ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করার পর যুদ্ধ বন্ধে নেওয়া উদ্যোগের বয়সও কয়েক মাস পেরিয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এর ঠিক এক বছর পর চীন শান্তির জন্য ১২ দফা প্রস্তাব দেয়। এ বছরের জুন মাসে আফ্রিকার একদল নেতা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে ১০ দফা শান্তি প্রস্তাব দেয়। লিখেছেন রাজন মেনন।
ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করার পর যুদ্ধ বন্ধে নেওয়া উদ্যোগের বয়সও কয়েক মাস পেরিয়েছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। এর ঠিক এক বছর পর চীন শান্তির জন্য ১২ দফা প্রস্তাব দেয়। এ বছরের জুন মাসে আফ্রিকার একদল নেতা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে ১০ দফা শান্তি প্রস্তাব দেয়। উদ্যোগটা আসে এ মাসেই। যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে সৌদি আরব ইউক্রেনসহ ৪০টির বেশি দেশকে নিয়ে একটি পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। যদিও সেখানে রাশিয়া ছিল না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ১৮ মাস পেরিয়েছে, এ ধরনের প্রচেষ্টার কারণ বোধগম্য হয়েছে। ইউক্রেনে অনেক জায়গা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুনর্গঠনের জন্য কয়েক শ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। ১ কোটি ১০ লাখ ইউক্রেনীয় হয় অভিবাসী হয়েছেন, না হয় অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন; যা মোট জনসংখ্যার সিকি ভাগ। কমপক্ষে ২৬ হাজার বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছেন। অনেকে বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এ থেকে অনেক বেশি। আর সামরিক হতাহতের সংখ্যা চার গুণ বেশি। যুদ্ধকালে যে কেউ ইউক্রেনে গেলে তার বুঝতে অসুবিধা হবে না যে ইউক্রেনে ধ্বংসযজ্ঞের যে ব্যাপকতা, সেটা কোনো দিক থেকেই তুলনীয় নয়।শান্তি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী হওয়ার পেছনে আরও কিছু বিবেচনা কাজ করেছে। এই যুদ্ধ রাশিয়া ও ন্যাটোর যুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে বিশ্ব পারমাণবিক সংঘাতের দিকে যেতে পারে। এ ছাড়া ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানিতে অবরোধ সৃষ্টি করা হলে তাতে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। সেটা হলে বিশ্বের গরিব দেশগুলোতে ক্ষুধা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করবে। যদিও যুদ্ধ বন্ধের এসব প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কিন্তু এগুলো সাফল্যের মুখ দেখার ক্ষেত্রে এখনো পাহাড়সমান প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরু করে সহজ একটা কাজ। কিন্তু যুদ্ধের অবসান চরম কঠিন একটা ব্যাপার। অনেক সময় এ ধরনের যুদ্ধে এক পক্ষ কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়। কেননা, তারা বুঝতে পারে, যুদ্ধে জয় পাওয়া তাদের জন্য অসম্ভব। তারা বুঝতে পারে, যুদ্ধ চালিয়ে গেলে কেবল মৃত্যু ও ধ্বংসই বাড়তে থাকবে। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ছাড় দিয়েও এক পক্ষ চুক্তিতে আসে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের কেউই বিজয়ের আশা ছেড়ে দেয়নি। দুই পক্ষ এখনো ভাবছে, তারা বিজয়ী হবে। বাইরের লোকজনের যুক্তি দিতে পারে, তাদের এই বিশ্বাসের ভিত্তি নড়বড়ে। কিন্তু বাইরের মানুষেরা যা-ই ভাবুক না কেন, যুধ্যমান দুই পক্ষই জয়ের আশা করে। কিয়েভ ও মস্কো—দুই পক্ষের এক পক্ষ থেকেও এখন পর্যন্ত এই উপলব্ধির ঝলক দেখা যায়নি যে তাদের জয়ের আশা শেষ পর্যন্ত বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়।প্রতিদ্বন্দ্বী সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি হটিয়ে দিতে পারলেও শান্তির বন্দোবস্ত হতে পারে। কিন্তু ইউক্রেন সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নেই। রাশিয়া ইউক্রেনের দোনেস্ক, খেরসন, জাপোরিঝঝিয়া প্রদেশের ও লুহানস্কের প্রায় পুরো অংশের দখল বজায় রেখেছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে ইউক্রেন খেরসন প্রদেশের একটি অংশ ও খারকিভ প্রদেশের পুরোটা পুনরুদ্ধার করে নিয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে বড় কোনো অগ্রগতি ইউক্রেনের সেনারা ঘটাতে পারেনি। এ সময়ে কোনো পক্ষই অপর পক্ষকে মাঠের বাইরে বের করে দেওয়ার মতো বড় আক্রমণ শাণাতে পারেনি। কিংবা বড় কোনো ভূখণ্ড দখল করতে কিংবা অপর পক্ষের সামরিক সক্ষমতাকে পঙ্গু করে দিতে পারেনি।
এমনকি শোর তোলা ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান থেকেও তেমন কিছু অর্জিত হয়নি। এই অভিযানের মাধ্যমে অচলাবস্থা ভেঙে বড় কিছু অর্জনের আশা করেছিল ইউক্রেন। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাশিয়া ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের যতটা ভূমি দখলে নিয়েছে, তার সবটা রাশিয়ার কাছ থেকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু কিয়েভ সেই সাফল্যের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি। মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণেও অনেক সময় রাজনৈতিক নেতারা মীমাংসার পথে যেতে বাধ্য হন। ইতিহাস বলছে, যুদ্ধের সময়ে জনগণ কঠোর দুর্ভোগ সহ্য করতে প্রস্তুত থাকেন। দুর্ভোগ কতটা হবে, সে বিষয়ে পাত্তা না দিয়েই তারা লড়ে যেতে থাকেন। গত আঠারো মাসে আমি তিনবার ইউক্রেন সফরে গেছি, কিন্তু কারও মুখেই আমি শুনিনি, তাঁরা বলছেন, দুর্ভোগটা এই মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে যে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলা প্রয়োজন। গত শীতকালে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় একের পর এক হামলা চালিয়ে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল রাশিয়া। সবচেয়ে ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে ইউক্রেনীয় নৈতিক শক্তি ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই দুরবস্থার কারণে বরং রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেনীয়দের বিদ্বেষ বহু গুণ বেড়ে গেছে এবং তারা দখলদারকে তাদের মাটি থেকে বের করে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। ইউক্রেনীয়রা বলেন, তাঁরা লড়াই জারি রেখেছেন এই কারণে যে যুদ্ধে হেরে গেলে তাঁদের দেশটাই হারিয়ে যাবে। অনেক সমালোচকের দাবি হলো, রাশিয়াকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমারা ইউক্রেনীয় নিষ্ঠুরভাবে যুদ্ধে ব্যবহার করছেন। পশ্চিমারা চায় যে একজন ইউক্রেনীয় বেঁচে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধটা যেন চালু থাকে। তাঁদের এই যুক্তির পেছনে যে উদ্দেশ্য থাকুক না কেন, একটা সত্য হচ্ছে, ইউক্রেনীয়দের কেউ জোর করে যুদ্ধে নামাননি। তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করাও হয়নি। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছায় লড়াই করছেন এবং কোনো অবস্থাতেই নতি স্বীকার করতে রাজি নন।একটি ধারণা হলো, ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় পুরোপুরি যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা না থাকায় অনেকে অস্ত্রবিরতির কথা বলছেন। এই প্রস্তাবে ইউক্রেনীয়দের কাছে আবেদন তৈরি করতে পারেনি। তাঁরা মনে করেন, অস্ত্রবিরতির প্রস্তাবে রাজি হওয়া মানে লড়াইকে হিমঘরে পাঠানো এবং তাঁদের দেশের বড় অংশকে চিরতরে রাশিয়ার কাছে তুলে দেওয়া। কেননা, যুদ্ধবিরতির মান হলো, পুতিনকে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া, যাতে শক্তি সঞ্চয় করে তাঁর বাহিনী আবার পুরোদমে আক্রমণে নেমে পড়তে পারে। সব যুদ্ধেরই একদিন অবসান হয়। এ হিসাবে ইউক্রেন যুদ্ধেরও অবসান হবে। দক্ষ কোনো মধ্যস্থতাকারীর মধ্যস্থতায় যদি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, এমনকি অস্ত্রবিরতির মতো কিছু না হলে কিয়েভ ও মস্কো দুই পক্ষের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যেত। দুঃখজনক সত্য হলো, সে ধরনের কোনো বাস্তবতা থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। সেটা কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
সৌ: প্র: আ:
রাজন মেনন ডিফেন্স প্রায়োরিটিজের গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি প্রোগ্রামের পরিচালক এবং নিউইয়র্ক সিটি কলেজের কলিন পাওয়েল স্কুল ফর সিভিক অ্যান্ড গ্লোবাল লিডারশিপের ইমেরিটাস অধ্যাপক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct