মানব সম্পদ উন্নয়নের মূল মন্ত্রই হলো শিক্ষা। সেই শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন-” তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” তিনি গতানুগতিক শিক্ষাকে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন যে, এই শিক্ষা জোর করে বাইরে থেকে চালিয়ে দেওয়া কৃত্রিম শিক্ষা, যার সঙ্গে জীবনের এবং শিক্ষার্থীর কোনো যোগ নেই। লিখেছেন সনাতন পাল।
মানব সম্পদ উন্নয়নের মূল মন্ত্রই হলো শিক্ষা। সেই শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন-” তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” তিনি গতানুগতিক শিক্ষাকে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন যে, এই শিক্ষা জোর করে বাইরে থেকে চালিয়ে দেওয়া কৃত্রিম শিক্ষা, যার সঙ্গে জীবনের এবং শিক্ষার্থীর কোনো যোগ নেই। তিনি বলেন “ ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি, সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টারের- কলও তখন মুখ বন্ধ করেন। ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়।” ডুবন্ত জাহাজের মত যে টুকু চলছিল, বর্তমানে সেটাও নানা অছিলায় ডুবতে বসেছে। তিনি আরও বলেছেন- “ দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত যাহা মুখস্থ করি, জীবনের সঙ্গে, চারিদিকের মানুষের সঙ্গে,ঘরের সঙ্গে তাহার মিল দেখিতে পাই না। এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা ইঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকে; তাহা বস্তু যোগায়, প্রাণ জোগায় না। “ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ,ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও ব্যক্তি-সত্তার সঙ্গে বিশ্ব-সত্তার মিলনই যথার্থ শিক্ষা। শিক্ষার অর্থ শুধু জ্ঞানের সাধনা নয়, জ্ঞানের সাধনার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতি বা সৌন্দর্যবোধের বা শিল্প বৃত্তির সাধনা এবং কর্মশক্তির বা ইচ্ছা শক্তির সাধনা।
তিনি শিক্ষাকে জীবনমুখী, আনন্দময়, স্বতঃস্ফূর্ত এক প্রক্রিয়া রূপে ব্যাখ্যা করতেন। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় না আছে জীবনমুখী ভাবনার বাস্তবতা, না আছে আনন্দ, না আছে স্বতঃস্ফূর্ততা। শুধুই কৃত্রিমতাকে চাপিয়ে দেওয়া এবং বাহির থেকে সিরিঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার মত। তাই তো এ রূপ সিরিঞ্জের যন্ত্রণায় শিক্ষার্থীরা কাতর হয়ে পড়ছে এবং একটা বড় অংশ লেখাপড়া থেকে পালিয়ে পরিত্রাণ পেতে চাইছে । এর ফলেও একদল তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের জন্ম হচ্ছে। এই নাগরিকগণ কে অবশ্য কারখানায় অল্প পয়সায় শ্রমিকে পরিণত করা অনেকটা সহজ হবে। যাঁরা শ্রমের মূলটাও বুঝে নিতে শিখবেন না, শুধু গাধার মত হাড়ভাঙা খাটুনি করে যাবে কিন্তু পেট আর ভরবে না । বর্তমানে পাঠ্য পুস্তকের নাম করে এক দঙ্গল কাগজের বোঝা শিশুদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে । এই কাগজ, বইয়ের ব্যাগের বোঝা যে সংসারের বোঝার চেয়ে হাল্কা শৈশবে সেই বোধ পর্যন্ত গড়ে তুলতে ব্যর্থ। এই বইয়ের ব্যাগের বোঝা হয়তো শুধু শিশুদের অল্প বয়সে স্পন্ডিলাইটিস রোগ ধরাতেই সক্ষম হচ্ছে। কয়েক পাতা পড়ার পরে শিশু যখন উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে তখন সে ভুলেই যাচ্ছে যে, প্রথমে কি দিয়ে শুরু করেছিল! সেই কারণে বিষয় বস্তুতে শব্দের ব্যবহার কখনই প্রয়োজনের অতিরিক্ত করা উচিত নয়। আবার মূল উপপাদ্য বিষয়ে পৌঁছানোর জন্য অতিরিক্ত ভনিতা করারও দরকার নেই। তবে যে টুকু দরকার সে টুকু করতেই হবে । শিক্ষক গণের অমোঘ নিয়তি এই যে, শিক্ষকতার উপরে তাঁদের সংসার চলে । সেই কারণে শিক্ষকতা অবশ্যই তার পেশা কিন্তু পাঠদানকে শুধুই পেশা মনে করলে প্রথাগত নির্দেশিকার উপরেই বেশি নজর থাকবে, শিশুকে কি ভাবে এবং কোনো পদ্ধতিতে অধিক সহজ পদ্ধতিতে উপজীব্য বিষয় শিখবে এবং বুঝবে,সে দিকে নজর কম থাকবে। পাঠদানের ক্ষেত্রে কোন্ পুস্তকে, কি নির্দেশিকা কে দিয়েছেন সেটা কখনোই বৃহৎ বিষয় নয়। খুব বেশি হলে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে । কিন্তু অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিশু কি চাইছে? কি ভাবে শেখালে শিক্ষাটা তার হৃদয়ঙ্গম হবে ? এক্ষেত্রে অবশ্যই নজর রাখা দরকার যে, শিশু যেন কোনো পাঠ্য বিষয়কেই বিমূর্ত না ভাবে। যদিও শিশুর কাছে পর পর যে বিষয় গুলি পাঠের ক্ষেত্রে আসবে সে গুলো বিমূর্ত হতেই পারে । এই বিমূর্ত বিষয়কে শিক্ষক গণ আপন কৌশলের মাধ্যমে মূর্ত করে তুলবেন। এক্ষেত্রে শিক্ষা উপকরণ এবং পূর্ব পাঠের অনুশীলনী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি বিষয়ের উপরে অনেক ক্ষেত্রেই আজকাল কম গুরুত্বপূর্ণ আরোপ করা হয়। এখন স্কুলের কাজ মানেই প্রতিদিন শিক্ষা দপ্তরে কিছু তথ্য তড়িঘড়ি করে পাঠানো। এই তথ্য কতটা ভুল আর কতটা নির্ভুল থাকে সেটা শিক্ষকরা যেমন জানেন, তেমনি শিক্ষা আধিকারিকদের অভিজ্ঞতাও কিছু কম নয়। শিশু কি শিখল শিশু কি বুঝল? তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্কুল গুলি সরকারের চাহিদা মত তথ্য দিল কি না ? এখন পাঠদানের কৌশল আলচনা না করে স্মার্ট ফোনে কাজ করা আর কম্পিউটারে কি ভাবে সরকারি কাজ করা যাবে সে সব ট্রেনিং হয়। এই ভাবে তথ্যের কচকচানিতে শৈশব থেকে শিক্ষার সুযোগটাই কম পাচ্ছে। ফাইল ভর্তি কাগজ জমছে কম্পিউটারে প্রচুর ফাইল তৈরী হচ্ছে কিন্তু শিক্ষা শিশু মনকে পোক্ত করতে পারছে না। সব চলছে দলীয় অনুপ্রেরণায়- শুধু শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে ভাড়ের মা ভবানী! প্রচলিত এই শিক্ষা ব্যবস্থার বদল হওয়া দরকার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct