্দু-মুসলিম জনতা হাজির ছিলেন এই সভায়। এই জমায়েত অসাধারণ ঐতিহসিক তাৎপর্য বহন করেছে। এই জনসমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন শৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, তুলসী গোস্বামী এবং অধ্যাপক হুমায়ুন কবীরের মতো দার্শনিক-রাজনীতিবেত্তা ৷ রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহ (জিয়াগঞ্জ) ছিলেন এই মহতী জনসভার অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক। ১৯৩৮ সালে নবাব প্যালেসে আবার হিন্দু-মুসলিম নেতৃবর্গ জমায়েত হন সম্প্রীতির সূত্র সন্ধানের জন্য। ১৯৪১-এর ডিসেম্বরে ‘শেরে বঙ্গাল’ জনাব ফজলুল হকের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠিত হলে নবাব ওয়াসিফ আলি মীর্জা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪২ সালে তাঁরই উদ্যোগে আবার কলকাতায় হিন্দু মুসলিম ঐক্য সম্মেলন আহূত হয়। তিনিই সভাপতিত্ব করেছিলেন। ফজলুল হক শান্তি ও সহ-অবস্থানের বিষয়টিতেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায়। এই সম্মেলনে বক্তব্য পেশ করেছিলেন ড. নলিনাক্ষ সান্যাল, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, এ. কে. এম. জাকারিয়া, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, সৈয়দ নওশের আলী, সামসুদ্দিন আহমদ এবং অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর। সভাপতির ভাষণে নবাব মীর্জা বলেন, সত্যিকার ভারতীয় তিনি যার স্বদেশের প্রতি গভীর প্রেম রয়েছে। ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত, অক্সফোর্ডের ছাত্র নবাব ওয়াসিফ আলি মীর্জার জন্ম ১৮৭৫ সালে। জীবনাবসান ১৯৫৯ সালে । তিনি ছিলেন নবাবী জমানার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সংহতিচর্চার শেষতম উজ্জ্বল প্রতিনিধি।১০
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠী নানবিধ বিভেদাত্মক নীতি প্রয়োগ করে দেশীয় বিভিন্ন ধর্মানুসারী মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস আর ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করে। এই ধরনের একটি রাজনৈতিক কূটচাল ছিল মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনী পদ্ধতি চালু করা (১৯৩২)। এমন পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদ জেলার সুসন্তান আব্দুস সামাদ (১৮৬১-১৯৪৫) কংগ্রেস বিধায়ক হিসেবে বিধান পরিষদে এই নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করেন। শানিত যুক্তির মারফত এই পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার অসারতা, অখণ্ড বাংলার জনতার সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা, অর্থাৎ মুসলমানরা কেবলমাত্র মুসলমানকেই ভোট দেবে এবং হিন্দুরা হিন্দুদের, এই ব্যবস্থা কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না। তা যে কোনও দায়িত্বশীল সরকারের নীতি বিরুদ্ধ এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী। ওই নীতি উভয় সম্প্রদায়কে আত্মকেন্দ্রিক ও সংকীর্ণ দুটি শিবিরে ভাগ করে দেবে। তার ফলে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর কল্যাণের কথা চিন্তা করবে না কখনই। পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে মুসলমান ভোট প্রার্থীকে তার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সবচেয়ে আগে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি একজন মুসলমান তারপর ভারতীয়। সেইরূপ হিন্দু ভোট প্রার্থীকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি আগে হিন্দু তারপরে ভারতীয়, অর্থাৎ ভোটারদের কাছে যত বেশি করে হিন্দু অথবা মুসলমান বলে জাহির করতে পারবেন ততই তাঁর জয়ের সন্তাবনা। এর মারাত্মক ফল অবশ্যম্ভাবী। এই নীতির ফলেই দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিচ্ছে।’ মুর্শিদাবাদ জেলা সভার সহ সভাপতি হিসেবে দীর্ঘ দশ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছিলেন যে হিন্দুদের সহযোগিতার ফলে মুসলমানরা উপকৃত হয়েছেন। জেলা সভার হিন্দু সভাপতি ও সদস্যবর্গের ন্যায় বিচার আর উদার দৃষ্টিভঙ্গী মুসলমানদের উপকৃত করেছে। এ ধরনের উপকার এর আগে পায়নি। পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার চেয়েও তিনি প্রত্যাশা করেছেন হিন্দুদের সহযোগিতা, অনগ্রসর মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার, নারীশিক্ষা, মুসলিম নারীর মুক্তি। মনে করিয়ে দিয়েছেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর চিয়ারত বাণী: দোলনা থেকে কবরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত জ্ঞানের অনুসন্ধান করো। প্রয়োজনে সুদুর চীনদেশ পর্যন্ত যাও। নারী ও পুরুষের জন্য জ্ঞানার্জন ‘ফরজ’ (অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ লক্ষ্য করা গেছে, মুসলমানদের তথাকথিত বন্ধুরা মোল্লাদের ভয়ে মহানবীর নির্দেশকে অমান্য করেছে। মৌলভী সামাদ আক্ষেপের সুরে বলছেন, ‘God save the muslim from their so called freinds’. ভ্রান্ত পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাতিলের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি মুসলমানদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন গণভোটের মাধ্যমে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা গ্রহণ বা বাতিল করতে। এই চ্যালেঞ্জ সোহরাওয়ার্দী মোকাবিলা করতে সাহস পাননি। বঙ্গীয় বিধান পরিষদে আব্দুস সামাদের উত্থাপিত বেসরকারি বিল ৪৭-৩২ ভোটে বাতিল হয়ে যায়। কৃতী আইনজীবী, সফল বিধায়ক, বহরমপুর বার আসোসিয়েশনের সভাপতি, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীর দেশপ্রেমী মানুষটির মৃত্যু হয়েছিল দেশবিভাগের দুবছর আগেই। ১১ মৌলভী আব্দুস সামাদ উত্তরসূরী রেজাউল করীম “সাম্পদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার সংগামে অগ্রচারী সৈনিক ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের নিরলস ব্রতচারী।” বস্তুত তাঁর জীবনদর্শন ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রেজাউল করীম ইসলামের অনুসারী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। মুসলিম সমাজের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাকে তীব্র আক্রমণে বিদ্ধ করলেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁর যুক্তিবাদী মনন দ্বারা চালিত হয়ে একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। এই সুবাদেই তিনি আমাদের কাছে অনন্যসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে বরেণ্য হয়ে উঠেছেন। অধ্যাপক করীম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক। ভারতের জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আদ্যন্ত ভারতীয়। ১৯৩০ সালের পর থেকে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বিরামহীন লড়াই চালিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতা দাঙ্গার সময়ে ধর্মান্ধ মুসলিমদের দ্বারা তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন । স্বদেশপ্রেম এবং জাতীয়তার প্রশ্নে তিনি মওলানা মোহাম্মদ আলীর জীবনের একটি তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন ৷ মোহাম্মদ আলী বলতেন, ‘Where India is concerned, where India’s freedom is concerned, where the welfare of India is concerned, am an Indian first, and Indian second, and Indian last, and nothing but an Indian’. রেজাউল করীমও ছিলেন যথার্থ অর্থেই ভারতীয়। তাঁর বহু লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর এই বাণী ‘হুবুল ওয়াতান মিনাল ইমান’ অর্থাৎ ‘দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। দেশপ্রেমহীন একজন ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান হওয়ার যোগ্যতা হারান। রেজাউল করীম ধর্ম দ্বারা জাতিত্ব নির্ণয় বা ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চাননি। স্বাভাবতই ড. মোহাম্মদ ইকবাল আর মোহাম্মাদ আলী জিন্নার রাজনৈতিক মতাদর্শের সমলোচক ছিলেন তিনি। ভারতীয় মহাজাতিত্বের মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিকাশ সম্ভব‑ এমন তত্ত্বে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল। এর প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছে তাঁর রচিত ‘সাধক দারা শিকোহ’ নামক গ্রন্থে। তাঁর জীবনের কোন কোন ঘটনাকে উল্লেখ করে বিগত শতাব্দীর তিন ও চারের দশকের রক্ষণশীলবর্গ তাকে অমুসলমান এবং ধর্ম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে নানা কুৎসা ও অপপ্রচার চালালেও তিনি ছিলেন অকুতোভয়। প্রচার চালানো হয়েছিল যে রেজাউল করীমের চিন্তাধারার অর্থ হল হিন্দু সংস্কৃতির কাছে মুসলিম সংস্কৃতির আত্মসমর্পণ, কিন্তু এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী কোনোভাবেই তাকে তাঁর জীবন দর্শন থেকে দূরে ঠেলে দিতে সমর্থ হয়নি। শাশ্বত মানবতা আর যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত প্রবাহে যারা ভেসে চলেছে তাদের বিরুদ্ধেই তিনি কলম ধরেছেন নিঃশঙ্ক চিত্তে । তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘নয়া ভারতের ভিত্তি’-র ভূমিকায় লিখেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যা আলোচনার সময় সাধারণতঃ দেখা যায়, হিন্দুদের কার্যকে মুসলমান এবং মুসলমানের কার্যকে হিন্দু তীব্র ও কঠোরভাবে নিন্দা করিয়া থাকেন। আমি এই প্রথার বিরোধী । কারণ তাহাতে অনেক সময় নিরপেক্ষ ও প্রকৃত সমালোচনার ব্যাঘাত হয়। এ বিষয়ে আমার নিজের মত এই যে, যদি কোন সম্প্রদায়ের কার্ষপদ্ধতির প্রতিবাদ বা সমালোচনা করিবার প্রয়োজন হয়, তাহা সেই সম্প্রদায়ের লোকের দ্বারাই হওয়া উচিত। তাহাতে আলোচনাটি অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ হইবার সম্ভাবনা অধিক।’ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিলনের দ্বারা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও তিনি দেখেছিলেন। এই সুবাদেই তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন দারাশিকোহ এবং সংস্কৃতি সমন্বয়ের অগ্রদূত আলবেরুণী। কোরআনের কয়েকটি বাণীর প্রতি তিনি ছিলেন অশেষ শ্রদ্ধাশীল। ‘লা ইকরাহা ফিদ-দীন---ধর্মে বল প্রয়োগ নেই’ বা ‘কানান নাসা উম্মাতান ওয়াহিদাতান---সমগ্র মানবজাতি এক সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল।’ এই বাণীর সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন তিনি উপনিষদেও। অধ্যাপক রেজাউল করীম মনে করতেন যে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার বিপদ ভয়ানক। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা মানুষকে নিকটতর করে। “নয়া ভারতের ভিত্তি” প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “মহাপুরুষ হজরত মহম্মদ মদিনায় প্রবেশ করিয়া ইহুদী, খৃষ্টান, মুসলমান ও অপরাপর সম্প্রদায়কে লইয়া যে ‘Commonwealth of Nation’ গঠন করিলেন তাহা এই বিংশ শতাব্দীতেও বিস্ময়কর বিষয়।”
তিনি পরিষ্কার উচ্চারণ করেছেন, “কোন ব্যক্তি যে কোনও ধর্ম পালন করুক না কেন, যখন সে একটা নির্দিষ্ট প্রদেশে বাস করে, তখন সেই প্রদেশের অপরাপর সম্প্রদায়কে লইয়া সে একটি বিরাট অভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়। এই আদর্শের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হইয়া মুসলমান কি ভারতের সাধারণ কল্যাণের নিমিত্ত চেষ্টা করিবে না?” তিনি আরও লিখেছেন, “মুসলিম সমাজের যে সব স্বার্থপর বন্ধুরা মনে করেন যে হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্ত সহযোগিতা উপেক্ষা করে কেবলমাত্র পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা, পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সবকিছু পৃথক ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানদের মঙ্গল সাধন করবেন, তারা মুর্খের স্বর্গে বসবাস করছেন। তা কখনই মুসলমান সমাজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না।” সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতার নীতি একটি গোষ্ঠী বা জাতির বৌদ্ধিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক উন্নতি না ঘটিয়ে তাকে ধ্বংস বা অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয়। স্বভাবতই তিনি সমন্বয়ধর্মী একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মানসিক তাগিদ অনুভব করেছেন সারা জীবন ধরে। দেশ ভাগ তাঁকে ব্যথিত করেছিল। পুরোগামী ভাবুক চিন্তানায়ক অধ্যাপক রেজাউল করীম জাতির ঘোরতর সংকট ও সংঘাতে যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব স্বেচ্ছায় বহন করতে বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন তার পটভূমি তৈরি হয়েছিল তাঁর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে। হিন্দু এবং ইসলামাশ্রয়ী মানুষের এমন চূড়ান্ত অবিশ্বাস ও ঘৃণার মধ্যে তিনি নিজেকে, কিভাবে এই গভীরতর ঘৃণ্য প্রভাব থেকে মুক্ত রাখলেন তা বিস্ময়ের। অশোক মিত্র (আই.সি.এস.) তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ণ করেছেন এই ভাবে, ‘প্রজ্ঞা, সততা, চরিত্রবত্তা ও মানব ধর্মের প্রতীক রেজাউল করীম।’১২ সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে দেশ বিভাগের পর বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে কিয়ৎকালের জন্য উত্তেজনাময় ঘটনা ঘটলেও হিন্দু মুসলমানের সামাজিক জীবন প্রায় শান্তই ছিল। দেশ বিভাগের সংকট ভুলে এতদঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান সৎ-প্রতিবেশীর মতো বসবাস করতে থাকেন। বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রী অম্বিকাচরণ রায়ের একটি মন্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “১৯৫৭ সালে ‘ফাতেহা দোয়াজদাহম’ দিনে বহরমপুরে মুসলমান বন্ধুদের অনুষ্ঠিত হজরত মোহাম্মদের জন্মস্মরণী অনুষ্ঠানে মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করার একটা অভিনব ব্যাপার হয়েছিল। মুসলমান বন্ধুরা আমার উপর তাঁদের যে আস্থা দেখিয়েছিলেন—আমি তাদের কাছে ঋণী।”১৩ স্মর্তব্য ১৯৪৬ সালের কলকাতার মহা দাঙ্গা মুর্শিদাবাদ তথা বহরমপুরের জনজীবনকে কম্পিত করেনি। ১৯৭৭ সাল থেকে হাল আমল তক বামপন্থী রাজনীতির আগ্রাসী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালের ২৪শে জুন মুর্শিদকুলি খাঁ প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাটরা মসজিদে নামাজ পড়ার বিতর্ককে কেন্দ্র করে কাশিমবাজার অঞ্চলে যে বীভৎস গণহত্যা ঘটে তা ভয়াবহ এবং অপ্রত্যাশিত। বামফ্রন্ট সরকার ঘোষিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত আজও হিমায়িত হয়ে রয়েছে। এমন দুর্যোগের সময় বাঙালি জাতির বিবেকতুল্য অধ্যাপক রেজাউল করীম (১৯০২-৯৩) ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ওপর পুনরায় বিশ্বাস স্থাপনের আবেদন জানান। সেই ভয়ার্ত দিনগুলোতে শহর বহরমপুর থেকে প্রকাশিত ‘জনমত’ পত্রিকার সম্পাদক রাধারঞ্জন গুপ্ত, ‘মুর্শিদাবাদ বীক্ষণে’র সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী, ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক প্রাণরঞ্জন চৌধুরী এবং ‘ঝড়’ নামক পত্রিকাটি সাম্প্রদায়িক গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রখর প্রতিবাদে সোচ্চারিত হয়। সম্পূর্ণ ব্যক্তি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ আর অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুকূলে জনমত তৈরি করে। স্বভাবতই জেলাঞ্চল তথা বহরমপুর আত্মহননে মেতে ওঠেনি। প্রীতির সেই ট্রাডিশন-এরই জয় হয়। সেই লিগেসি বা উত্তরাধিকার নিয়েই আমরা একুশ শতকে হাজির হয়েছি।
তথ্যের উৎস ও পাদটীকা :
১. সৌম্যেন্দ্রকুমার গুপ্ত, পদ্মাপথের ইতিকথা, (প্রবন্ধ) বইমেলা, মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ-২০০৫, স্মরণিকা পৃ. ১৬
২. জে. এন. সরকার, ‘ওল্ড মুর্শিদাবাদ’, কৃষ্ণনাথ কলেজ সি.সি ভল্যুম, পৃ. ৩।
৩. অশোক মিত্র। বহরমপুরের বৈশিষ্ট্য ও উৎকর্ষ, (প্রবন্ধ), মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ, ৫, আগষ্ট, ১৯৯৯ .
“প্রসিদ্ধ কৃষ্ণনাথ কলেজের ইতিহাস প্রাচীনত্বে ও উৎকর্ষে কলকাতার হিন্দু কলেজের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে।” ... কলকাতা থেকে বহরমপুরের আয়তন ও জনসংখ্যা অনেক কম, অথচ বেশী সংহত হওয়ায়, আমার মনে হত অল্প পরিসরে, কলকাতা থেকে বহরমপুরের ঐতিহ্যের এশ্বর্য, ঋদ্ধি ও সংস্কৃতি মণ্ডিত মনীষীদের সংখ্যা হাজার পিছু জনসংখ্যা হারে অনেক বেশী ছিল। এখনও তার প্রমাণ পাই, মুর্শিদাবাদ তথা বহরমপুরের সন্তান বা সেই শহরে লালিত লেখক-লেখিকার রচনায়। মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকে ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতা মহানগরী বহরমপুর থেকে অনেক সুসভ্য, শিক্ষিত, মেধাবী লোক নিত্য আমদানি করে নিজেকে সমৃদ্ধ করত।”
৪ এবং ৫ গোলাম মুর্শিদ, ‘খন্ডিত বাঙালী সংস্কৃতি, (প্রবন্ধ) দৈনিক স্টেটসম্যান, শারদ উপহার, ৯ অক্টোবর, ২০০৫। সৌম্যেন্দ্র কুমার গুপ্ত, ‘বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি’ (১৭৫৭-১৯৪৭), প্রবন্ধ, জলসিঁড়ি, শারদীয়, ১৪০৩।
৬. সৌম্যেন্দ্রকুমার গুপ্ত, প্রাগুক্ত ।
৭. খাজিম আহমেদ, পীর ফকিরের আস্তানায়। হিন্দু মুসলমান মিলনভূমি, গণকণ্ঠ, মুর্শিদাবাদ সংখ্যা, বহরমপুর, ১৯৮২। মুর্শিদাবাদ : মুসলিম ভাবানুষঙ্গ পীর ফকিরের আস্তানা, মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ, ১৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭। পীরবাদ ইসলামে স্বীকৃত নয়। এতদসত্ত্বেও আওয়াজ ওঠে কেন? ‘মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও’ আদতে এটা হচ্ছে লৌকিক ইসলামের প্রকাশ। লোকাচার আর স্থানীয় প্রভাবে আসক্ত মুসলমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অজস্র ভক্ত পীর-ফকিরের আস্তানাগুলোকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক মেলা বা ‘উরস’ উৎসবে মিলিত হয়। সামাজিক পরিচয় আর সম্প্রীতির মিলনভূমি হয়ে ওঠে। সদর শহর বহরমপুর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সালার রেলওয়ে স্টেশনে পাশে হামিদহাটিতে রয়েছে শাহ আবদুল মখদুম হামিদ-এর ‘মাজার।’ বিশেষভাবে স্মর্তব্য শাহ মখদুমের ৭৫ শতাংশ ভক্ত হচ্ছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পুনাশি, মাসুন্দি, বিনোদিয়া অঞ্চলেও সুফি-সন্তের সমাধিকে কেন্দ্র করে উভয় সম্প্রদায়ের লোক মিলিত হন হৃদয়ের টানে। ছাপঘাটি-বালিয়াঘাটায় সৈয়দ মুর্তাজার মাজার অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের উদ্বেলিত করে তুলতো। বৈষ্ণব কবি ‘মুর্ত্তজানন্দ’ নামেই সমধিক পরিচিত সৈয়দ মুর্ত্তাজা। এই ‘মাজার’গুলো সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে।
৮. অমর মণ্ডল, মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র, ঝড় : বিষয় মুর্শিদাবাদ বিশেষ সংকলন ফেব্রুয়ারি ২০০৪।
৯. ব্রজভূষণ গুপ্তের জীবনকথা, ব্রজভূষণ স্মৃতি সমিতি- ১৯৫৭ খৃঃ ১৮-১৯।
১০. অমলেন্দু দে, ইসলাম ইন মর্ডান ইন্ডিয়া, পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক, পৃঃ ১৩৪-১৪৪,
১১. সৌম্যেন্দ্রকুমার গুপ্ত- বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি (১৭৫৭-১৯৪৭), প্রাগুক্ত।
১২. অশোক মিত্র, বহরমপুরের বৈশিষ্ট্য ও উৎকর্ষ, (প্রবন্ধ), মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ, ৫ আগষ্ট, ১৯৯৯।
১৩. অম্বিকাচরণ রায়, ‘আমার ষাট বছরের ওকালতি’ (১৯০৫-১৯৬৫), বহরমপুর, ১৯৬৫।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct