রাশিয়া ও চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর, বিস্তৃত ও পুরোনো। ভারতের সামরিক সরঞ্জামের বড় জোগানদার রাশিয়া। আবার দেশটি চিন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। ফলে দক্ষিণ চিন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সত্যি কি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে ভারত? লিখেছেন অরুন্ধতী রায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকে বিশ্বের বৃহত্তম দুই গণতান্ত্রিক দেশের নেতার সাক্ষাৎ বলে আখ্যা দিয়েছে ওয়াশিংটন। গত মাসে মোদির সফরকালে দুই দেশের নেতারা নিজেদের ‘ঘনিষ্ঠতম অংশীদার’ বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু অংশীদার হিসেবে তারা কেমন হবে? কেমন হতে পারে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেছেন, তাঁর প্রশাসনের মূলনীতি হলো গণতন্ত্রের সুরক্ষা। চমৎকার কথা। কিন্তু ওয়াশিংটনে যা হলো, তা একেবারে উল্টো। গত মাসে আমেরিকানরা প্রকাশ্যে যে মানুষটির এত সুখ্যাতি করলেন, তিনি আসলে ধারাবাহিকভাবে ভারতের গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করছেন।যুক্তরাষ্ট্র কাদের বন্ধু হিসেবে পছন্দ করে, তা নিয়ে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। খুবই ‘চিত্তাকর্ষক’ লোকজনকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বন্ধু হিসেবে লালন-পালন করে। যেমন ইরানের শাহ, পাকিস্তানের জেনারেল মো. জিয়াউল হক, আফগান মুজাহিদীন, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের কিছু ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’গোছের স্বৈরশাসক এবং চিলির অগাস্তো পিনোশে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির মূল কথা অনেকটা এমন—তাদের জন্য গণতন্ত্র আর তার অশ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের জন্য একনায়কতন্ত্র। মোদিকে এই দলে ঠিক ফেলা যায় না। ভারত তাঁর চেয়েও অনেক বড় কিছু। ভারত তাঁকে একদিন বিদায় করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কখন? এবং কিসের বিনিময়ে? ভারতে একনায়কত্ব নেই, কিন্তু গণতন্ত্রও নেই। মোদি একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ, হিন্দু জাতীয়তাবাদী, নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে—বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় দেশটির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। নির্বাচনের সময় এ-ই হয় দেশটির চেহারা। নির্বাচন এখন দুয়ারে, আর এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। এটা খুনখারাবির সময়, পিটিয়ে হত্যার সময় এবং সমাজের একটি অংশকে দলে ভেড়ানোর সময়। যুক্তরাষ্ট্র আসলে যে বন্ধুকে লালন-পালন ও ক্ষমতাবান করছে, সেই বন্ধুটি বিপজ্জনক একজন মানুষ। বিপজ্জনক শুধু মানুষ হিসেবে নন; বরং তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি কিনা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্রকে একটি সিন্দুকে পুরতে চাইছেন।
হোয়াইট হাউসে মোদিকে প্রশ্ন এবং ভক্তকুলের প্রতিক্রিয়া মোদি কেমন গণতান্ত্রিক, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় কখনোই কোনো সংবাদ সম্মেলন করেন না? মোদিকে প্ররোচিত করার যত ক্ষমতা আছে যুক্তরাষ্ট্রের, তাঁকে তুষ্ট করতে সব কটাই কাজে লাগায় তারা। তারপরই ওয়াশিংটনে একটি সংবাদ সম্মেলনে আসতে রাজি হন মোদি। তিনি দুটি প্রশ্ন নিতে সম্মত হন। এর একটি করেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর হোয়াইট হাউস রিপোর্টার সাবরিনা সিদ্দিকী। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, বিশেষত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা বৈষম্য রোধে তাঁর সরকার কী করছে, এ-ই ছিল প্রশ্ন। ভারতে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের ওপর অবমাননাকর আচরণের প্রেক্ষাপটে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন তা করল না, তারা একজন সাংবাদিকের দিকে প্রশ্নটি ঠেলে দিল। আর ভারতে আমরা সবাই দম আটকে বসে থাকলাম। মোদি প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। যেন এই প্রশ্ন করা উচিত হলো কি না, তা-ই তিনি বুঝতে পারছেন না। এরপর তিনি ভারত থেকে থলে ভরে যত একপেশে মন্তব্য নিয়ে ওয়াশিংটনে এসেছিলেন, তা-ই ঢেলে দিলেন। ‘গণতন্ত্র আমাদের ধর্ম। গণতন্ত্র আমাদের ধমনিতে প্রবাহিত। আমরা গণতন্ত্রে বাস করি। আমাদের দেশে কোনো বৈষম্য নেই’ ইত্যাদি ইত্যাদি।ভারতে মূলধারার গণমাধ্যম ও মোদির যে বিশাল ভক্তকুল আছেন, তাঁরা এই জবাবে এমন ভাব করলেন, যেন মোদি সপাটে বল ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আর যাঁরা এই কথার সঙ্গে একমত পোষণ করেননি, তাঁরা ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই’-এর মতো করে আশ্বস্ত হতে একটা কিছু হাতড়ে বেরিয়েছেন। (‘বাইডেনের ভাবভঙ্গি দেখেছেন? একদম বৈরী’ ইত্যাদি ইত্যাদি।) আমি এই কপটতায় কৃতজ্ঞ। ভেবে দেখুন, মোদি যদি আত্মবিশ্বাসী হয়ে সত্য বলে দিতেন! তাঁর এই কপটতা আমাদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তো দিল, তা যতই ছেঁড়াখোঁড়া আর দীনহীন হোক না কেন। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) চিয়ারলিডার এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এবার নির্মমভাবে টুইটারে ওই সাংবাদিকের ওপর চড়াও হলেন। তাঁরা সাবরিনাকে ভারতবিরোধী অ্যাজেন্ডার পাকিস্তানি ইসলামপন্থী একজন ঘৃণাজীবী হিসেবে চিত্রায়িত করলেন। অবশেষে হোয়াইট হাউস এই হয়রানির নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘এই আচরণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী’। হোয়াইট হাউস যা কিছু চকচকে জিনিস দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছিল, তা এ ঘটনায় খুবই বিব্রতকরভাবে বেরিয়ে পড়ল।সাবরিনা বোধ হয় বুঝতেও পারেননি, তিনি কিসের মধ্যে পড়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউসের বেলায় অবশ্য এ কথা প্রযোজ্য নয়। তারা ঠিকই ভালোভাবে জানত, লালগালিচা কার জন্য পেতেছে। মোদি সম্পর্কে কি বাইডেন প্রশাসন জানে না ২০০২ সালে গুজরাটে গণহত্যায় মোদি যে তাঁর ভূমিকার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন, সেটা তাদের জানা। ওই ঘটনায় এক হাজার মুসলিম নিহত হন। তারা এ-ও জানে, নিয়মিত বিরতিতে মুসলিমদের জনসমক্ষে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মোদির মন্ত্রিসভার এক সদস্য আবার সেই হত্যাকারীদের গলায় ফুলের মালা পরিয়েছেন। মুসলিমদের কীভাবে আলাদা করা হচ্ছে এবং শহরের এক কোণে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এসবও তাদের হয়তো অজানা নয়। তাদের এ-ও হয়তো জানা আছে, কীভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, ছাত্র, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। তাঁদের কেউ কেউ লম্বা সময় কারাগারে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণ, ইতিহাসের পাঠ্য নতুন করে লেখা, ছবি নিষিদ্ধ করা, ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বন্ধ করা, বিবিসির কার্যালয়ে অভিযান—এ সবকিছুও তাদের জানার কথা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct