২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল অনেকটা অপ্রতিরোধ্য। তবে কংগ্রেস-বাম জোটের ভোট চলে গিয়েছিল বিজেপির বাক্সে। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল বলছে, সেই ভোট আবার বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেস-বাম জোটে ফিরছে। তবে ত্রিমুখী রাজনীতির উত্থানেরও ইঙ্গিত মিলছে, যার ফলে শঙ্কা আছে রক্তপাতের। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরপর আটটি নির্বাচনে জিতল। এর মধ্যে মাত্র একবার ২০১৯ সালে খেলা প্রায় ‘ড্র’ হয়ে গিয়েছিল। ওই নির্বাচনে লোকসভার ৪২ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৮, তৃণমূল ২২। এ ছাড়া প্রতিবারই স্বচ্ছন্দে জিতেছে তৃণমূল। এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রতিটি স্তর—একেবারে নিচের স্তর অর্থাৎ গ্রাম পঞ্চায়েত, মধ্যের স্তর অর্থাৎ পঞ্চায়েত সমিতি এবং শীর্ষ স্তর জেলা পরিষদে তাদের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বজায় রাখতে পেরেছে তৃণমূল। অবশ্য জয় কীভাবে এসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নির্বাচন নিয়ে বিরোধীরা আদালতে জনস্বার্থ মামলা করেছেন। সেই মামলার রায় হয়তো বেশ কিছু জয়ী প্রার্থীর বিপক্ষে যেতে পারে। রাজ্যে মোট ৩ হাজার ৩১৭ গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। এসব পঞ্চায়েতে মোট আসন রয়েছে ৬৩ হাজার ২২৯। ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, তৃণমূল ২ হাজার ৬৪১ পঞ্চায়েত বা ৮০ শতাংশ জয়ী হয়েছে। আবার পঞ্চায়েতের মোট ৬৩ হাজার ২২৯ আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ৪৩ হাজার ৩৫০ আসন বা ৬৯ শতাংশ। মামলার কারণে কিছু আসনের ফলাফল গতকাল সোমবার পর্যন্ত ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।আরও দুটি স্তর, অর্থাৎ পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদেও চিত্র মোটামুটি একই। সর্বোচ্চ জেলা পরিষদে বিরোধীদের অবস্থা আরও করুণ। ২০ জেলা পরিষদের মধ্যে সব কটি পেয়েছে তৃণমূল। ওই ২০ পরিষদের ৯২৮ আসনের মধ্যে ৮৮০ বা ৯৫ শতাংশ পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল। পঞ্চায়েত সমিতির তথ্য দিয়ে লেখাকে আর ভারাক্রান্ত করছি না। বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আরেকটি পরিসংখ্যান দিতে চাই। পঞ্চায়েতে ৪ কোটি ভোটের মধ্যে ২ কোটির বেশি অর্থাৎ প্রায় ৫২ শতাংশ পেয়েছে তৃণমূল। আর বিজেপি ২৩, বামফ্রন্ট ১৩ দশমিক ৫ এবং কংগ্রেস ৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে।
রিভার্স সুইং
ভারতে সর্বশেষ নির্বাচনের সঙ্গে আগের নির্বাচনের তুলনা করলে সেটা ঠিক অর্থবহ হয় না। আগের পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালে। সেই নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৪ শতাংশ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি বিরোধীরা। সেই তুলনায় এবার বিরোধীরা অনেক বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছেন। এবার মোটামুটি ১০ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা। এই নির্বাচনের ভোটের হারকে তুলনা করতে হচ্ছে আগের দুটি নির্বাচনের সঙ্গে, যেসব নির্বাচনে অস্বচ্ছতার কোনো অভিযোগ ওঠেনি। কারণ, নির্বাচন করিয়েছিল কেন্দ্রীয় কমিশন। এই দুটি নির্বাচন হলো ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২২ সালের লোকসভা। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৩ দশমিক ৬ এবং বিজেপি ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। এ ছাড়া বামফ্রন্ট ৭ দশমিক ৫ এবং কংগ্রেস ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল প্রায় ৪৮, বিজেপি ৩৮, কংগ্রেস প্রায় ৩ এবং বামফ্রন্ট ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট। এর সঙ্গে মুসলমানপ্রধান দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টকে (আইএসএফ) জোড়া যায় (তারা বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ছিল)। তাহলে বাম জোটের (বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ) ভোট গিয়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশে।অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে একদিকে দক্ষিণপন্থী জোটের ভোট উত্তরোত্তর বাড়তে বাড়তে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে; অন্যদিকে বাম জোটের ভোট কমতে কমতে ১০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। বিশ্লেষকেরা বছর দুয়েক আগে মনে করেছিলেন, ভবিষ্যতে বিজেপির ভোট আরও বাড়বে এবং ক্ষমতাসীন হাওয়ায় তৃণমূলের ভোট কমবে। ফলে শিগগিরই বিজেপি স্থানীয় নির্বাচনে তৃণমূলকে হারানোর মতো অবস্থানে চলে আসবে।বাস্তবে সেটা হলো না। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা যেটা দেখলাম, ক্রিকেটের পরিভাষায় সেটাকে ‘রিভার্স সুইং’ বলে। বিজেপির ভোট ৪০ শতাংশের আশপাশ থেকে নেমে এল ২৩ শতাংশে। আর বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোটের ভোট ১০ শতাংশের নিচে থেকে চলে গেল প্রায় ২০ শতাংশে (বামফ্রন্ট ১৩ দশমিক ৫, কংগ্রেস ৬ দশমিক ৫)। এর সঙ্গে মুসলমানপ্রধান দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) সামান্য ভোট যোগ করলে তা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২১ শতাংশে।স্বাভাবিকভাবেই এই পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘুরে দাঁড়ানোর নির্বাচন বলে মনে করছে বাম-কংগ্রেস জোট। সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূল বনাম বিজেপি যে দ্বৈরথ তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, তা ভেঙে গেছে। এই নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছেন।’ মহম্মদ সেলিম অতীতে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার ভয় দেখিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি ভোটের মেরুকরণ করে, যা নিশ্চিহ্ন করে দেয় বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলকে। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল বামফ্রন্ট। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাম-কংগ্রেসের ভোট বিজেপিতে যেতে শুরু করে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকে। সর্বশেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথম দেখা গেল, বিজেপির ভোট আবার বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসে ফিরতে শুরু করেছে।
একটি সতর্কবার্তা
একটা সতর্কবার্তা এখানে দিতেই হচ্ছে। কারণ, সেটা দিয়েছেন ভারতের অন্যতম চর্চিত নির্বাচনী পরিসংখ্যান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় কুমার। তিনি দিল্লির গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিসের (সিএসডিএস) অধ্যাপক এবং ভারতে নির্বাচন বিশ্লেষণের প্রোগ্রাম সিএসডিএসের ‘লোকনীতি’র সহপরিচালক।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct