একদিকে ৩৮, অন্যদিকে ২৬—ভারতের রাজনৈতিক পরিসর এই ৬৪টি দল দুই শিবিরে ভাগাভাগি করে দিয়েছে। শাসক দল বিজেপির গড়া ৩৮ দলের সম্প্রসারিত ‘এনডিএ’ জোটের মোকাবিলায় বিরোধীরা ‘ইউপিএ’র অবসান ঘটিয়ে গড়ে তুলেছে ২৬ দলের নতুন জোট ‘ইন্ডিয়া’। কিন্তু এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রবাহ অনেকটাই নির্ভর করবে এই দুই জোটের বাইরের শক্তিগুলোর ওপর, যারা এই ভাগাভাগিতে অংশ নেয়নি। তাদের শক্তি কিন্তু নেহাত উপেক্ষণীয় নয়। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদিকে ৩৮, অন্যদিকে ২৬—ভারতের রাজনৈতিক পরিসর এই ৬৪টি দল দুই শিবিরে ভাগাভাগি করে দিয়েছে। শাসক দল বিজেপির গড়া ৩৮ দলের সম্প্রসারিত ‘এনডিএ’ জোটের মোকাবিলায় বিরোধীরা ‘ইউপিএ’র অবসান ঘটিয়ে গড়ে তুলেছে ২৬ দলের নতুন জোট ‘ইন্ডিয়া’। কিন্তু এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রবাহ অনেকটাই নির্ভর করবে এই দুই জোটের বাইরের শক্তিগুলোর ওপর, যারা এই ভাগাভাগিতে অংশ নেয়নি। তাদের শক্তি কিন্তু নেহাত উপেক্ষণীয় নয়। এই শক্তিগুলোই ভারী করবে শাসক অথবা বিরোধীদের পাল্লা। সম্ভবত তা হবে ভোটের পর। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এই তৃতীয় শক্তিগুলোর অন্যতম হায়দরাবাদের অল ইন্ডিয়া মজলিস ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিন বা ‘এআইএমআইএম’। প্রধানত মুসলমানদের নিয়ে সংগঠিত এবং অন্ধ্র প্রদেশ–তেলেঙ্গানার কিছু অঞ্চলে প্রভাবশালী এই আঞ্চলিক দলটি বুধবার আক্ষেপ করে বলেছে, সব সময় বিজেপির বিরোধিতা করে গেলেও ‘ইন্ডিয়া’র অংশ হতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হলো না! তারা বিস্মিত একদা বিজেপির ঘর করা দলগুলোকেও সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে! যেমন নীতীশ কুমার, উদ্ধব ঠাকরে বা মেহবুবা মুফতি। দলের জাতীয় মুখপাত্র ওয়ারিশ পাঠান বুধবার এই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর কাছে তাঁরা এখনো অস্পৃশ্য রয়ে গেলেন! লোকসভার সদস্য আসাউদ্দিন ওয়েইসি নেতৃত্বাধীন এআইএমআইএমের সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অধিকাংশের ধারণা, মুখে বিজেপিবিরোধিতার কথা বললেও ভোটের সময় তারা বিজেপির সুবিধা করে দেয়। মুসলিমপ্রধান এলাকায় প্রার্থী দিয়ে মুসলমানদের ভোটে ভাগ বসিয়ে বিরোধীদের জয়ের পথে কাঁটা বিছান। তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশ ছাড়াও তারা এই কাজ করেছে উত্তর প্রদেশে, বিহারে, পশ্চিমবঙ্গে ও মহারাষ্ট্রে। সে কারণে উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টি, বিহারে আরজেডি ও কংগ্রেস, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস কারও কাছেই এআইএমআইএম সুহৃদ হয়ে উঠতে পারেনি।ওয়েইসির দলের এই মনোভাবের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট, তারা বিরোধী শিবিরের অংশ হতে আগ্রহী। বিরোধীরা সেই আগ্রহকে আমল দেবে কি না অন্য বিষয়। এই দলটি ছাড়া অন্যরা যারা ‘ঘরেও নহে পারেও নহে’র মতো মাঝখানে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে থাকা শ্রেয় মনে করছে, তারাই ঠিক করে দেবে পরবর্তী সরকারের স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তারা সমীহ করার মতো। যেমন ওডিশার বিজু জনতা দল (বিজেডি)। নবীন পট্টনায়কের এই দল রাজ্যের বাইরে কখনো কোনো আগ্রহ দেখায়নি। নবীন পট্টনায়কের ধ্যানজ্ঞান ওডিশা। রাজ্য রাজনীতিতে নিজের দলের আধিপত্য দৃঢ় করেছেন, কেন্দ্রে বিজেপির সঙ্গে সখ্যও গড়ে তুলেছেন। কংগ্রেসের বিরোধিতা করে তাঁর দলের জন্ম। কংগ্রেসকে রাজ্যে হীনবল করে দিয়েছেন। তাতে বিজেডি ও বিজেপি দুয়েরই সুবিধা হয়েছে। রাজ্যে বিজেডিকে বিজেপি ঘাঁটায় না, কেন্দ্র বিজেপিকে নীরবে সমর্থন দিয়ে যায় বিজেডি। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলে এই সমীকরণে আগামী দিনেও বদল ঘটার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী দল অন্ধ্র প্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস ও তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। দুটি দলই রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসবিরোধী। আবার একে অন্যের বিরোধীও। ওয়াইএসআর কংগ্রেস নেতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডির বিজেপির সাহচর্য প্রয়োজন দুটি কারণে। একটি কারণ নতুন রাজধানীসহ রাজ্য গঠনে কেন্দ্রীয় সহায়তা, অন্যটি নিজেকে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির তদন্ত থেকে বাঁচানো। বিজেডির মতো এই দুই দলও সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে বিজেপির সহায়তা করে চলেছে। বিশেষ করে রাজ্যসভায়, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস করার জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন বিজেপির নেই। দুই দল বিজেপির কাছাকাছি থাকলেও প্রকাশ্যে কেউই এনডিএর শরিক হয়নি। যদিও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে এদের মতো অতটা নিশ্চিত নয় তেলেঙ্গানার শাসক দল ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)। রাজ্যে কংগ্রেসকে শক্তিহীন করে এই দলের জন্ম। কংগ্রেস এখনো তার প্রধান শত্রু। বিজেপিও প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। কর্ণাটক বিধানসভার ভোট এই রাজ্যে কংগ্রেসের পালে হাওয়া দিয়েছে। এত দিন ধরে বিজেপির বিরোধিতা করে আসা মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও এখন বেশ বিপাকে। কংগ্রেসের দরজা বন্ধ, বিজেপির হাত ধরাও বিপজ্জনক। চন্দ্রশেখর রাওয়ের মতোই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হাল কর্ণাটকের জেডিএসের। দক্ষিণ কর্ণাটকে প্রভাবশালী ভোক্কালিগ্গা সম্প্রদায়ের সমর্থননির্ভর এই দলটি সাম্প্রতিককালে কংগ্রেস ও বিজেপির সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যন্ত। জেডিএসের ভোট কেটে দুই দলই গত নির্বাচনে লাভবান হয়েছে। কংগ্রেস বেশি, বিজেপি কম। উপমুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস সভাপতি ডি কে শিবকুমার এই ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের নেতা। অস্তিত্বের সংকট থেকে বাঁচতে জেডিএস ও বিজেপি এখন পরস্পরের হাত ধরতে চাইছে। এনডিএতে যোগ না দিলেও বিজেপির সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন জেডিএস নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী। তাঁর অবস্থা শাঁখের করাতের মতো।অস্তিত্বের সংকট উত্তর প্রদেশের বহুজন নেত্রী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীরও। দুর্নীতির তদন্ত মুক্ত থাকতে গেলে বিজেপির বিরোধিতা করা তাঁর সাজে না। সেই উপলব্ধি তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে সাম্প্রতিক কালে তিনি নিরুপদ্রব জীবনে অভ্যন্ত হয়েছেন। রাজ্যে তাঁর এত বছরের প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজবাদী পার্টি ‘ইন্ডিয়া’র শরিক হয়েছে। তাঁর পক্ষে সরাসরি বিজেপির বন্ধু হওয়াও কঠিন। অস্তিত্ব বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত তিনি কী করেন, সেটাও দ্রষ্টব্য। পাঞ্জাবের শিরোমনি অকালি দলের অবস্থাও সঙিন। বিজেপির বহু বছরের সঙ্গী এই দলটি কৃষক আন্দোলনের সময় জোট ছেড়েছিল। তাদের রাজনৈতিক শক্তি বিভাজিত হয়েছে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির মধ্যে। অস্তিত্ব রক্ষায় তাদেরও বিজেপির সঙ্গে না এসে উপায় নেই। কিন্তু এখনই সেই সিদ্ধান্ত তারা নেয়নি। অন্যদের মতো তারাও অপেক্ষার রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগ না দেওয়া উল্লেখযোগ্য দল আসামের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ‘এআইইউডিএফ’। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভোটে লড়লেও পরবর্তী সময়ে বিজেপির চাপে কোণঠাসা। আসামে অবশ্যই তারা কিছু এলাকায় শক্তিশালী। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা সম্ভবত কৌশল পরিবর্তনের কথা ভাবছে। ভবিষ্যতে তারা কীভাবে এগোবে, সেটাও অন্যদের মতো ভবিষ্যতেই ঠিক করবে। সরকার ও বিরোধী দুই পক্ষের নজরেই ঝলমল করছে এই তৃতীয় পক্ষ। ভোটের পর জয়ীর পাল্লা আরও বেশি ঝোঁকাবে এরাই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct