স্বপ্নের চোরাবালি
আহমদ রাজু
দরজার পাশে লাগানো কলিংবেল চাপতেই বাবা দরজা খুলে দিয়ে বললেন,’আয়; আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?’ ‘না আব্বা।’আমি রুমের ভেতরে ঢুকে টেবিলের ওপর ব্যাগ রেখে তার থেকে লুঙ্গিটা বের করি। প্যান্ট-শার্ট খুলে আলনায় রেখে লুঙ্গিটা পরে খাটের ওপর নিজেকে এলিয়ে দিই। এসি রুম। না চাইলেও একটু পরে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমার ক্লান্তি দেখে বাবা বললেন,’তুই ঝটপট গোসলটা সেরে নে। আমি ততক্ষণে নাস্তার কথা বলছি।’ আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি। ফ্রেস হয়ে যখন বের হই তখন দেখি টেবিলের ওপর গরম পরটা, ডিম-ডালভাজি আমার জন্যে অপেক্ষায় আছে। অন্যদিন হলে খিদেয় পেটটা চো চো করতো। আজ অবশ্য তা একবারের জন্যেও করছে না। বরং খাবারের কথা আমার মনের ভেতরে আসেনি একবারও। মা যে খাবার দিয়ে দিয়েছিলেন তা হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ‘নে খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিবি।’ ‘আপনি খাবেন না?’আমি বাবাকে প্রশ্ন করি। ‘না; তুই খা। আমি কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।’ আমি খাওয়া শুরু করেছি। বাবা বললেন,’আমি বাইরে যাচ্ছি। আসতে রাত হয়ে যেতে পারে। দুপুরে খাবার দিয়ে যাবে রুমে। কোন সমস্যা নেই তো?’ ‘না আব্বা, কোন সমস্যা নেই।’ ‘কোন কিছুর দরকার হলে ম্যানেজারকে জানাস।’ আমি মুখে উত্তর না দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াই। বাবা বাইলে চলে যায়। আমি নাস্তা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুরে ওয়ার্ড বয় খাবার দিয়ে গেলেও সেটা খাওয়া হয় না। ঘুমের মধ্যে কখন দরজা খুলে দিয়েছি- কখন সে খাবার দিয়ে গেছে কিছুই মনে নেই। ঘড়ির কাটা যখন পাঁচটার ওপর তখন ওয়ার্ড বয়ের কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বলল,’আপনাকে কেউ ফোন করেছে; আসুন তাড়াতাড়ি।’ কে ফোন করেছে তা জানতে বাকী থাকে না। কারণ এর আগে কেউ কোনদিন ফোন করে আমাকে চায়নি। আজ যখন ফোন এসেছে তখন মার্টিনা স্মিথ ছাড়া আর কেউই হতে পারে না। আমি তড়িঘড়ি নিচতলায় অফিস রুমে যাই। ম্যানেজার রিসিভারটা আমার হাতে দিয়ে বলল,’কথা বলো লাইনে আছে।’ আমি কাঁপা কাঁপা হাতে সিরিভারটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম,’হ্যালো।’ স্বভাব সুলভ ভাঙা বাংলায় মার্টিনা স্মিথ বলল,’হ্যালো হামাকে ভুলিয়া গিয়াছেন নাকি?’ আমি থতমত খেয়ে যাই। এদিক ওদিক তাকায়। সামনে হোটেল ম্যানেজার বসে তার কাজে ব্যস্ত। দু’চারজন সোফায় বসে টিভি দেখছে। বুঝতে পারি যা কিছু বলতে হবে, এদের ভেতরে থেকেই বলতে হবে। বললাম,’সেটা কী সম্ভব?’ ‘তাহা হইলে ফোন ধরিতে দেরি হইলো?’ ‘আসলে হোটেলের অফিস রুম নিচে। আমি আছি তিন তলায়। নামতে যতটুকু সময় লেগেছে এই যা।’ ‘কী খরিতেছিলেন?’ ‘ঘুমিয়ে ছিলাম।’ ‘হামিও সেই সকাল থেকে ঘুমাইয়া ছিলাম। ঘুম থেকে উঠিবার ফর হাপনার কথা মনে হইলো থাই ফোন খরা।’ ‘আমারও আপনার কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়েছে। কিন্তু আপনার হোটেলের নম্বর আমার কাছে নেই। যে কারণে ফোন করা হয়নি। আপনি যদি হোটেলের ফোন নম্বরটা দিতেন।’ ‘তাহার আর দরকার হইবে কী? সানডে তো হামরা চলিয়া যাইতেছি। যে নম্বরটা দিয়াছি ওঠা যত্ন করিয়া রাখিবেন। এ্যামেরিকায় যাইয়া হাপনার সাথে কথা হইবে।’ আমি মনে মনে বললাম,’যত্ন কী, আমিযে হৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছি। ঐ নম্বরটাই হয়তো তোমাকে আমার আরো কাছে নিয়ে আসবে।’ আমার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে মার্টিনা স্মিথ বলে ওঠে,’কী হইলো খথা ভলিতেছেন না যে?’ আমি সঞ্চিৎ ফিরে পেয়ে বললাম,’আপনি টেলিফোন নম্বর দিয়েছেন আর আমি তাকে অবজ্ঞা করবো তাই কি হয়?’ ‘হামি তা বলিনাই। আচ্ছা যাইবার হাগে হাপনার সাথে হামার কি দেখা হইতে ফারে না।’ ‘অবশ্যই পারে। কোথায় দেখা করবো বলুন।’ ‘ঢাকা হামি খম্ বেশি চিনি। হাপনি বলুন খোথায় হাপনি হাসিবেন।’ ‘তাহলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে আসুন।’ ‘খাল্ সকাল এগারোটায় হাসিতে আপত্তি নেই তো?’ ‘আপত্তি কি বলছেন! আসতেতো আমাকে হবেই।’ ‘থ্যাংকউ। হামি হাপনার হপেক্ষায় থাকিবো।’ মার্টিনা স্মিথ লাইন কেটে দেয়। আমি রিসিভারটা রেখে দিয়ে মনের আনন্দে সিঁড়ি বেয়ে রুমে চলে যাই। হোটেলে লিফট থাকলেও খুশির জোয়ারে সেটাও ভুলে গেছি নিমেষে। মন প্রাণ সব একাকার হয়ে আছে এক অদৃশ্য আবেশে। এমন ভাললাগা বোধকরি আর আসেনি জীবনে। এখন শুধু অপেক্ষা কাল সকাল এগারোটার। জানিনা সেই কাক্সিক্ষত সময় আসতে আর কত দেরি হবে। কোকাপ শহরের মায়ায় ভুলে গেছি বাড়ির কথা, সহপাঠীদের কথা, কলেজের কথা, তমা- সুমা- মিতুয়া- মনিরাদের কথা। যাদের নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে কাটাতাম রাতের পর রাত। বাস্তবে কাউকে ভালবাসার কথা না বলতে পারলেও স্বপ্নতো দেখতে পারতাম। এটাইবা কম কিসের! প্যাকেট ভরে আপেল, কমলা আর জুস নিয়ে রাত সাড়ে ন’টায় হোটেল রুমে আসে বাবা। টেবিলের ওপর ব্যাগ রেখে বললেন,’নে খা, আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।’ আমার খিদে নেই বললেই চলে। আসলে মার্টিনা স্মিথের সাথে কথা বলে আনন্দে পেট আমার তখনি ভরে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আগামীকালের সকাল এগারোটা আমার মনের ভেতরে উত্থাল পাথাল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কি কথা বলবে সে? আমাকে ভালবাসি বলবে- নাকি বলবে তার স্বামী-সংসার আছে! সব উল্টো পাল্টা চিন্তা মাথার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে। বাথরুম থেকে বাবা বের হলে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। বললেন,’কই খাচ্ছিস না তো? খা, একদম তাজা ফল। যশোরে এমন তাজা ফল সহজে পাওয়া যায় না।’ আমি প্যাকেট থেকে একটা আপেল বের করে তাতে কামড় বসাই। বাবা বললেন,’তা বল, বাড়ির সবাই কেমন আছে?’ আমি আপেল চিবোতে চিবোতে বললাম,’ভাল আছে আব্বা।’ ‘তোর পড়াশুনা কেমন চলছে?’ ‘ভাল।’ ‘সীমা বেড়াতে এসেছিল শুনেছিলাম। ওকি চলে গেছে?’ ‘না বড় আপা বলছিল শুক্রবারে দুলাভাই এসে নিয়ে যাবে। আজ হয়তো চলে গেছে।’ ‘উপমা ঠিকমতো স্কুলে যায় তো?’ ‘হ্যা আব্বা যায়। ওর জন্যে একটা ছাতা কিনে নিয়ে যেতে বলেছে। রোদে স্কুলে যেতে ওর খুব কষ্ট হয়।’ ‘বাজার থেকে একটা কিনে দিতে তো পারতিস?’ ‘আমি চেয়েছিলাম; ও ঢাকার ছাতা ছাড়া নেবে না।’ ‘কেন! ঢাকার ছাতা কেন?’ ‘তা জানিনা। বললো ঢাকার ছাতা নাকি ভাল।’ ‘ছাতা তো একই হয়। কি ভেবে বলেছে কি জানি।’ ‘আপনি একটা ছাতা কিনে দিয়েনতো। ওর শখ অন্তত পূরণ হোক।’ ‘ঠিক আছে কিনে দেবো কালকে। বাড়িতে খরচের জন্যে কয় টাকা দিতে বলেছে তোর মা?’ ‘আম্মা তেমন কিছু বলেননি। আপনি হিসাব মতো দিয়েন।’ ‘ও হ্যাঁ মুরাদের আর কী জ্বর হয়েছিল?’ ‘মাস খানেক আগে একবার হয়েছিল; তারপর আর হয়নি। হয়তো ঠিক হয়ে গেছে।’ ‘কী যে হলো ছেলেটার!’দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বাবা। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন,’কাল সকালে তাহলে টাকা নিয়ে বাড়িতে চলে যাস।’ বাবার কথায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কাল সকালে বাড়ি ফিরে যাবো মানে! বললাম,’কাল রাতে যাই আব্বা? দিনের বেলা গাড়িতে বসতে খুব কষ্ট হয়। মনে হয় সময় আর শেষ হবে না। তার চেয়ে রাতে গেলে এক ঘুমে যশোর।’
আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আর কোন কথা বলে না বাবা। বললেন,’ঠিক আছে রাতে যেতে চাস যাবি।’বাবার কথায় আমি স্বস্তি ফিরে পাই। বাবা যদি রাজি না হতেন তাহলে আমার মনের কি অবস্থা হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে সময় যত পার হয় ততই মার্টিনা স্মিথের প্রতি দুর্বলতার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সারাক্ষণ চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার মায়াভরা মুখ, সোনালী চুল, সেই হাসি- লাজুক পেলবতা। জানিনা কেমন করে তার বাঁধনে বাঁধা পড়লাম! একবার অবশ্য একজন জ্যোতিষী আমাকে বলেছিল, একসময় আমার নাকি অনেক টাকা পয়সা হবে। জানতে চেয়েছিলাম, কপালে বিয়ে টিয়ে আছে কিনা? সে আবারো আমার ডান হাতটা কোলের ভেতরে টেনে নিয়ে মিনিট খানেক রেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার নাকি খুব বড় জায়গায় বিয়ে হবে। আজ মার্টিনা স্মিথের সাথে পরিচয়-ঘনিষ্টতার কারণে সেই জ্যোতিষীর কথা মনে পড়ে যায়। হয়তো জ্যোতিষী সেদিন ঠিকই বলেছিল।সকালে বাবা বাইরে চলে গেলে আমি ন’টার দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশ্যে বাসে উঠে পড়ি। সকালে রাস্তায় জ্যাম না থাকায় পনের মিনিট বাদে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে অশ্বথ গাছের নিচে যেয়ে বসে হাত ঘড়িটার দিকে চোখ রাখি। দশটা পনের। এগারোটা বাজতে আরো অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকী। বুঝতে পারি, বেশ আগেই এসে পড়েছি; কিন্তু যদি রাস্তায় জ্যাম থাকতো তাহলে সময় মতো আসা কষ্টকর হয়ে যেতো। আগে আসা ভাল কিন্তু জ্যামে পড়ে কথা না রাখাটাকে আমি কোনভাবে সমর্থন করতে পারি না। আশপাশের দু’একজন আমার দিকে আড়চোখে তাকায়। তারা কি দেখছে তা জানি না- জানার চেষ্টাও করি না। যেখানে সেখানে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে প্রেমিক-প্রেমিকারা জোড়ায় জোড়ায় বসে গল্প করছে- কেউ কেউ খুনসুটিতে মাতোয়ারা। কেউবা আবার আমার মত একা বসে কারো জন্যে অপেক্ষায় আছে। আমি অজান্তেই ঘাসের একটা লতা ছিঁড়ে নখ দিয়ে তার শরীর থেকে পুরোনো খোসা ছড়াই আর এদিক ওদিক তাকাতে থাকি। মার্টিনা স্মিথ আসছে না দেখে আমার কেন যেন একবারও মনে হয় না সে আসবে না কিংবা ভুলে গেছে কিংবা অন্য কিছু। আমার সব সময় মনে হয় সে আসবে-অবশ্যই আসবে। আমার বিশ্বাসকে দৃঢ় করে মার্টিনা স্মিথ সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে তার অসম্ভব হাসি। আমি উঠে দাঁড়াতে যাবো এমন সময় সে নিজেই আমার সামনে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,’তুমি ঘাসের ওপর বসতে পারবে! না হয় চলো ঐখানটায় যেয়ে বসি।’
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct