আদিম অধিবাসী হল আদিবাসী, এমনটা মনে করা হলেও, এনিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। একটা স্বতন্ত্র জীবনপ্রণালী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতি গোষ্ঠী হল আদিবাসী। কোনো ভূখণ্ডে সুপ্রাচীন কাল থেকে বসবাস করে আসা এমন জনগোষ্ঠী, যাদের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি রীতি-নীতি ভাষা বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে বয়ে চলছে তাদের জীবন জীবিকা। লিখেছেন সন্ন্যাসী কাউরী।
আদিম অধিবাসী হল আদিবাসী, এমনটা মনে করা হলেও, এনিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। একটা স্বতন্ত্র জীবনপ্রণালী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতি গোষ্ঠী হল আদিবাসী। কোনো ভূখণ্ডে সুপ্রাচীন কাল থেকে বসবাস করে আসা এমন জনগোষ্ঠী, যাদের নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি রীতি-নীতি ভাষা বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে বয়ে চলছে তাদের জীবন জীবিকা। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ৬০কোটির বেশি আদিবাসী মানুষের বসবাস। বিশ্বের ৯০টি দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা সর্বাধিক। ভাষার সংখ্যাও কম নয়। গোটা বিশ্বে প্রায় ৭হাজার আদিবাসী ভাষা রয়েছে। আর আদিবাসীদের ৫ হাজার আলাদা আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। ভারতবর্ষে প্রায় ১১ কোটির ওপর আদিবাসী মানুষের বসবাস। পশ্চিমবঙ্গে ৪০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ৬০লক্ষের ওপর আদিবাসী বসবাস করেন। ত্রিপুরা, আসাম, মনিপুর, ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড রাজ্য গুলোতে মূলত আদিবাসীদের বসবাস। জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য -কোল, ভিল, মুন্ডা, সাঁওতাল, ভূমিজ, ওঁরাও, খেড়িয়া, গারো, খাসিয়া ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যা ঝাড়খন্ড লাগোয়া পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলাতে মূলত আদিবাসী সম্প্রদায় মানুষেরা বসবাস করেন। এছাড়া বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করেন। বনাঞ্চল বা বনাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় সাধারণত আদিবাসী মানুষদের বসবাস। তাই সুপ্রাচীন কাল থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের জল জমি জঙ্গলের ওপর অধিকার। বিশ্বব্যাপী আদিবাসী মানুষদের ঐতিহ্য, নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে ১৯৯৪ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ৯ ই আগস্ট আদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করা হবে এই মর্মে ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে বিশ্বের ৯০ টি দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রতি বছর ৯ই আগষ্ট দিনটিকে আদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এর আগে ১৯৯৩ সালকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রথমবার “আদিবাসী বর্ষ” হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৯৫ -২০০৪ এই সময়কালকে আদিবাসী দশক। ২০০৫ - ২০১৪ কে দ্বিতীয় আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সাধারণভাবে বলা যায় যে, একটি রাষ্ট্রে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে আদিবাসীরা প্রান্তিক অবস্থানে থাকে। নিজেদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা নিয়ে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী ‘আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত। এই আদিবাসীদের অধিকাংশই নিজেদের অধিকারের ক্ষেত্রে বঞ্চিত। অনেক দেশে আদিবাসীরা স্বীকৃতিই পায়নি। কোনো দেশে আবার আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ বা কোন ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলে অভিহিত করা হয়।আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধান এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই গণসচেতনতা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে ? আদৌ কি আদিবাসী জনজাতির মানুষের জল জমি জঙ্গলের অধিকার সুনিশ্চিত হয়েছে বা হচ্ছে ? ২০১৯ সালকে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ’ হিসাবে ঘোষণা করে। ওই বছরই সুপ্রিম কোর্ট ভারতবর্ষের প্রায় ১১ লক্ষ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষকে বনবাসস্থান থেকে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিল। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ। ভারতে বসবাসকারী হাজার হাজার আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতিকে উচ্ছেদ করার পেছনে আপাত কারণ খনি ও কলকারখানা। শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য আরো জমি চাই৷ জীববৈচিত্র্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্পোদ্যোগীদের হাতে জমি তুলে দেওয়া চাই৷ ঝাড়খন্ডে কয়েক হাজার বনভূমি এলাকা দখল করে নিয়েছে আদানি কোম্পানি৷ তাদের হয়ে প্রমাণ ও পুলিশ দুই-ই জুগিয়েছে সরকার৷ এই রকমভাবে আদিবাসীদের বনভূমি আবাস কেড়ে নিয়ে খনি হয়েছে, বাঁধ হয়েছে, কারখানা হয়েছে ৷ অশিক্ষিত নিরীহ আদিবাসী মানুষেরা পেয়েছে শুধু অবিচার আর বঞ্চনা ৷ সম্প্রতি বিতর্কিত বন সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল লোকসভায় পাস করিয়ে নেয় কেন্দ্রের মোদী সরকার। অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন জনজাতির মানুষ। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরও দেশের মূলবাসীরাই আজও শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, অত্যাচারিত। মনিপুরে আদিবাসী মহিলার ওপর পাশবিক নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা, মেদিনীপুরের ডেবরার প্রতিবাদী আদিবাসী শিক্ষককে পিটিয়ে খুন, বীরভূমের আহমেদপুরে আদিবাসী দম্পতি পান্ডু হেমব্রম ও পার্বতী হেমব্রমকে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে খুন, ওই জেলায় খয়রাশোলে আদিবাসী কিশোরীকে ধর্ষণ করে খুন, মধ্যপ্রদেশে চোর সন্দেহে এক আদিবাসী ব্যক্তিকে পিটিয়ে খুন, সি আর পি এফ এর গুলিতে আদিবাসী মানুষের মৃত্যুর ঘটনা সহ আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারের নানান ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
এরকম পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন প্রান্তে আদিবাসী জনজাতি তাদের নানান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাধারণত প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাস করা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষরা। নানান কারণে বিভিন্ন দেশে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এখনো বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জোরপূর্বক আদিবাসীদের ভূমি দখল, পাট্টা সময় মতো না দেওয়া, সামান্য উপটৌকন দিয়ে আদিবাসীদের ভুল পথে পরিচালনা করা, জল, জমি, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ছোট জাত বলে ঘৃণার চোখে দেখা, সামাজিক বৈষম্য সহ নানান রকম সমস্যায় আদিবাসী সম্প্রদায় জর্জরিত। আমাদের দেশে এবং রাজ্যে আদিবাসী উন্নয়নের জন্য আলাদা দপ্তর রয়েছে। আদিবাসী উন্নয়নে প্রতিটি অর্থবছরে তাদের জন্য ব্যয় বরাদ্দ করা হচ্ছে। কিন্তু সেই উন্নয়ন একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে অর্থাৎ তৃণমূল স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, ঝাড়খন্ড এবং উড়িষ্যার আদিবাসী অধ্যুষিত বহু অঞ্চল এখনো শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে পুরোপুরি প্রশাসন দায়ী এমনটা নয়। এর পেছনে রয়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের সচেতনতার অভাব।আদিবাসী জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি নিজেদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদা স্বীকৃতির দাবী সহ বিভিন্ন দাবীতে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়ে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় স্বীকৃতি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী সমাজ বলছে, আগে জনগণনার সময়ে তারা নিজেদের ধর্ম উল্লেখ করার সুযোগ পেতেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে শুধুই হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ ইত্যাদি প্রধান ধর্মগুলির মধ্যেই একটাকে বেছে নিতে বাধ্য হন তারা। এই প্রথা বদলের দাবি ঝাড়খন্ড রাজ্যে দীর্ঘদিন থেকেই উঠেছে। আদিবাসী ধর্মগুরু বন্ধন টিগ্গা বলেছিলেন, ভগবান ধর্মেশ, সিংবোঙ্গা, হিল্লা মারাংবুরুর উপাসনা যারা করে, তারাই সার্না বা সারনা ধর্মাবলম্বী। সারনার আরেক নাম হল সৃষ্টি। জল, বায়ু, অগ্নি, ভূমি এবং আকাশ - এই পাঁচটি মূল উপাদানের মাধ্যমে যে সৃষ্টি, তারই উপাসনা করেন আদিবাসীরা। তিনি আরও জানাচ্ছিলেন যে সারনা শব্দটি ওঁরাও জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। উপাসনাস্থল বোঝাতে কিন্তু সাঁওতাল, হো, মুন্ডারি ইত্যাদি জনজাতির ভাষায় উপাসনাস্থলের আলাদা নাম আছে বলে তিনি জানান। যে উপাসনাস্থলে প্রকৃতিরূপী ভগবানকে আদিবাসী মানুষ অনুভব করেন, সেটাই সার্না বলেছিলেন ধর্মগুরু টিগ্গা। আধুনিকতার ছোঁয়ায়, সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে আদিবাসী জনজাতি বেশ কিছু গোষ্ঠী এবং তাদের ভাষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের সভ্যতা, সাংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অস্তিত্ব, ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি, অক্ষুন্ন রেখে মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আদিবাসী মানুষেরা গোটা বিশ্বে লড়াই করে যাচ্ছে। আগামী দিনে আদিবাসীরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই জারি রাখবে। তবেই সার্থক হবে আদিবাসী দিবস পালন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct