বিজেপির জন্ম থেকেই তিনটি দাবি—‘অযোধ্যায় রামের জন্মভূমির মুক্তি, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’। প্রথম দুই দাবি তাদের পূরণ হয়েছে। বাকি আছে অভিন্ন দেওয়ানি। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিয়ে, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ও দত্তকের ক্ষেত্রে অভিন্ন আইন চালুর বিষয়টি শুনতে যত সহজ, রূপায়ণ ততটাই জটিল। সাবধানের মার নেই। সেই কথাই শুনিয়েছিল ২১তম আইন কমিশন। তারা বিস্ময়কর এক তথ্যও জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, বহুবিবাহ ইসলামে জায়েজ। শঙ্কিত শিখ সমাজও। আম আদমি পার্টি ‘নীতিগতভাবে’ পক্ষ নিলেও পাঞ্জাবে সেই দলের মুখ্যমন্ত্রী তীব্র বিরোধিতায় নেমেছেন। পাঞ্জাবে বিজেপি নতুন করে যাদের পাশে চাইছে, সেই শিরোমণি অকালি দল ও একাধিক শিখসংগঠন ‘শিখ পার্সোনাল ল বোর্ড’ গঠনের দাবি জানিয়েছে। জরুরি বৈঠক করেছে শিখ গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটিও। শিখধর্মে বিয়ে হয় তাঁদের নিজস্ব ‘আনন্দ বিবাহ আইন’ মেনে। ওই আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান নেই। বিচ্ছেদ হয় হিন্দুমতে। তাদের আশঙ্কা—অভিন্ন আইন হলে তাদের প্রথা বাতিল হয়ে যাবে। গোয়া ছিল পর্তুগিজদের দখলে। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনারা সেটি মুক্ত করেন। সেই রাজ্যের আইন অনুযায়ী, ৩০ বছর বয়সী কোনো জওয়ানকে তাঁর স্ত্রী সন্তান দিতে না পারলে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন। অভিন্ন বিধি নিয়ে অসন্তোষ সেখানেও। আলোড়ন উঠেছে হিন্দু সমাজেও। ‘হিন্দু আনডিভাইডেড ফ্যামিলির’ (এইচইউএফ) অস্তিত্ব থাকবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। সনাতন ধর্মে উত্তরাধিকার ও দত্তক গ্রহণের ভিন্ন ভিন্ন প্রথা ও রীতি বিদ্যমান। বৈবাহিক নিয়মেরও বহু রকমফের রয়েছে। হিন্দু বিবাহ আইনের কোনো কোনো ধারায় বলা আছে, প্রথাগত রীতি ও আচার পালনের অভ্যাস বিধানের ওপর স্থান পাবে। অভিন্ন আইন তো সেই ছাড় দেবে না। ‘পার্সি বিবাহ ও বিচ্ছেদ আইন’ অনুযায়ী কোনো নারী ভিন্ন ধর্মের পুরুষকে বিয়ে করলে পার্সি রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠানের অধিকার হারাবেন। এই ধর্মে দত্তক মেয়ের অধিকার দত্তক ছেলের সমান নয়। খ্রিষ্টধর্মে উত্তরাধিকার আইনও লিঙ্গভেদে অসম। সব ধর্মে কিছু না কিছু স্বতন্ত্রতা রয়েছে, রীতি রয়েছে। জৈনধর্মের নিজস্ব রীতিও সংবিধান অনুযায়ী আইন। এসব রীতি অনন্তকাল ধরে বিন্দুমাত্র জটিলতা ছাড়া পালিত হয়ে আসছে। অভিন্ন বিধির দরুণ অহেতুক জটিলতা ও অশান্তি ডানা মেলবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
আদিবাসী সমাজের মাথাব্যথা
আদিবাসী সমাজের মাথাব্যথাও কম নয়। পুরো উত্তর–পূর্বাঞ্চলে বিরোধিতা শুরু হয়েছে। এই তল্লাটের আটটি রাজ্যে মোট লোকসভা আসন ২৫। জবরদস্তি করলে একটি আসনও বিজেপি পাবে না। আগেভাগেই তাই বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে অভিন্ন বিধির আওতায় আনা হবে না। ঠিক যেমন গরুর মাংস নিয়ে বিজেপি ওই রাজ্যগুলোয় রা কাড়ে না। কিন্তু আদিবাসী–উপজাতিদের বাস অন্যত্র। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ও গুজরাটের বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁদের বসবাস। দেশের ৪৭টি লোকসভা আসন উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এই বিপুল জনগোষ্ঠী কীভাবে আওতামুক্ত থাকবে, কেউ জানে না! কারণ, সরকারি কোনো রূপরেখাই তৈরি হয়নি! উত্তরাখন্ডের বিজেপি সরকার একটা খসড়া তৈরি করেছে; কিন্তু প্রকাশ করেনি। তাই বিতর্ক চলছে স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে।
সংঘ পরিবারের শঙ্কা ও দক্ষিণি প্রস্তাব
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘সরকার একটি কঠিন জিনিসকে খুবই অপ্রতিষ্ঠিতভাবে সহজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।’ সেই চেষ্টায় ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোনো ইচ্ছা সরকার এখনো প্রকাশ করেনি।তবু কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বামপন্থীসহ অধিকাংশ বিজেপিবিরোধী শক্তি বিরোধিতায় সরব। সরকারের সহযোগী দলগুলোও বিভ্রান্ত। এ অবস্থায় প্রমাদ গুনছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। বিজেপিকে সাবধান হতে বলে তাদের পরামর্শ—শিয়রে ভোট। এখন এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে হিতে বিপরীত হয়।বিয়ে, বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার ও দত্তকের ক্ষেত্রে অভিন্ন আইন চালুর বিষয়টি শুনতে যত সহজ, রূপায়ণ ততটাই জটিল। সাবধানের মার নেই। সেই কথাই শুনিয়েছিল ২১তম আইন কমিশন। তারা বিস্ময়কর এক তথ্যও জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, বহুবিবাহ ইসলামে জায়েজ।
পার্লামেন্ট, সর্বোচ্চ কে
কিন্তু সেই সুযোগ মুসলমানদের চেয়ে বেশি নেয় এ দেশের হিন্দুরা। হাতের কাছে উদাহরণ—অভিনেত্রী হেমা মালিনীকে বিবাহিত ধর্মেন্দ্রর বিয়ে। দুজনেই বিজেপির সম্পদ। ধর্মেন্দ্র সাবেক, হেমা বর্তমান সাংসদ। আরএসএস সাবধান হতে বলেছে। তা করতে গিয়ে একের পর এক সমঝোতা ও ছাড়ের বন্যা বইলে দেওয়ানি বিধির চরিত্র কি আদৌ ‘অভিন্ন’ থাকবে? শেষ পর্যন্ত তা স্রেফ ইসলাম বিরোধিতার নতুন আখ্যান হবে না তো? প্রশ্নটা আলোচিত হচ্ছে।তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছে, সবার আগে অভিন্ন হিন্দুবিধি আসুক। দলিত, অনগ্রসর ও আদিবাসীরা এখনো বহু হিন্দুমন্দিরে ঢুকতে পারেন না। সেই বৈষম্য আগে দূর করুন। তারপর না হয় অন্য কিছু ভাবা যাবে।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct