পঞ্চাশের দশকের কথাকার মহাশ্বেতা দেবী আমৃত্যু সাহিত্যকর্মে এবং সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সাহিত্যকর্ম এবং সমাজকর্মের মধ্যে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সমাজকর্মকেই। কিন্তু তার মধ্যেও রচনা করে গেছেন একের পর এক উপন্যাস ও গল্প। ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস “ঝাঁসীর রানী” প্রকাশিত হয়। চর্চা করেছেন ড: অমরেন্দ্র মহাপাত্র...
মধ্যবিত্ত জীবনের বিভিন্ন সংকট ব্যক্ত করেছেন যে উপন্যাসগুলিতে সেগুলি হল, ‘তারার আঁধার’, ‘এতটুকু আশা’, ‘সন্ধ্যার কুয়াশা’ প্রভৃতি উপন্যাসে। নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কের জটিল রসায়ন রূপায়িত হয়েছে “তিমির লগন”, “রূপরেখা”, “লায়লী আশমানের আয়না”, “অজানা”, “তীর্থশেষের সন্ধ্যা” ইত্যাদি উপন্যাসে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্তের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রার ছবি আছে “নীল ছবি” “পোস্টমর্টেম”-এর মতো উপন্যাসে। দেশভাগের ফলে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যে উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি হয়েছিল তা মহাশ্বেতা দেবীর চিন্তা এবং চেতনাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। উদ্বাস্তু সমস্যার শিকড় সন্ধান করতে গিয়েই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন বর্গী আক্রমণের কালে। বর্গী আক্রমণের ফলে যে মানুষেরা নদী পেরিয়ে ওপার বাংলায় পৌছে গিয়েছিল উদ্বাস্তু হয়ে, হয়তো তাদেরই বংশধরেরা দেশভাগের ফলে পুনরায় ফিরে এসেছে শিকড়ের সন্ধানে। ১৯৪৭ সালের পরবর্তী ভারতবর্ষ এবং ১৯৪০-এর ভারতবর্ষ মহাশ্বেতা দেবীর চেতনায় একই বিন্দুতে অবস্থান করে। তাই বর্গী আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের চালচিত্র তুলে ধরেন “আঁধার মানিক” উপন্যাসে। আদিবাসী সমাজ এবং তাদের জীবন ইতিহাস মহাশ্বেতার চেতনায় আলোড়ন তুলেছিল। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যে আদিবাসী জীবনকে তিনি দেখেছেন তাকেই তুলে এনেছেন উপন্যাসের পাতায়। ঔপন্যাসিকের স্বচ্ছ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে আদিবাসী সমাজ এবং তাদের জীবন সংগ্রাম। কবি “বন্দ্যঘটা গাঞির জীবন ও মৃত্যু” উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী এমন এক কবির কথা তুলে ধরেছেন যে নিজের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জীবন ত্যাগ করে অর্জিত জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। কবির জীবনবোধ তাকে নিজের জীবন গড়ে নেবার জন্য প্রাণিত করে। সে জন্য যদি নিজের সমাজ ত্যাগ করেও আসতে হয় তাতে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। আরণ্য চুয়াড় যুবকের এই জীবনবোধ সমগ্র আদিবাসী সমাজের জীবনবোধ নয়। ষোড়শ শতকের বাংলাদেশ অর্থাৎ চৈতন্যদেব এবং মুকুন্দরামের সময় নিয়েও মহাশ্বেতা দেবী আরও যে উপন্যাসগুলি রচনা করেন সেগুলি হল “বিবেক বিদায় পালা”। সেখানে গৌরবর্ণ দীর্ঘকায় চৈতন্যদেব এবং খর্বকায় বটু একই সময়ে জন্মালেও সমাজে দুজনের মর্যাদা দুরকম। বটুদের খাবার জোটেনা, শীতের কম্বল জোটে না, অত্যন্ত দুখের জীবন বটুদের। কিন্তু যেখানে বটুদের বাস, সেই মায়াপুরে যেন মায়ার অভাব। তাই একদিকে যেমন সাকারের অভাব হলেও অন্যদিকে খাবারের অপচয় হয়। বাংলা সমাজে মেয়েরা যে নিগৃহীত তার পরিচয়ও মহাশ্বেতা দেবীর অন্য অনেক উপন্যাসের মতো এ উপন্যাসেও রয়েছে। “ব্যাধখন্ড’, “বেনে বউ” একই সময় এবং সমাজ পরিপ্রেক্ষিতে রচিত।মুন্ডা সমাজের জনজাতির কথা উঠে এসেছে “অরণ্যের অধিকার”, “চোট্টি মুন্ডা এবং তার তির” উপন্যাসে যেখানে মুন্ডারা মাতৃসম অরণ্য রক্ষার জন্য লড়াই করে। সে লড়াই-এ নেতৃত্বদানকারী নেতা দেবত্বে উন্নীত হয়। বীরসা মুন্ডা সে কারণেই সকল মুন্ডা সমাজের ভগবানে পরিণত হয় যে দেবতা “উলগুলানে”র মন্ত্র দেয়, বেঁচে থাকার সাহস দেয় এবং সংগ্রামের উত্তরাধিকার সঞ্চারিত করে দেয় পরবর্তী প্রজন্মের হাতে। তাই যে বছর অর্থাৎ ১৯০০ সালে বীরসা মুন্ডার মৃত্যু হয় এবং সেই বছরেই জন্ম হয় চোটিমুন্ডার। যে চোটি মুন্ডা “মুন্ডা বিদ্রোহ’-এর পরবর্তী নায়ক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই আসে সংগ্রামী মানুষেরা। ভারতবর্ষের ইতিহাস যে সব বীরদের প্রায় বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দিয়েছে মহাশ্বেতা দেবী তার আখ্যানভাগে তুলে আনেন সেই বীরদের। সিধো-কানহো, বীরসা মুন্ডা, তিতুমীর প্রমুখ চরিত্রেরা ইতিহাসে খুব একটা মর্যাদার আসনে আসীন নয়। তাই তো আদিবাসী ছাত্রীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়.আমাদের কি কোনও বীর নেই? নেতাজী, মহাত্মা গান্ধীর পাশাপাশি স্বাধীনতা আন্দোলনে এই বীরদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। সমাজ সচেতন সাহিত্যস্রষ্টা তো কখনোই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাই সেই দায়বদ্ধতা থেকেই মহাশ্বেতা দেবী তার উপন্যাসে তুলে আনেন প্রায় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া এই সব বীর নায়কদের। মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসে আর একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তা হল নারীর সামাজিক অবস্থান। “শ্রীশ্রী গণেশ মহিমা”, “মাস্টার সাব”, “ক্ষুধা’-এর মত উপন্যাসে উঠে এসেছে উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা নিম্নবর্ণের লাঞ্ছনার চিত্র। যদিও এই মানুষেরা শুধু নিম্নবর্ণের নারীদেরই অসম্মান করে তা নয়, এরা নিজেদের বর্ণের নারীকেও অপমানিত, লাঞ্ছিত করে। কিন্তু উচ্চবর্ণের সমাজে নারীরা লাঞ্ছিত হলেও নিম্নবর্ণের সমাজে নারীরা সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত যেখানে নারী-পুরুষ প্রায় সমান অধিকার পেয়ে থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সমাজে নারীর স্থান পুরুষেরও ওপরে। মুন্ডা সমাজে মায়ের স্থান যে অনেক উঁচুতে, মুন্ডা জীবনাশ্রিত দুটি উপন্যাসেই তা তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যে পেশাদারী লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কল্লোলের যুগে জন্মগ্রহণ করার ফলে এবং স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়কালীন সংকটকে প্রত্যক্ষ করার ফলে সমাজ-জীবন, রাজনীতি সম্পর্কে তিনি একটি স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী হয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেখেছেন দেশভাগ, উদ্ান্তু সমস্যা, সংবিধান লিখিত নিয়মাবলীর যথোপযুক্ত প্রয়োগ না হওয়া, দেশীয় শাসকদের অত্যাচারের কৌশলগুলি। ব্যক্তিজীবনে প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করা মহাশ্বেতা দেবী বুঝতে পেরেছিলেন, আমাদের দেশে সেই মানুষেরই সংখ্যাধিক্য, যাদের জীবনধারণের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয়। সংবিধান-প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাগুলি মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য। ফলে বঞ্চিত হয় বহু মানুষ। ৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ মহাশ্বেতা দেবীর মনকে ব্যথিত করেছিল। দুর্ভিক্ষের সময়ে মহাশ্বেতা দেবী মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং যোগদান করেছিলেন ত্রাণ ও সেবার কাজে। প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছিল মানুষের অসহায়তার সঙ্গে। এসময় বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনেও দারিদ্রের সঙ্গে সহাবস্থান করে চলতে হয়েছিল। সমাজে ব্যক্তিমানুষের অবস্থান এবং ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক ইত্যাদি সম্পর্কেও সম্যক ধারণা জন্মাতে শুরু করে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সমাজে শ্রেণীবিভাজন আরও প্রকট হতে শুরু করে। সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী মানুষের জীবনচেতনা গড়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিন্তের জীবনভাষ্য। নিম্নবিত্ত সমাজের ক্ষেত্রে শুধু শোষক শ্রেণীর বদল ঘটে মাত্র। শোষণের চরিত্র শুধু বদলায়। বাস্তব অভিজ্ঞতায় যে সমাজ ও জীবনকে তিনি দেখেছিলেন, তাকেই রূপদান করলেন সাহিত্যে অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য যথার্থ দলিলিকরণকেই তিনি যোগ্যতম মাধ্যম মনে করেছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি করার সাধ মহাশ্বেতা দেবীর ছিল না। তার সৃষ্টির মধ্যে শৈল্পিক ত্রুটি থাকলেও তাতে তার কিছু এসে যায় না। বরং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক “অপরাধপ্রবণ” আদিবাসীদের উন্নতি সাধনে তিনি বেশি মনোযোগী হন। জীবিতকালের মধ্যে আদিবাসীদের জন্যই তিনি কাজ করে গেছেন। মানুষের জন্য কাজ করার মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। মানুষের জন্য কিছু না করে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না বলেই তিনি মনে করতেন। তাই মানুষের মধ্যেই বিশেষ করে আদিবাসী জীবনচেতনার মধ্যে তিনি বেঁচে রয়েছেন এবং থাকবেন। মহাশ্বেতা দেবী অন্ত্যজ চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। মাটির সানিধ্যে থাকা মানবীয় চরিত্র সৃজনেই তার আনুগত্য লক্ষ্য করা যায়। এ কারণেরি বেশিরভাগ প্রধান ও সাহিত্য-সফল চরিত্রগুলো আদিবাসী শ্রেণি থেকে উদ্ভূত। উদাহরণ হিসাবে চন্ডী, মেরী, ধৌলী প্রমুখ চরিত্রের কথা উল্লেখ করা যায়।মহাশ্বেতা দেবী সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়, সমস্যাকে সামনে রেখে সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছেন। সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় ছোট গল্পগুলিতে। একারণেই বাংলা সাহিত্যে মহাশ্বেতা দেবীকে অনেকেই সমাজতাত্ত্বিক হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। আমাদের বক্তব্য তাকে কেবল সমাজতাত্ত্বিক না বলে, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক হিসাবে চিহ্নিত করাই অধিক সমুচিত। কেননা তার মতো করে অন্ত্যজ সমাজের কণ্ঠস্বর খুব কম জনই অনুভব করতে পেরেছে। মহাশ্বেতা দেবী, তার ছোট গল্প তথা সাহিত্যে নিজের মতো করে নি:স্বজনের চর্চা করে গেছেন। মহাশ্বেতা দেবী কেবল একজন সমাজতাত্ত্বিক বা সাহিত্যিক হিসাবে নন, বরং একটা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিতি পাবেন বাংলা সাহিত্য তথা সমাজে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার সাহিত্য-বিষয় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন: “তিনি বহু বিষয় লিখেছেন। কিন্তু বিশেষ করে ইদানীং কালে আদিবাসী ও জনজাতি যারা সমাজে অবহেলিত বটেই, সাহিত্যেও উপেক্ষিত তিনি তাদের তুলে ধরেছেন। আমি তার সাহিত্যকর্ম এবং ব্যক্তিত্বের বিশেষ অনুরাগী - এই অনুরাগধর্মীতার পশ্চাতে যেমন রয়েছে সাহিত্যকর্ম এবং ব্যক্তিত্ব, ঠিক তেমনি রয়েছে মহাশ্বেতা অনুচরবর্গ নিয়ে সংগঠিত বিশেষ এক প্রতিবেশ। যে সংগঠিত প্রতিবেশ বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের রূপ ধারণ করে, যা সবসময় এবং উত্তর প্রজন্মের সমাজসেবী এবং সাহিত্যিকদের কাছে অনুনকরণীয় হিসাবে দেখা দেয়। সমাজসেবী হিসাবে তিনি বাস্তবে যা দেখেছেন তা সাহিত্য-শিল্প হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবার তিনি সমাজের যে সমস্যাগুলি উপলব্ধি করেছেন, সেগুলির সমাধান করতে চেয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তা সমাধানও করেছেন। একারণে সাহিত্যিক সত্তা এবং সমাজসেবী সত্তার যথার্থ সংবন্ধন ঘটেছে মহাশ্বেতা দেবীর জীবনে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct