অপসংস্কৃতির সয়লাবে ক্ষয়িষ্ণু মানবতা
এম ওয়াহেদুর রহমান
সংস্কৃতি মানব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংস্কৃতি ছাড়া জীবন অচল। এক কথায় সাংস্কৃতিক সমাজ জীবনের দর্পণ। এই সংস্কৃতি হলো জাতির আত্মা। অথচ এই আত্মাকে রক্ষা করা তো দূরের কথা, এই আগত ক্ষতির দিকটা সম্পর্কে সচেতন করার লোক ও বোধ হয় খুঁজে পাওয়া ভার। অপসংস্কৃতি হলো সংস্কৃতির বিকৃত রূপ। অপসংস্কৃতি মানুষের জীবনে আনে বিকৃতি, অন্তরে আনে কলুষতা, চেতনা কে করে বিনষ্ট আর মূল্যবোধে আনে ভাঙন। অপসংস্কৃতি আজ তথাকথিত আধুনিকতার মোড়কে আবৃত হয়ে বিস্তার লাভ করেছে। অপসংস্কৃতি কিংবা আধুনিক সংস্কৃতি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। আজ বিশ্ব মানবতার নিকটে এক জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে অপসংস্কৃতি কিংবা আধুনিক সংস্কৃতির রূপরেখা নিয়ে। প্রাচ্য - পাশ্চাত্য সর্বত্রই আজ অপসংস্কৃতির ভয়ঙ্কর বীভৎস রূপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানবতার বিপর্যের মূল কারণ আধুনিক সংস্কৃতির নামে আজকের অপসংস্কৃতি। আধুনিক সংস্কৃতির পিছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত পথিক আজ দিশেহারা। তৃষ্ণার্ত মুসাফিরের সামনে এখন শুধুই মরীচিকা। এই কঠিন বিপর্যের অক্টোপাস থেকে বাঁচার জন্য করুণ কাকুতি জানাচ্ছে বিপন্ন মানবতা !
জাতি কতটা সভ্য বা উন্নত সেটির পরিমাপে সংস্কৃতি একটি নির্ভুল মাপকাঠি। একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তা - চেতনা, রুচিবোধ, চালচলন বা জীবনবোধের সামগ্ৰিক পরিচয় মেলে সংস্কৃতিতে। অপসংস্কৃতি মানুষকে কলুষিত করে এবং সৌন্দর্যের বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়ে শ্রীহীন তার দিকে ঠেলে দেয়। অথচ সংস্কৃতি এবং জীবন একে অপরের পরিপূরক। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উদ্দাম ভোগ - বিলাসীতা ও উচ্ছৃংখলতার জন্ম দেয়। বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অবাধ সুযোগে আমাদের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পাশ্চাত্য যুব সমাজ যে মাদক নেশা ও অবক্ষয়ে আক্রান্ত তা ক্রম বিস্তার লাভ করেছে আমাদের তরুণ সমাজে। অসংযত পাশ্চাত্য মানসিকতা, উগ্ৰ বিদেশিয়ানা ও ভোগ প্রবণ স্থূলতা আজ আমাদের সংস্কৃতির মূল ধারাকে গ্ৰাস করতে বসেছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যাক্তিগত লোভ লালসা চরিতার্থ করার এক উদ্ভট জোয়ার চলছে মানব সমাজে। মনুষ্য সমাজের অন্যতম স্তম্ভ যুব সমাজ আজকে অপসংস্কৃতির শিকার। যুব সমাজের একটি বড় অংশকে সুকৌশলে করা হচ্ছে পথভ্রষ্ট। সুন্দর জীবনের পথ থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্ধকার জীবনের জগতে। অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। বিপুল সংখ্যক যুবসমাজ ধাবিত হচ্ছে অসামাজিক কার্যকলাপে। আধুনিক সংস্কৃতির নামে সিনেমা, টিভি, সাহিত্য, মডেলিং প্রভৃতির কুপ্রভাব সমাজ জীবনের সর্বত্র খুন, কৌমার্য, ধর্ষণ, হত্যা,ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাই স্বভাবে প্রভাবান্বিত মানব সমাজে ছেয়ে যাচ্ছে। সিনেমা কিংবা অনুরূপ কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত মানেই আধুনিক সংস্কৃতির বহিঃ প্রকাশ বলে মানব সমাজ মনে করছে। সিনেমা, টিভি যুব সমাজকে নিত্য হাতছানি দিচ্ছে। হিংসাশ্রয়ী - অশ্লীল চলচ্চিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী বিকৃত রুচির নাচ - গান, রুচিগহি’ত পোশাক - পরিচ্ছদের প্রতি তাদের কে আকৃষ্ট তথা অনুরক্ত করার গভীর নীলনকশা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে। মানব সমাজের চরিত্র বিধ্বংসী শত শত শ্রেনীর নানা বর্ণের গন্ধের উপস্থাপনায় যৌনাবেদনময় অশ্লীল ম্যাগাজিন, সাময়িক সহ পূর্ণ পত্রিকায় মানবতা সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। জীবন বিকাশের পূর্ণ মুহূর্তে মানব সমাজ যদি সামনে কোনো জীবন্ত আদর্শের সন্ধান না পায়, যদি খুঁজে না পায় মহৎ জীবন ভাবনায় অনুপ্রাণিত হওয়ার কোনো অবলম্বন, তবে কে তাদের অধ:পতন রোধ করবে? কে তাদের উদ্ধার করবে অনিবার্য বিপথগামী তার চোরাবালি থেকে? অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবলে সর্বোপরি আধুনিক সংস্কৃতির নগ্ন থাবায় মানবতা আজ জর্জরিত। আজ যারা অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অলস তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, যদি তারা সঠিক পথনির্দেশনা পাই তবে পুনরায় মানব সমাজ উজ্জীবিত হবে দুর্বার প্রাণ শক্তিতে। মনুষ্য সমাজ ফিরে পাবে তাদের হারানো শুভবুদ্ধি। বিশ্ব মাঝারে কিংবা দেশে দেশে রুচি সম্মত সাহিত্য কিংবা সিনেমা যে একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা নেহাতই কম। আজকের অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে মানব সমাজ বেরিয়ে পড়লেই হয়তো দিকে দিকে গড়ে উঠবে সুস্থ সাবলীল সুন্দর জীবন, মানুষের জীবন হবে সুখময়। কেননা অপসংস্কৃতি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct