অন্ধকার আফ্রিকার আলোকিত মুখ আল কিসওয়ানি
হাবিবা আক্তার
আফ্রিকা মহাদেশকে মনে করা হয় আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অঞ্চল। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগেনি এর বহু অঞ্চলে। তবু আফ্রিকার বহু বিজ্ঞানী আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। তাঁদেরই একজন উত্তর নাইজেরিয়ার মুসলিম বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আল-ফুল্লানি আল কিসওয়ানি।তিনি ছিলেন খ্রিস্টীয় অষ্টদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি আধুনিক নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় কাতসিনায় ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে মিসরের কায়রোতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর পুরো নাম মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ আল ফুল্লানি আল কিসওয়ানি। আল কিসওয়ানি কাতসিনার প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ ‘গোবারাউ মিনারেত’-এ লেখাপড়া করেন। লেখাপড়া শেষে এখানেই অধ্যাপনা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মিসরের কায়রোতে স্থায়ী হন। ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে কায়রো থেকে তাঁর ‘এ ট্রিয়েটাইজ অন দ্য ম্যাজিক্যাল ইউজ অব দ্য লেটারস অব দ্য আলফাবেট’ শীর্ষক গবেষণা প্রকাশ পায়। এটা মূলত ১১ ক্রম পর্যন্ত ম্যাজিক্যাল স্কয়ার তৈরির পাণ্ডিত্যপূর্ণ গাণিতিক পাণ্ডুলিপি। পাঠকদের উৎসাহিত করতে তিনি লেখেন, ‘অজ্ঞতার কারণে হাল ছাড়বেন না। এটা শিল্পের নিয়মানুসারে প্রস্তুত করা হয়নি। এটা প্রেমিকের মতো। কঠোর ও অবিরাম অধ্যবসায় ছাড়া আপনি সাফল্যের আশা করতে পারেন না।’
আল কিসওয়ানি গণিতের ম্যাজিক্যাল স্কয়ার নিয়ে গবেষণা করেন। ম্যাজিক বা ম্যাজিক্যাল স্কয়ার হলো নির্ধারিত দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের একটি বর্গক্ষেত্র, যার প্রতিটি সারি, কলাম ও তির্যক কোণের যোগফল সমান হবে। একইভাবে তিনি বিজোড় সংখ্যার ম্যাজিক্যাল স্কয়ার নিয়েও গবেষণা করেন এবং বিজোড় সংখ্যার ম্যাজিক্যাল স্কয়ার নির্মাণের সূত্র তৈরি করেন। মুহাম্মদ আল কিসওয়ানি নতুন ম্যাজিক স্কয়ার তৈরিতে জ্যামিতি ব্যবহার করেছিলেন। যেমন তিনি ‘তিন গুণ তিন’ একটি ম্যাজিক স্কয়ারের রূপান্তর ব্যবহার করে সাতটি নতুন ম্যাজিক স্কয়ার তৈরি করেন। যে রূপান্তরগুলোকে ডাইহেড্রাল গ্রুপ নামে পরিচিত। আল কিসওয়ানি ম্যাজিক্যাল ধ্রুবক বের করার সূত্র আবিষ্কার করেন। তা হলো n(n^2 + 1)/2। যেখানে এন ম্যাজিক স্কয়ারের সমান।মুহাম্মদ আল কিসওয়ানি কাতসিনার দান রাকো এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন, যা ছিল একটি বাণিজ্য নগরী। তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফলে তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন। মুহাম্মদ আল ওয়ালি আল বুরনাভি, মুহাম্মদ ফুদি, উসমান দান ফাদিয়ো, মুহাম্মদ আল বিন্দোর মতো খ্যাতিমান মুসলিম পণ্ডিতের কাছে তিনি পাঠ গ্রহণ করেন। ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি হজযাত্রায় বের হন। পশ্চিম আফ্রিকার তৎকালীন প্রচলন অনুসারে তারা প্রথমে কায়রোতে যাত্রা বিরতি দেন। মূলত এখানে হাজিরা হজের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নিতেন। আল কিসওয়ানি কায়রো ও হিজাজ সফরের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম পণ্ডিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের সুযোগ পান। ১৭৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দে হজ থেকে ফেরার সময় তিনি কায়রো থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যারয়ের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তাঁর কায়রোতে অবস্থানের উদ্দেশ্য ছিল গবেষণা ও লেখালেখিতে মনোযোগ দেওয়া। প্রথম চার বছরে তিনি ‘আল দুররুল মানজুম’, ‘বাহজাতুল আফাক’, ‘বুলুগুল আরব’ ও ‘দুরার আল ইয়াওকি’। আল কিসওয়ানি তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য অল্পদিনেই মিসরে পরিচিতি লাভ করেন। প্রখ্যাত মিসরীয় ইতিহাস গবেষক আবদুর রহমান আল জাবার্তির পিতা হাসান আল জাবার্তি ছিলেন আল কিসওয়ানির শিক্ষক। হাসান আল জাবার্তির বাড়িতেই ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪২ বছর। আল কিসওয়ানির গবেষণা কর্মগুলোর বেশির ভাগ কায়রোর আল আজহার পাঠাগার ও দারুল কুতুবে (জাতীয় গ্রন্থাগার) সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া মরক্কো, নাইজেরিয়া ও লন্ডনেও তাঁর কিছু গবেষণাকর্মের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি গবেষণাকর্ম হলো, আল মাওয়ালি ফি তারজামাতি মুহাম্মদ আল ওয়ালি, ইজালাতুল উবু আন ওয়াজহি আল-কুদ্দুস, কিতাবুদ দুর ওয়াল তিরয়াক ফি ইলমিল আওফাক এবং আল মুগনিল মাওয়াফি আন জামিয়িল কাওয়াফি।
তথ্যঋণ : মুসলিম হেরিটেজ, উইকিপিডিয়া ও প্রবন্ধ : আফ্রিকান ম্যাথমেটিশিয়ান অ্যান্ড হিজ ম্যাজিক স্কয়ারস
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct