পানবিবি কালাচাঁদ ও হাবু
হেদায়েতুল্লাহ
ওদিকে ফরিদের হাতে চিঠি পাঠিয়েছিল হাবু। আজ ফেরার পথে দেখা করার কথা। কিন্তু হঠাৎ এক বিপদ। দোকানের মালিক হারাধনবাবু হার্ট অ্যাটাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ব্যবসার দায়দায়িত্ব সব তার। শুধু বুধবার কেন আরো কয়েকদিন ফিরতে পারেনি। এরমধ্যে বার কয়েক ফোন করেছে কিন্তু সুইচড অফ বারবার। আজকে রোববার নয় মঙ্গলবার। মালিক কাজে খুশি হয়ে ছুটি দিয়েছে। দুপুরে আবার দুজনে বসেছে। হাবু রাগ করে বলে,তুই ফোন বন্ধ রেকেচিস কেন?দোকানে সারাতে দিয়েচি। পানবিবি কী ভাবল বলতো! ফরিদ গাঁজায় এক টান দেয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,মা কালির বোধহয় কিচু সন্দেহ হয়েচে। কেন?আজকাল তাকে আমার দোকানে আর পাঠায় না। তাহলি উপায়?তাইতো ভাবচি। তারপর বলে,তুই এক কাজ কর। কী?তুই আরেকটা চিঠি লিখে দে। কিন্তু তার কাছে দিবি কী করে?সে দায়িত্ব আমার। মোড়ের মাথায় ফরিদের বড়োসড়ো মুদির দোকান। চলেও মন্দ না। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কেটে গেলেও হাবুর সাথে রয়ে গেছে। ক’দিন ধরে খুব চেষ্টা করছে। বন্ধুত্বটাকে ফিকে হতে দেবে না। কিন্তু সুবিধে করতে পারেনি। আজকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে সুযোগ মিলে গেল। তেঁতুলতলার পুকুরে নির্জন ঘাটে বসে আছে সে। দুপুরবেলা এদিক ওদিক তাকায় ফরিদ। সাইকেল থামিয়ে সে চিঠিটা টুক করে ঘাটের দিকে ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু কোন কথা বলার আগে পেছনে এক চীৎকার,কে—রে-কে—রে--!ভীষণ মারকুটে গলা। কিছু বলার অবসর নেই। প্রাণপণে সাইকেল ছুটিয়ে দেয় ফরিদ। পঞ্চায়েত মেম্বার শুকুর আলির বৈঠকখানায় বিচার সভা ডাকা হয়েছে। গাঁয়ের মোটামুটি বারো আনা লোক হাজির। হাবুকে পাওয়া যাবে তাই রোববার এই আয়োজন। শুকুর আলি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। বেশি কথা ধাতে সয় না। বলে,এ অনাচার গাঁয়ে ক্ষতি ডেকে আনবে। আমরা তা মেনে নিতি পারিনে। তারপর সতু লতুর দিকে তাকায়,তোমরা তো হাবুর গার্জেন। এখুন বলো আমরা কী করব? গাঁয়ের লোক সবাই তাদের দিকে তাকায়। দু’ভাইয়ের চোখে চোখে কী কথা হয়। সতু উঠে দাঁড়িয়ে বলে,আমরা ভেন্ন হয়ে গেচি। হাবুর দায়িত্ব নিতি পারব না। যে নিজে যা ভালো বোঝে তাই করবে। ঠিক আচে। আমরা পাঁচজনের যা ভালো মনে হয় তাই করব। লতু বলে,আমাদের কোন আপত্তি নেই। সভায় জরিমানা ধার্য করা হয় হাবুর। মোমিন মোল্লা উঠে বলে,আমি কিন্তু ভাগ্নির জন্যি এক পয়সাও খরচা করতি পারব না। কেন?শুকুর আলি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে। ওর মায়ের বিয়ের সময় সব পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দিয়েচি। তাহলি হাবু? শুকুর তার দিকে তাকায়। হাবু তো আসামির কাঠগড়ায়। তার আর বলার কী আছে?সে মাথা নিচু করে বসে আছে। দিন পনেরো কেটে গেছে। এখনো বিয়ের দিন ধার্য হয়নি। হাবু ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে। ঘরদোর সব সাফসুতরো করেছে। রঙমিস্তিরিকে বায়না দিয়েছে। উচ্ছেবিবির গজগজানি ক্ষান্ত হয়েছে। পানবিবিকে নিয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখে হাবু। এমন সময় শুকুরের বৈঠকখানার দরজায় টোকা পড়ে। কী ব্যাপার?তোমাদের মীমাংসাটা আরেকবার বিবেচনা করো,শুকুরভাই। কেন?ও আমার মেয়ের মতো। হাত পা বেঁধে পানিতি ফেলে দিতি পারিনে। হাবু তো বেকার না।তা বলি নি। তবে?সে নেশাভাং করে। কালোবিবি কখন স্বামীর পেছন পেছন বৈঠকখানায় ঢুকেছে। সে মাথায় ছোট একটা ঘোমটা টেনে বলে। মুখে বললে তো হবে না,প্রমাণ চাই। গম্ভীর গলায় বলে শুকুর আলি। আমি নিজের চোখে দেখেচি। ডোবার ধারে দুই ইয়ার বসে। বাজখাঁই বলে কালোবিবি।
ঠিক আছে দেকচি। কী করা যায়। কথা চারিদিকে বেশ রটে গেছে। তারা পেশাদার নেশাড়ু নয়। মাঝে মাঝে রঙিন স্বপ্নের জন্যে এসব। কিন্তু এসব কথা কে মানতে চায়?হাবুর মন মেজাজ ভালো না। শুকুর আলি ডেকে ভালো রকম কড়কে দিয়েছে। সাঁজেরবেলা মুখ লুকিয়ে বাড়ি ফেরে। ফরিদ আর এদিকে আসে না। তীরে এসে যেন তরী ডুবে যায়। এভাবে বোধহয় মাসখানেক কেটেছে। ট্রেন লেট থাকার জন্যে রাত করে ফিরেছে। খেয়েদেয়ে সবে শুয়েছে। মায়াবি জোছনা। কিন্তু হাবুর ঘুম আসে না। এ যেন মন খারাপ করা রাত। হঠাৎ তার দরজায় টুকটুক শব্দ। কান খাড়া করে। আবার সেই শব্দ। ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ফরিদ এলো নাকি? কোন জরুরি খবর আছে হয়তো। বেচারা তার জন্যে কতো না অপদস্ত হচ্ছে। কিন্তু দরজা খুলে চমকে ওঠে,তুমি!এত রাতে! ভয় পেলেন নাকি?সেকথা থাক! কিন্তু এভাবে?এভাবে কেন বুজতে পারেন নি? কাল যে আমার বিয়ে! জোছনার আলোয় পানবিবির দিকে তাকিয়ে সে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী উত্তর দেবে ঠিক বুঝতে পারে না। হ্যাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জলদি করুন। কী করব? যেন ঘোর কাটেনি হাবুর।এতখনে সেখানে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাবে। তুমি আমাকে জেল খাটাতে চাও? হাবু কাঁপা গলায় বলে। ভয় পেলেন? তাহলি আমাকে চলে যেতি হবে।কোথায় যাবে?নিদেনপক্ষে কালাচাঁদের দড়ি তো আচে। ওসব বাজে কথা বলো না। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্চে। ঠিক আচে। দেরি করলে মামি এসে যেতে পারে। কালোবিবির নাম শুনে বিদ্যুতের শক খায় হাবু। দূরে যেন লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এদিক ওদিক আলো দেখা যাচ্ছে। আর দেরি করে না। যা থাকে কপালে!যেখানে বাঘের ভয় সেখানে যাবে। মরিয়া হাবু সাইকেল বের করে তড়িঘড়ি। হাবু হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,স্যার!খুব বিপদে পড়েচি। থানার মেজো দারোগা চেয়ারের ওপর পা তুলে মোবাইলে গেম খেলছেন। চোর নয় ডাকাত নয় দুই ছিমছাম মূর্তিমানকে দেখে বলেন,বাড়ি থেকে পালিয়েছিস বুঝি?আজ্ঞে!আপনার কাছে এসেচি। আমাকে তো বিপদে ফেললি। কেন,স্যার? হাবু অবাক হয়। তোকে পুরতে পারি কিন্তু মেয়েদের হাজত এখানে নেই।আমাদের হাজতে পুরবেন? ককিয়ে ওঠে সে। তোদের বাড়ি কোথায়?কোকিলপুর,স্যার। শুকুর আলি সাহেব তোদের মেম্বার না?আপনি চেনেন,স্যার?মেজোবাবু কোন উত্তর দিলেন না। খেলা থামিয়ে কাকে যেন রিং করেন। এত রাতে ফোন?থানায় আসতে হবে?একটু গাঁইগুঁই করছে শুকুর আলি। কিন্তু একটা মেয়ের কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়ে। একটু আগে মোমিনমিয়া এসে ঘুরে গেছে। ভাগ্নিটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা হাবুর বাড়ি খোঁজ করেছে। ফরিদ কসম খেয়েছে। থানায় দুজনকে দেখে খুব একটা আশ্চর্য হয় নি। কিন্তু একটা কৌতূহল ছিল। লোক চরিয়ে পঞ্চায়েত মেম্বার হয়েছে। মোমিন যে খুব সুবিধের লোক না তা সে জানে। সামান্য ছুতোনাতায় সে ভাগ্নির বিয়ে ভেঙে দিতে চায়, ব্যাপারটা ঠিকমতো হজম হয় না। যেখানে দেনাপাওনার কোন নামগন্ধ নেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct