দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা—সার্কের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (সাউ) নতুন ফরমান, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রকমের আন্দোলন করা যাবে না। ছাত্রছাত্রীরা কোনো আন্দোলনের শরিক হতে পারবেন না। পাশাপাশি নতুন শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিতে হবে, তাঁরা কোনো গুরুতর অসুখে ভুগছেন না। কারও কোনো মানসিক অসুখও নেই। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা—সার্কের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির (সাউ) নতুন ফরমান, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো রকমের আন্দোলন করা যাবে না। ছাত্রছাত্রীরা কোনো আন্দোলনের শরিক হতে পারবেন না। পাশাপাশি নতুন শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিতে হবে, তাঁরা কোনো গুরুতর অসুখে ভুগছেন না। কারও কোনো মানসিক অসুখও নেই। ২০২৩–২৪ শিক্ষাবর্ষে যেসব শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেককে এই দুটিসহ মোট ১৩টি বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। এই অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি (আন্ডারটেকিং) না দিলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হবে না। নতুন শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে এসব বিষয় ই–মেইল করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেন।সাউ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির টাকা জমা দেওয়ার পর এই শর্তাবলি জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মোট ১৩টি বিষয়ে অঙ্গীকার করতে বলা হয়েছে। এর একটি হলো—কোনো ধরনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করা, অন্যটি শরীর–স্বাস্থ্যের সুস্থতা সম্পর্কিত। আন্দোলন সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো সমস্যার সুরাহার চেষ্টায় কোনো রকমের ধর্মঘট করা যাবে না। আন্দোলনও করা যাবে না, যার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে কোনো বিষয় মেনে নিতে বাধ্য করা যায়। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর বা হোস্টেলের পরিবেশ নষ্ট হয়। পড়াশোনোয় বিঘ্ন ঘটে। এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও শোকজ নোটিশ পাঠিয়েছে। যেমন হোস্টেলে যেসব শিক্ষার্থী ইন্টারনেট যোগাযোগ উন্নত করার দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁদের শোকজ করা হয়েছিল।এবার এই আনুষ্ঠানিক ফরমান জারি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ‘অগণতান্ত্রিক’ ফরমান জারি করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ভারতকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বলে অভিহিত করেন। হঠাৎ এই ফরমান জারির কারণ গত বছরের ছাত্র বিক্ষোভ। গত শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃত্তিবৃদ্ধি ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটিতে পড়ুয়াদের প্রতিনিধি রাখার দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। পরিস্থিতির মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ তিনজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছিল। চারজন অধ্যাপককেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত (সাসপেন্ড) করা হয়। অভিযোগ, এক শিক্ষার্থী কর্তৃপক্ষের হয়রানি ও মানসিক অত্যাচারের দরুণ পঙ্গু হয়ে যান। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, শারীরিক সুস্থতার যে ‘আন্ডারটেকিং’ এবার দেওয়া হয়েছে, তা ওই কারণেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো দায়িত্ব নিতে যাতে অস্বীকার করতে পারে।
এই ফরমান জারি করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আজ শনিবার পর্যন্ত কোনো সংবাদমাধ্যমকে কোনো কিছু জানায়নি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত সাউ বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়। সার্কের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও অর্থায়নে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ত্রয়োদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ‘সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। উদ্দেশ্য ছিল, সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলোর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আন্তর্জাতিক মানের এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, যা আঞ্চলিক সমৃদ্ধি ঘটাবে। তরুণ সমাজের বৌদ্ধিক ও মননশীলতার উন্নতি ঘটাবে। মনমোহন সিংয়ের প্রস্তাবটি সার্কের শীর্ষ নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর সাউয়ের বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঐতিহাসিক ( বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা) গওহর রিজভীকে। সব সদস্য দেশের সঙ্গে বিস্তর আলোচনার পর তিনি সাউয়ের ‘কনসেপ্ট পেপার’ তৈরি করেছিলেন। ২০০৭ সালে নয়াদিল্লিতে চতুর্দশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সেই কনসেপ্ট পেপার গৃহীত হয়েছিল। নতুন ফরমান নিয়ে যোগাযোগ করা হলে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড থেকে ফোনে গওহর রিজভী আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং ঐতিহ্য বিবেচনায় আঞ্চলিক তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছিল। অন্যতম লক্ষ্য ছিল চেতনার বিকাশের পাশাপাশি সমাজের সর্বত্র প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে তোলা।’ গওহর রিজভী বলেন, ‘সেই সময় সবাই একমত হয়েছিলেন ভারতের অমর্ত্য সেন, বাংলাদেশের রেহমান সোবহান, পাকিস্তানের সৈয়দ বাবর আলীদের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন বোর্ড গঠিত হবে। দুর্ভাগ্য, সেটা হয়নি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জারি করা ফরমান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে গওহর রিজভী বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, অনেকবার বলেওছি, একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও সার্থকতা নির্ভর করে তার অবস্থান, অর্থনৈতিক শক্তি, অবকাঠামোর মতো অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার স্বশাসিত চরিত্র ও অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট হচ্ছে, দায়িত্বের পাশাপাশি স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া। এটা গণতন্ত্রেরও মূল কথা।’
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct