রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর, বিস্তৃত ও পুরোনো। ভারতের সামরিক সরঞ্জামের বড় জোগানদার রাশিয়া। আবার দেশটি চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। ফলে দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সত্যি কি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে ভারত? লিখেছেন অরুন্ধতী রায়।
অধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচকদের নো-ফ্লাই লিস্টে (আচরণগত সমস্যার কারণে বিমানে ওঠায় নিষেধাজ্ঞা) ফেলা কিংবা ভারতীয় ও বিদেশি শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের চাপে রাখার খবরও তাদের অজানা থাকার কথা নয়। মুক্ত সাংবাদিকতার সূচকে ভারতের অবস্থান এখন ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে সেরা ভারতীয় সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি একটি সংস্থা সিদ্ধান্ত নেবে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও মতামতের কোনটি মিথ্যা অথবা বিভ্রান্তিকর। যুক্তরাষ্ট্রের জানা উচিত ছিল কাশ্মীরের কথা, যেখানে ২০১৯ সালের প্রথমার্ধ থেকে মাসজুড়ে যোগাযোগব্যবস্থা অচল করে রাখা হয়েছিল। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কাল সবচেয়ে দীর্ঘ। কাশ্মীরের সাংবাদিকেরা হয়রানি, গ্রেপ্তার ও জেরার মুখে পড়ছেন। এই একুশ শতকে গলার ওপর বুট নিয়ে তাঁরা যেভাবে বেঁচে আছেন, সেভাবে কারও বাঁচার কথা নয়। তাদের জানা উচিত ছিল, ২০১৯ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের কথা, যেখানে ন্যক্কারজনকভাবে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। জানা দরকার ছিল, কীভাবে পরের বছর দিল্লিতে কয়েক ডজন মুসলমানের প্রাণহানির পরই এই আন্দোলন স্তিমিত হয়েছিল। (কাকতালীয়ভাবে, এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফরে এসেছিলেন, এ নিয়ে একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি)। তাদের আরও জানা উচিত ছিল, যখন তারা মোদির প্রশংসায় ভাসছে, তখন মোদির দলের সঙ্গে সম্পর্কিত চরমপন্থী হিন্দুরা উত্তর ভারতের ছোট্ট একটা শহরে মুসলিমদের দরজায় ‘এক্স’ লিখে রেখেছে, তাদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হুমকি দিচ্ছে। শক্তিমানদের মুখের ওপর সত্য কথা বলতে হবে—এই আপ্তবাক্য থেকে আমাদের অবসর নেওয়ার সময় এসেছে। শক্তিমানেরা আমাদের চেয়েও ভালো সত্য জানে। সবকিছুর ওপরে বাইডেন প্রশাসনের এ-ও জানা উচিত, এই মহাজাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনা এবং ভুয়া চাটুকারিতা ২০২৪ সালের নির্বাচনে মোদির জন্য সোনার চেয়েও দামি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ২০১৯ সালে ট্রাম্পের পক্ষে মোদি প্রকাশ্যে প্রচার চালিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অভিবাসী ভারতীয়দের বিরাট সমাবেশে তিনি উপস্থিত জনতাকে ট্রাম্পের পক্ষে আটঘাট বেঁধে নামতে বলেন। তাঁর স্লোগান ছিল, ‘আব কি বার, ট্রাম্প সরকার!’ (ট্রাম্পের সরকার আবার দরকার)। তারপরও বাইডেন আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বিভাজনপ্রেমী একটি চরিত্রের জন্য সর্বোচ্চটাই করলেন। কিন্তু কেন? সিএনএনে ক্রিস্টিনা আমনপোরের সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাক্ষাৎকার এ ব্যাপারে আমাদের আলোকিত করতে পারে। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, এই সাক্ষাৎকারও হোয়াইট হাউসের পরিকল্পনায় করা। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, একজন ‘কর্তৃত্বপরায়ণ ও একদেশদর্শী’ হিসেবে অনেকের কাছে বিবেচিত মোদির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আচরণ কেমন হওয়া উচিত। জবাবে ওবামা বলেন, ‘অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার নানা ইস্যু মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিবেচনা করতে হয়। আমরা ভারতের কাছ থেকে শুনি। আর যা শুনি তা হলো, ওহ চীন। ওরা তো মূর্খ।’ওবামা আরও বলেন, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া না হলে একটা পর্যায়ে ভারত ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। এবার তিনিও ভারতে ট্রলের শিকার হলেন।মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি অন্য দেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও কাজের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনার সুযোগ পান, তাহলে অন্য দেশের ক্ষেত্রেও তাঁকে সেই সৌজন্য দেখাতে হবে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, ভারত তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কেমন বন্ধু হতে পারে?
চীনের চ্যালেঞ্জ কতটা নেবে ভারত
পূর্ব এশিয়ায় ওয়াশিংটনের শীর্ষ প্রতিনিধি বলেছেন, তাঁরা দক্ষিণ চীন সাগরে টহল বাড়াতে ভারতের সহযোগিতা চান। চীন দক্ষিণ চীন সাগরের এই অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করায় পরিস্থিতি অনেক দিন গুমোট হয়ে আছে। এখন পর্যন্ত ভারত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু তারা কি এই খেলায় সেভাবে জড়ানোর ঝুঁকি নেবে? রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর, বিস্তৃত ও পুরোনো। ভারতের সামরিক বাহিনীতে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় ৯০ ভাগের জোগানদার রাশিয়া। যুদ্ধবিমানসহ বিমানবাহিনীর ৭০ ভাগ সরঞ্জাম রাশিয়ায় তৈরি। রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন ভারত। রাশিয়ার তেলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে, এমনকি গত জুনেও রাশিয়া থেকে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ব্যারেল (২২ লাখ ব্যারেল) তেল ভারত রাশিয়া থেকে কিনেছে। ভারত সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে চীন থেকে। তার পক্ষে সত্যিকারভাবে চীনকে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন। ভারতের সঙ্গে চীনের আসলে তুলনাই হতে পারে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে হোক কিংবা সামরিক। বছরের পর বছর হিমালয়ের লাদাখে হাজার হাজার বর্গমাইল চীন দখল করে রেখেছে। যদিও এই অঞ্চলকে ভারত সার্বভৌম বলে দাবি করে থাকে। এখানে চীনের সৈনিকেরা শিবিরে থাকছেন। এই অঞ্চলের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের জন্য সেতু, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামোও তৈরি হয়েছে। টিকটক নিষিদ্ধ করা ছাড়া মোদি সরকারের আচরণ চীনের সঙ্গে ছিল ভিতু ও মিনমিনে। যুক্তরাষ্ট্রের কেমন মিত্র হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্র হবে না। হেরে যাওয়া কিংবা দুষ্কর্মের দোসর হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হেলিকপ্টারে ঝুলতে ঝুলতে পালানো ছাড়া তেমন কোনো মূল্য তাদের চোকাতে হবে না। কিন্তু আমাদের তাকাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো বন্ধু আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের দিকে। দক্ষিণ চীন সাগরে পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছে। কিন্তু ভারত, তার মিত্র ও শত্রুদের সবাই একটা শক্ত মোড়কের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। আমরা কোথায় পা রাখছি, নৌকা কোন দিকে ভাসাচ্ছি, সেদিকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। প্রত্যেকেরই সতর্ক থাকা উচিত।
সৌ: প্র: আ:
মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct