র্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মানুসারী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাব আর মিলে মিশে থাকার ঐতিহ্য বহমান ছিল। আজও তা বহুলাংশে বহাল রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণির ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা এই মানবীয় পরিবেশকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলেও তা কখনও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনকালে শৈব ও বৌদ্ধ জন গোষ্ঠীর অবস্থানও ছিল সাধারণত স্বাভাবিক। সেই শহরের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ইতিহাস বেত্তা খাজিম আহমেদ।
মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মানুসারী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাব আর মিলে মিশে থাকার ঐতিহ্য বহমান ছিল। আজও তা বহুলাংশে বহাল রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণির ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা এই মানবীয় পরিবেশকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলেও তা কখনও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনকালে শৈব ও বৌদ্ধ জন গোষ্ঠীর অবস্থানও ছিল সাধারণত স্বাভাবিক। তুর্ক-আফগান ও মোগল আমলেও এই অঞ্চলের মানুষ আপনজনের মতো বসবাস করেছে। প্রায় স্বাধীন নবাবি আমলে তো সম্প্রীতির আবহাওয়া সুবে বাংলায় পুরোপুরি কায়েম ছিল। বিশ শতকে সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠলেও এই জেলার আপামর জনসাধারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েনি। সুফী, সন্ত, পীর-ফকির, আউল, বাউল আর দরবেশের সহজ সরল অনাড়ম্বর সাম্যবাদী জীবন ভাবনা সাধারণ মানুষকে একেবারে কাছাকাছি এনে দেয়। বৈষ্ণবাদর্শ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের কথা, মানুষ সবার উপরে। তার উপরে কেউ নেই। মানুষকে ভালবাসো, ঈশ্বরকে পাবে। জাতপাতহীন, উঁচু, নীচু ভেদাভেদকে ভুলে সব আপনজন হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতা সেখানে প্রাধান্য পায়নি। বিশ শতকের শুরু থেকে এই জেলায় মুসলমানরা ক্রমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। সেন্সাস রিপোর্টে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালেও জেলার হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় মেতে ওঠে নি। কেন এমন সম্ভব হল? বিশ্লেষণ করলেই দেখতে পাব জেলার ঐতিহ্য অনুসারেই অসম্প্রদায়িক চেতনার কতকগুলো উপাদান আজও ক্রিয়াশীল। উপরন্ত বিভিন্ন ব্যক্তির অসাম্প্রদায়িক জীবন ও চিন্তাধারাও এই অঞ্চলের মানুষকে প্রভাবিত করে। বিগত একশো বছর ধরে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানসিকতার বিস্তর নজির মুর্শিদাবাদ জেলায় লক্ষ্য যোগ্য হয়ে উঠেছে। আমরা বর্তমান আলোচনায় দুই বিশিষ্ট ও বিশাল সংখ্যক হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। যদিও এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জৈন ধর্মীবলম্বী মানুষ এবং অজস্র নিম্নবর্ণের অন্ত্যজ ও আদিবাসী জনজাতি বাস করেন। পুরো মুর্শিদাবাদ জেলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য সংক্রান্ত স্বতন্ত্র একটি বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। যদিও আলোচ্য নিবন্ধে কেবলমাত্র শহর বহরমপুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়টিতেই প্রাধান্য দেওয়া হল। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল থেকে একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে মুর্শিদাবাদ দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে স্থান পেয়েছিল।১ প্রায় সেই সময় থেকেই ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে বহরমপুর শহর জেলার সদর শহরে পরিণত হয়। স্যার যদুনাথ সরকার মন্তব্য করেছেন, বহরমপুরের সৃজন শুরু হয়েছিল “ক্যান্টনমেন্ট” শহর হিসাবে।২ ক্রমশ স্বাভাবিক নিয়মেই এবং নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে এই শহর বিকশিত হয়েছে। ঊনবিশ শতকে এই বিকাশ সাধনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) উদ্ভূত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশ গুরুতৃপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কাশিমবাজারের রাজা কৃষ্ণনাথের ভাবনা প্রসূত বহরমপুর কলেজের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৩) এ ব্যাপারে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। একটি শহর বা জেলার সমন্বয়ী ভাবনার বিকাশে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী, কুসংস্কার মুক্ত ও উদারনৈতিক শিক্ষার প্রসার নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রেও তাই করেছে। বলা যেতে পারে, মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষের মধ্যে বহুকাল থেকেই একটি ধর্মীয় সমন্বয় ভাবনা ফল্গু ধারার মত প্রবাহমান ছিল। তার নানা কারণ ছিল। বর্তমানেও সেই ধারা নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও প্রবাহমান।৩ এই প্রেক্ষাপটেই বহরমপুর শহর তথা মুর্শিদাবাদ জেলার সর্বস্তরের মানুষের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ভাবনার বিভিন্ন দিকগুলি বিশ্লেষণ করা দরকার।
সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান
বিশ শতকে এতোদ্দেশীয় জনজীবনের বড় ট্র্যাজেডি হল সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান এবং তার প্রত্যক্ষ প্রকাশ। অথচ এযাবৎকাল বাঙালি সমাজ সত্যিকার অর্থেই বহুবাচনিক সমাজ হিসেবে চলমান ছিল। এই শতকে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর বদ মতলবের কারণে ধর্মীয় বিভেদ প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। ফলে সমন্বয় ও সহিষ্ণুতার বদলে দৈত্যের মতো মাথা চাড়া দিয়েছে বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, সংশয় আর হতাশা। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে বাঙালি জীবনের, এর আগে পরিচয় ছিল না। বিষয়টি একটু বিশদে বলার প্রয়োজন রয়েছে। “খণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতি” নামক একটি ব্যতিক্রমী আলোচনায় গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, “বঙ্গীয় ভূখণ্ডে বিভিন্ন ধর্ম যেভাবে বিকাশ লাভ করেছে, তা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, বৈদিক ধর্ম এ অঞ্চলে এসে বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্মের পরিবর্তন হয়েছিল আরো বেশি। এমনকী বঙ্গের ইসলাম ধর্ম আরব দেশের আদি ইসলাম থেকে অনেকটাই আলাদা। বঙ্গদেশের সব ধর্মই বস্তুত কমবেশি সমন্য়ী চেহারা নিয়েছিল। সত্যপীর অথবা সত্যনারায়ণের মতো ধারণার জন্ম হয়েছিল বঙ্গদেশের মাটিতেই। বাউল এবং দেহতত্ত্ব বঙ্গীয় ধারণা। বঙ্গীয় চরিত্রের এই সমন্বয়ী মনোভাব থেকেই হিন্দু-মুসলমানরা গ্রাম সম্পর্ক পাতিয়ে একে অন্যের কাছাকাছি এসেছিলেন। সৎ প্রতিবেশী হয়েছিলেন।”৪ বিশ শতকে পৌঁছে এই অবস্থান রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ধর্মীয় আর রাষ্ট্রীক কূট চালে অসহনীয় ভাবে পাল্টে গেল। কেন? তাও বোধ হয় কিঞ্চিৎ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। গোলাম মুর্শিদ বিশ্লেষণ করেছেন এই ভাবে, “হিন্দু এবং মুসলমান শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি বাস করলেও তাঁদের সামাজিক অবস্থানের সাম্য ছিল না। সমাজের প্রথম সারিতে ছিলেন বর্ণ হিন্দুরা। আর একেবারে নিচের তলায় নিম্নবর্ণের হিন্দু আর মুসলমানরা। আর্থিক দিক দিয়েও বর্ণ হিন্দুরা ছিলেন জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী এবং সরকারি চাকুরে। সমাজে তারাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন। মুসলমানরা এটাকে বিনা তর্কে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিকে তাঁরা যখন জমি থেকে উঠে এসে শহরে উঁকি দিতে শুরু করলেন, তখন নিজেদের স্বাতন্ত্র সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে খানিকটা সচেতনতা দেখা দিল। এর ফলে দানা বাঁধতে শুরু করল হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক বিদ্বেষ। ... হিন্দু এবং মুসলমানদের এই অপ্রীতি অন্যভাবেও প্রকাশ পাচ্ছিল। যেমন, পূজা-পার্বণে হিন্দুরা চিরকালই গান বাজনা করেছেন। মুসলমানরাও কোরবানি এবং অন্যান্য কারণে গোরুর মাংস খেয়েছেন। মুকুন্দরাম, বিজয়গ্প্ত প্রমুখ সেই মধ্যযুগেই মুসলমানদের মাংস খাওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু হিন্দুর গান বাজনা আর মুসলমানদের গোরু খাওয়া নিয়ে দু’ সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা হয়নি। বিশ শতকের গোড়া থেকে দু সম্প্রদায়ই যেন তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বহু হিন্দু অপ্রয়োজনে মসজিদের কাছ দিয়ে যাবার সময়ে বাজনা বাজাতে শুরু করলেন। আর কোরবানির সময়ে বহু মুসলমান প্রকাশ্যে গোরু জবাইকে একটা পবিত্র দায়িত্ব বলে জাহির করতে আরম্ভ করলেন।”৫ এই ভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রথম দাঙ্গা বাধলো ১৯০৬ সালে। বাঙালির হলো এক অদৃষ্টপূর্ব দুঃখজনক অভিজ্ঞতা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারা
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ধারা অষ্টাদশ শতকে নবাবি জামানায় লক্ষ্য করা গেছে। উনিশ শতকে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে হিন্দ-মুসলমানের মিলিত সংগ্রামে প্রতিভাত হয়েছে। সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ তো আঠারো শতকের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। উনিশ শতকের নীল বিদ্রোহকালে মুর্শিদাবাদের হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় যুগ্ম আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।৬ মজনু শাহর ‘মুরিদ’ চিরাগ আলি শাহ মুর্শিাদাবদের ফকির বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিহত হন। বহরমপুরস্থ গোরাবাজারে আজকের কে. পি. চট্টরাজ রোডের একটি সুদৃশ্য মনোরম আস্তানায় তিনি সমাধিস্থ হয়ে রয়েছেন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির সেতু হিসেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ফকির বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ রূপে অসাম্প্রদায়িক। ইসলাম থেকে উদ্ভূত সুফীবাদ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। মানুষকে অকৃত্রিম ভালোবাসা-প্রীতি অর্পণের মারফত ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের আকাঙ্খা অনেকের মধ্যে প্রবল হয়েছে। এই বোধ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে হার্দিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে অশেষ সাহায্য করেছে। বহরমপুর কারবালা রোডের ধারে বিখ্যাত কারবালা মসজিদ। খুব সম্ভব মসজিদটি তুর্ক আফগান আমলে নির্মিত। এই ঐতিহাসিক মসজিদের খুব কাছাকাছি স্থানে আলি বদরুদ্দিন দোজা নামক এক সন্ত পীরের সমাধি রয়েছে। মহরমের সময়ে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক মাতমে অংশ নেন আজও। শোক মানুষকে কাছাকাছি এনে দেয়। বহরমপুরকে স্পর্শ করে রয়েছে চুনাখালি। পাঠান আমলেই ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল। এখানে পীর মসনদ আউলিয়া নামে এক বিশিষ্ট পীরের দরগা রয়েছে। সুফীসম্ত মখদুম শাহের সমাধিও রয়েছে। বহরমপুরস্থ দক্ষিণ গোরাবাজারে দাতা ফররুখ আলি শাহ, লাল সড়কের উত্তরাংশে গুলশা আউলিয়া, দক্ষিণাংশে ঘোড়া পীরের আস্তানা, আচার্য্য পাড়ায় সানাহউল্লার সমাধি, বহরমপুর ইউনিয়ান ক্রিশ্চিয়ান ট্রেনিং কলেজের পার্শ্ববর্তী শাহ জামাল বাবার আস্তানা, চিরাগ আলির সহযোদ্ধা চিড়িয়া শাহর সমাধিও রয়েছে কে. পি. চট্টরাজ রোডের আস্তানায়। এখানে চিরাগ আলি শাহর জনৈক ঘোষ শিষ্যের সমাধিও রয়েছে। এই আস্তানাগুলো হিন্দু-মুসলমানের মিলনভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সুফী-দরবেশ-এর অসূয়াশূন্য জীবন হিন্দু-মুসলমান উভয়ধর্মী মানুষকে ‘মুরিদ’ হিসেবে একটি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। বহরমপুর, গোরাবাজারবাসীন শেষ ফকির দরবেশ হলেন হাজি শাহ ফকির আহমদ। বহরমপুর নয়া সড়ক রোডে (অধুনা অধ্যাপক রেজাউল করিম সরণী) তাঁর সমাধি । ১৯৪৯-এর ৪ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৬ এপ্রিল সমাধিস্থ হন। উভয় বাংলা এবং আসামে তাঁর অজস্র মুরিদ ছিল। আজও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোক, সমাধি স্থান সংলগ্ন মসজিদ সযত্নে সংরক্ষণ করছেন। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ আজও প্রতি শুক্রবারে সশ্রদ্ধচিত্তে হাজির হন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct