মানবেতিহাসের সেই আদিপর্বে, সেই যাযাবর, আরণ্যক গুহাবাস - জীবনে মানুষ ছিল হিংস্র, ছিল অসামাজিক। কিন্ত আজ বিজ্ঞানদীপ্ত হাইটেক সভ্যতার যুগান্তরের রাজপথেই জয় করেছে দিক- বিদিক, বাস করছি আধুনিক যুগ সর্বোপরি মানবতার যুগে। তবু এই যান্ত্রিক সভ্যতার চরমোৎকর্ষের দিনে ও আজ কিশোর অপরাধের প্রবণতা অকল্পনীয় ভাবে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিখেছেন এম ওয়াহেদুর রহমান।
মানবেতিহাসের সেই আদিপর্বে, সেই যাযাবর, আরণ্যক গুহাবাস - জীবনে মানুষ ছিল হিংস্র, ছিল অসামাজিক। কিন্ত আজ বিজ্ঞানদীপ্ত হাইটেক সভ্যতার যুগান্তরের রাজপথেই জয় করেছে দিক - বিদিক,বাস করছি আধুনিক যুগ সর্বোপরি মানবতার যুগে। তবু এই যান্ত্রিক সভ্যতার চরমোৎকর্ষের দিনে ও আজ কিশোর অপরাধের প্রবণতা অকল্পনীয় ভাবে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা বিশ্ব জুড়ে যে ভাবে ক্রমবর্ধমান হারে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে গ্ৰামাঞ্চল অপেক্ষা শহরাঞ্চলে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা তথা গভীরতা বেশি। আধুনিক বিশ্বের অসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের নেতিবাচক ফল হলো কিশোর অপরাধ। আসলে সমাজের কিছু কিছু কিশোর কিংবা কিশোরীরা আজকে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথাকে অনুকরণ করতে না শিখে সমাজ বিরোধী চিন্তা ও কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। কিশোর অপরাধ প্রবণতা সমাজ, জাতি ও দেশকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
কিশোর - কিশোরীরা বাস্তবতার কষ্টিপাথরের বিচার বিবেচনা না করে কৌতুহলবশত আবেগের বশবর্তী হয়েই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ বয়সে ছেলে মেয়েরা অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আশাভঙ্গের বেদনায় হতাশার হাত ধরে নৈরাশ্যের অন্ধকারে পতিত হয় তাদের জীবন। ফলে কিশোর বয়সীরা ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। পরিবার কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, শহর ও বস্তির ঝুঁকি পূর্ণ পরিবেশ, এবং সমাজ জীবনের বিরাজমান নৈরাজ্য হতাশা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান অনুঘটক। অপসংস্কৃতির বাঁধ ভাঙা জোয়ার ও এ জন্য অনেক টা দায়ী। কিশোর অপরাধের প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শান্তি - শৃঙ্খলার অবনতি এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। শিশু কিশোর দ্বারা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পকেটমারের মতো অপরাধ জনগণের আর্থ সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। ছাত্রী অপহরন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি কাজ করে থাকে কিশোররা। কিশোর অপরাধের জন্য সমাজে মাদকাসক্তি ও যৌনাচারের প্রবণতা বেড়ে চলেছে যা সমাজ জীবনের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এছাড়াও জুয়া খেলা, নেশা করা, খেলার মাঠে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি,ট্রেনে বিনা টিকিটে যাওয়া, পরীক্ষায় নকল করা প্রভৃতি কাজ করে যাচ্ছে কিশোরেরা। কিশোর অপরাধের জন্য মূলত দায়ী পারিবারিক অসচেতনতা। শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী সমাজ এমনকি স্বল্পোন্নত সমাজে ও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভগ্ন পরিবার ও পিতা মাতার দাম্পত্য কলহ, চরম দারিদ্রতা, পিতা মাতার অবহেলা, শিশুশ্রম, জোর পূর্বক শিশুদের কাজে বাধ্য করা, খারাপ সঙ্গ দোষ, পিতা মাতার পুনর্বিবাহ, মা কর্মজীবী হওয়ায় পর্যাপ্ত শিশু যত্নের অভাব, অতিরিক্ত শাসন, স্বার্থপর ও ফন্দিবাজ রাজনীতীবিদ কতৃক কিশোরদের ব্যাবহার, নৈতিক শিক্ষার অভাব প্রভৃতির দরুন কিশোর কিশোরীরা ক্রমশঃ ঝুঁকে পড়ছে অপরাধের জগতে। কিশোর অপরাধের জন্য কেবলমাত্র কিশোরেরাই দায়ী নয়। এজন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যাবস্থা। সামাজিক অনুশাসন কমে যাওয়া, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, কিশোরদের রাজনৈতিক ব্যাবহারের কারনে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে,যা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। জনসমষ্টির সর্বাপেক্ষা প্রাণবন্ত অংশ হলো কিশোর সমাজ। এই কিশোর কিশোরীরা ই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির উপর নির্ভরশীল দেশ ও জাতির উন্নয়ন আজকের দিনে ও আমাদের ভবিষ্যতের আশা ভরসার স্থল কিশোর সমাজের বিপর্যয় সত্যিই দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক। কৈশোর হলো মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের সময়। এই সময় থেকেই মানুষ অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে শুরু করে। কিন্ত তারা আজকে ত্রুটি পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা তথা ঝুঁকি পূর্ণ পরিবেশের কারণে অকালেই আশাহত হয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্ত যথাযত কিশোর অপরাধ সংশোধন না হলে কালক্রমে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে যা জাতি ও দেশোন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি অশনি সংকেত। কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলদ্ধি করে আমাদের সকলের উচিত কিশোরদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনা। কিশোরদের সুষ্ঠু আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে আমাদের যত্নবান হতে হবে। তাদের মানসিক বিকাশে পিতা মাতাকে নজর রাখতে হবে। আধুনিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে কিশোর কিশোরীদের ভালোলাগা ও মন্দলাগাকে বিচার বিবেচনা করতে হবে। কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের জন্য গঠনমূলক পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। যারা জাতি ও দেশ গড়ার ভবিষ্যতের কারিগর, যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ,যাদের হাতে রচিত হবে আগামী প্রজন্মের সাফল্যের বীজ, তাদের কেই গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে বিচ্যুত করতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে সুষ্ঠু মূল্যবোধের মূলস্রোতে। নতুবা জাতি ও দেশোন্নয়ন হয়তো অনেকটাই ক্ষয়ীষ্ণু হয়ে পড়তে পারে। কেননা দেশ ও জাতির অগ্ৰগতিতে তাদের অবদানই সর্বাগ্ৰগণ্য। কিন্ত পরিতাপের বিষয় কিশোর কিশোরীদের গরিষ্ঠ অংশই জীবনের গড্ডালিকাপ্রবাহে ভাসমান ও উৎসাহহীন, আদর্শচ্যুত, সংকল্পশূন্য জীবনের গতানুগতিক ধারায় নিজের অস্তিত্বটুকু নিয়েই সন্তষ্ট।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct