বাংলায় সদ্য শেষ হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তবে, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের বিরাম নেই। আসলে, বাংলায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ভারতের অনান্য রাজ্যে যখন ভোটকেন্দ্রীক রাজনৈতিক হিংসা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে- ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।’ আলোকপাত করলেন- ওহিদ রেহমান।
সালটা ১৮৬৩। সেই বছরের জুলাই মাসে আমেরিকার পেনসেলভেনিয়ার গেটিসবার্গে ঘটে গেছে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের অকাল বলি প্রায় হাজার আটেক মানুষ। মাস চারেক পর আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন, সেই গৃহযুদ্ধে প্রয়াতদের স্মরনে নির্মিত স্মৃতিসৌধের পাদদেশে এক স্মরণ সভায় যোগ দেন। সেখানে রাষ্ট্রপতি লিংকনের বক্তব্য ছিল মাত্র ৩ মিনিটের। তিনি সেই বক্তব্যে মেরেকেটে মোট শব্দ খরচ করেছিলেন ২৭০ থেকে ২৭৫ টি। কিন্ত গণতন্ত্রের ইতিহাসে সেই ৩ মিনিটের বক্তব্য নিঃসন্দেহে থাকবে উপরের সারিতে। সেই সভায় রাষ্ট্রপতি লিংকনের বজ্রকন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল- “জনগনের সরকার, জনগনের দ্বারা সরকার এবং জনগনের জন্য সরকার পৃথিবী থেকে কখনো হারিয়ে যাবে না।” ব্যাক টু বাংলা। হ্যাঁ, স্থান কাল পাত্র ভেদে লিংকনের কন্ঠে উচ্চারিত সেই সরকার এই বঙ্গে ও আছে বহাল তবিয়তে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জৌলুসে উদ্ভাসিত, সেই সরকারের রূপ রস গন্ধ কেন্দ্র রাজ্য ছাড়িয়ে, মহাত্মা গান্ধীর মানসকন্যা ত্রিস্তর পঞ্চায়েত আজ সাগর পাহাড় জঙ্গলমহলের সর্বত্র গর্বের উপস্থিতি ফেরি করে চলেছে। সেই সাথে ফেরি করে চলেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার স্বজন হারাদের শূন্য উঠানে বুকফাটা আহাজারি। স্কুল নির্বাচন হোক কিংবা দিল্লীর মসনদ, বাংলার দামাল ছেলেরা খেলে সোজা ব্যাটে, একইরকম ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে। কোচবিহার টু কাকদ্বীপ ভায়া নবাবের অলিন্দের আলালরা বাংলাকে আজো বুক চিতিয়ে ভোট সেলামী দেয়। ভোটের খবর হতেই, কেরল থেকে কর্নাটক, চেন্নাই থেকে চাঁদনীচক, তারা ঘরমুখো হয় বাস ট্রেনের অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে। ভোট পর্বের সেলামীর তোড়ে কারো কারো আর ফিরতি ট্রেন ধরা হয়ে ওঠেনা। লাশের কপিরাইট নিয়ে, শাসক বিরোধী আলাদা আলাদা প্রেস রিলিজ করে। বিবি হয়ে যায় বেওয়া। বাপ হারানো, ভাই হারানো বছর দশ-বারোর জামাল, রফিকরা স্কুলের গন্ডি ছেড়ে সংসারের হাল ধরতে বিদেশ (আদতে ভারতবর্ষেই থাকে) যায়। তারপর ফিরতি ট্রেনে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে না পেরে, আর একদফা চড়-থাপ্পড় খায়।
বাংলায় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নতুন কিছু নয়। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তাদের অভিমত, ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত প্রাদেশিক আইন সভায় জনগণের ভোটদানের অধিকারের মধ্যে দিয়ে এই প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক ধারার সূচনা এই বাংলায়। সেই নির্বাচনে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে চমকপ্রদ ফল করে অবিভক্ত বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’, ‘ঘাম যার দাম তার’ শ্লোগানের মাধ্যমে বাংলার তৎকালীন জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রচারণা চালিয়ে এই সফলতা অর্জন করে কৃষক প্রজা পার্টি। প্রাদেশিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের ঘোষিত ১৪ দফা দাবিতে ছিলঃ ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমিদারি প্রথা বিলোপ, প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন, খাজনা ও ঋণ মওকুফ, নজর-সেলামি-আবওয়াব বাতিল, মহাজনী আইন বাতিল, কৃষকদের জন্য সুদ মুক্ত ঋণ চালু প্রভৃতি। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে একাধারে মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে কৃষক প্রজা পার্টির এই সফলতা আক্ষরিক অর্থেই ছিল বাংলার হিন্দু মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিজয়গাঁথা। এই লড়াই এখানেই থেমে থাকেনি। পরবর্তী সময়ে হাজী মোহাম্মদ দানেশ, ইলা মিত্রদের হাত ধরে বাংলার দানা বাঁধে ‘তেভাগা’ আন্দোলন। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এর মধ্য দিয়ে ইংরেজ প্রবর্তিত জমিদারী প্রথার রাশ ধীরে ধীরে আলগা হতে থাকে বাংলা থেকে। ষাটের দশকের অতি বামপন্থীদের ‘নকশালবাড়ি আন্দোলন’, সামন্তপ্রভুদের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয়। ১৯৭৭ সালে বাংলার মসনদ দখল করে বামপন্থী সরকার। তাদের প্রবর্তিত ভুমি সংস্কার নীতি সারা দেশে সমাদৃত হয়। এই কারনেই, ভারতবর্ষের অন্যান্য যেকোন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ এবং মাঝারি জমির মালিকানার অনুপাত সবচেয়ে কম। অন্যদিকে, বামপন্থীদের রাজনীতির অদ্ভূত সমাপতন ঘটে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ এই ঘটনাপ্রবাহে বাংলা জুড়ে অনেক মায়ের কোল খালি হয়েছে।
কাট টু আজকের বাংলা। রাজ্যে সদ্য শেষ হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। ত্রিস্তর (গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ) বিশিষ্ট এই নির্বাচনে মোট আসন সংখ্যা ৭৩৮৮৭। দুই লক্ষাধিক প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বাংলা জুড়ে ৫ কোটি ৬৭ লক্ষ মানুষ, এই নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এই নির্বাচনের ফলাফলে, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। তারা বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে অধিক জনসমর্থন (৫১.১৪ শতাংশ) লাভের মধ্যে দিয়ে গ্রামীণ রাজনীতির ব্যাটন নিজদের হাতে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কাগজে কলমে এই আয়োজন নিঃসন্দেহে আদন্ত ভোট উৎসব। কিন্তু, উৎসবের এই চেনা সুরের ছন্দ কাটছে অন্যত্র। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হিংসা, বাংলার ভোট উৎসবকে আতঙ্কে পরিণত করেছে। আসুন, চোখ রাখি এই নির্বাচনে রাজনৈতিক হিংসার খতিয়ানে। ৮ জুন ভোট ঘোষণা পরবর্তী সময় থেকে নির্বাচন উত্তর (১৪ জুলাই পর্যন্ত) সময়াবধি প্রায় ৪১ জন (সংখ্যা নিয়ে মতান্তর রয়েছে) আমাদের সহনাগরিক নির্বাচনী হিংসার বলি এই বাংলায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, প্রয়াতদের সিংহভাগ শাসক দলের সমর্থক। তবে, বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ঘটনা বিরল নয়। বাংলায় গনতন্ত্রের এই মেগা আয়োজন বারংবার হয়েছে রক্তস্নাত। বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিকুজি ঘাটলে আমাদের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর হবে। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার বলি হন ৭৬ জন। ২০০৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৬। ২০১১ সালে বাংলায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও, পঞ্চায়েত এবং অন্যান্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিহিংসার রাজনীতি রয়ে যায় সেই তিমিরেই। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মারা যায় ৩৯ জন বঙ্গবাসী। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ২৯ জন। তাই, এস.ওয়াজেদ আলীর সুরে সুর মিলিয়ে বলাই যায়,- ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেষ দুই দশকে বাংলার ঘরে ঘরে শুধু লাশ আর লাশ। রাজনৈতিক এই সহিংসতার বলি গ্রামীণ বাংলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কৃষক, মুটে-মজুর, ভাগচাষি। তাদের রাজনৈতিক অভীপ্সা সামান্যই। মূলতঃ কলকাতার বাবুদের রাজনৈতিক মাইলেজের অনুঘটক হিসেবে তারা কাজ করে। দিনশেষে তাই, স্বজনহারাদের বোবা কান্নায় বাংলার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে প্রতিটি নির্বাচনোত্তর পরবর্তী সময়ে। শেষ করবো একটি গানের গল্প দিয়ে। ১৯৬২ সালে আমেরিকার বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী বব ডিলান নাগরিক অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি গান লেখেন। গানের কথাগুলো ছিল: How many roads must a man walk down Before you call him a man?পরবর্তী সময়ে কবীর সুমন সেই গানের ভাবানুবাদ করে লিখলেন:
“কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়।”সেই সুরে সুর মিলিয়ে, বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রতাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে,কতটা রক্ত ঝরলে তবে গণতান্ত্রিক হওয়া যায় ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct