বাড়ির লোক
শেখ কামাল উদ্দীন
‘বাড়ির লোককে ডাকুন’। আবার বলেন নার্স দিদি, এবার একটু গলা তুলে, ‘কি হলো বাড়ির লোককে ডাকুন।’ চৌদ্দশো সাত নম্বর বেডে শুয়ে শ্যামবাবু চমকে উঠে নার্সের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কিছু বললেন দিদি?’ ‘বলছি, বাড়ির লোককে ডাকতে। আপনার অপারেশন হবে। তার আগে বাড়ির লোকের কন্সেন্ট দরকার।’ শ্যামবাবু মানে শ্যামসুন্দর রায় অফিস থেকে ফেরার সময় রাস্তায় পড়ে যান। তাকে রাস্তা থেকে তুলে জনৈক নীলাদ্রি সরকার কাছাকাছি একটা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন। বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা আসতে দেরি করছেন। এদিকে দ্রুত শ্যামবাবুর অপারেশন দরকার। বাড়ির লোকের কন্সেন্ট ফর্মে সই দরকার। কেননা শ্যামবাবু সই করার মতো অবস্থায় নেই। আর যেহেতু রক্তের সম্পর্ক নয় তাই নীলাদ্রি সরকারও সই করতে পারবেন না। সেইজন্যে বাড়ির লোকের খোঁজ। শ্যামসুন্দর রায় একটি বেসরকারি স্বল্প সঞ্চয় কোম্পানির অল্প বেতনের অস্থায়ী কর্মী। অনেক অনুরোধ-উপরোধেও স্থায়ী হ’তে পারেননি। মাসের শেষে যে বেতনটুকু পান বৌদির হাতে তুলে দেন। কবিতা লেখার চেষ্টা করেন। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় পুজোর সময় কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়েছে। স্বপ্ন দেখেন কলকাতার বড় পত্রিকায় একদিন তার কবিতা ছাপা হবে।
অবিবাহিত শ্যামবাবুর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা কেউ নেই। কাছের লোক বলতে ভাইপো-ভাইঝি আর তাদের ছেলেমেয়েরা। যারা সম্পর্কে তার নাতি-নাতনি। তাদের নিয়েই তার সংসার। নার্সের কথা শুনে শ্যামবাবু অবাক হয়ে ভাবতে থাকেন, কার কথা বলবেন? শ্যামবাবুর দাদা যখন মারা যায় তখন তিনি এম.এ পড়ছেন। ভাইপো ক্লাস টুয়েলভে আর ভাইঝি এইটে। বিধবা বৌদি সুলেখা রায় এল. আই. সি অফিসের সামান্য বেতনভুক কর্মী। স্বামী আর বিপত্নীক শ্বশুরের পেনসনের সামান্য টাকায় সুলেখাকে সংসার চালাতে হয়। সংসারে দুই অবিবাহিত ননদ। দেওর, দুই ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, অসুস্থ শ্বশুরের ওষুধের খরচ, ননদদের বিয়ের চিন্তা সব মিলিয়ে সুলেখার হিমসিম অবস্থা। দেওরের অসুস্থতার খবরে দিশেহারা হয়ে পড়েন সুলেখা। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাবে, না প্রতিবেশীদের কাছে টাকা ধার চাইবে ভেবে আকুল। ইতিমধ্যে হাসপাতালের ট্রান্সপোর্টের এক কর্মী হুইলচেয়ার নিয়ে মেল ওয়ার্ডে ঢুকলে নার্স ইনচার্জ চোদ্দোশো দশ নম্বরের বেডের রোগীকে বললেন, ‘আপনি হুইলচেয়ারে করে ক্যাথ ল্যাবের সামনে চলে যান। ওখানে আপনার বাড়ির লোক অপেক্ষা করছে।’ এদিকে ছ’টা বাজতে যায়। গোঁফওয়ালা লম্বা সিকিউরিটি তাগাদা দিয়ে যায়, ‘সময় হয়ে গেছে। এবার বাড়ির লোকেরা বাইরে যান।’ বাড়ির লোক, বাড়ির লোক শুনতে শুনতে শ্যামবাবু ভাবেন, তার বাড়ির লোক কে! একসময় ভাইপোর নাম ও ফোন নম্বর মানিব্যাগে রেখে দিতেন। যদি দরকার হয়। এখন ভাইপো বিবাহিত। আলাদা থাকে। সংসার হয়েছে। খোঁজখবর নিতে পারে না। অসুবিধায় পড়ে আগে ফোন করলে পাওয়া যেত। এখন আর পাওয়া যায় না। তাকে কী বাড়ির লোক বলা যায়! ভাইঝিরও দূরে বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই মালেয়েশিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। বছরে দু’বার বাড়ি আসে। দুই মেয়ে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিয়ে তার নিজের একটা সংসার হয়েছে। সে কী এখন শ্যামসুন্দরের বাড়ির লোক। মাথা ধরে শ্যামসুন্দরের। কে জানে!নার্স এবার শ্যামসুন্দরের কাছে এসে বলেন, ‘আপনার অবিলম্বে অপারেশন দরকার। দু’ বোতল বি পজেটিভ রক্ত চাই। দ্রুত বাড়ির লোককে আসতে বলুন। না হলে আজ আর অপারেশন হবে না।’ শ্যামসুন্দর ফ্যালফ্যাল করে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। কান খাড়া হয়ে ওঠে, শুনতে পায়, একটি কিশোরীর কন্ঠ, যেন বলছে, ‘ম্যাডাম পেশেন্ট কোথায়? আমি চোদ্দোশো সাত নম্বরের বাড়ির লোক।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct