পশ্চিমবঙ্গ ‘সাধারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩’ এ, কেমন এবং কি বার্তা প্রদান করলো আমাদের গ্রামবাংলা কে ? গত একমাসে প্রায় ৩৫ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারল. যে গণতন্ত্র নাগরিকের সুষ্ঠ মতদানকে নিশ্চিত করে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং ভারতবর্ষকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে খ্যাতি অর্জন করায়? লিখেছেন মোঃ সাহিদুল ইসলাম।
পশ্চিমবঙ্গ ‘সাধারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩’ এ, কেমন এবং কি বার্তা প্রদান করলো আমাদের গ্রাম বাংলা কে? গত একমাসে প্রায় ৩৫ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হয়ে গণতন্ত্র কে রক্ষা করতে পারলো? যে গণতন্ত্র নাগরিকের সুষ্ঠ মত্দান কে নিশ্চিত করে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলে ভারত বর্ষকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে খ্যাতি অর্জন করাই। গত কালকে অর্থাৎ ৮ই জুন পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের নামে যে প্রহসন হয়েছে সেটা হয়তো “কালাতন্ত্র” বললেও খুব একটা খারাপ হবে না। অনেকেই আবার এই নির্বাচন কে উৎ’শব’ বলেও রক্তে রাঙা আবির নিয়ে মৃত্যু মিছিলের জশনে পালন করছে। কালাতন্ত্রের মন্ত্র জপ করে মৃত্যু মিছিলের ঝান্ডা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, শুধু দেশ নয়, বরং গোটা বিশ্বে কালিমা লিপ্ত করলো গণতন্ত্রকে তথা পুরো দেশবাসী কে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মৃত্যু মিছিল ও কালাতন্ত্রের মন্ত্রণাই মুগ্ধ কে বা করা হচ্ছে? কেনই হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? এই প্রতিবেদন তারই আংশিক তুলে ধরাই প্রচেষ্টা মাত্র। অপরিগণিত কার্য -কারণ সম্পর্ক থাকতে পারে, একজন সামাজিক গবেষক ও প্রত্যক্ষ দর্শী হিসেবে কয়েকটি দিক নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি যেটা হয়তো ভবিষ্যতে যে গুলো বিবেচনার মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজ্য হিসেবে পশ্চিম বঙ্গকে নতুন দিশা দেখতে পারে।
ক) দূরদর্শী সম্পন্ন লিডার বা নেতা যেকোনো সমাজ বা দেশের সর্বাঙ্গিক উন্নতির জন্যে একান্ত অপরিহার্য্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতে এই দূরদর্শী সম্পন্ন লিডারশীপের অভাব যে সমাজের মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে সেটাই নয় বরং সাধারণ নাগরিকের মত্দানটাকে কেড়ে নিচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে। নাগরিকগণ তাদেরকে স্বইচ্ছায় গ্রহণ করে না বা সমর্থন করে না, জোরপূর্বক ভয় প্রদর্শন করে গ্রামীণ স্তরে জোর করে জাকিয়ে বসে থাকে। এটাও দেখা যায়, অনেক নাগরিক তাদের প্রাণ রক্ষার ভয়ে মত্দান কেন্দ্র বা বুথ পর্যন্ত যেতেই পারেনি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত রামেশ্বরপুর গ্রামে শতকরা ৫০ জন মত্দান কেন্দ্রে যেতেই পারেনি বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনার জন্যে। এই হিংসা বা পাশবিক ব্যবহার আসছে সেই সব অযোগ্য যুবক নেতা যারা হয়তো টেনেটুনে প্রাইমারি স্কুল শেষ করে অভাবের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে এসে লাঠির জোরে নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। এটাও দেখা গিয়েছে, অনেক অদূরদর্শী নেতা হয়তো পঞ্চায়েত চেয়ারে বসে শোষণ করে চলেছে, আবার তারাই ভবিষৎ এ শোষণের উদ্দেশে প্রানপন চেষ্টা ও প্রাণ নেওয়ার হুমকি দিয়ে গদিতে বসার বাসনা করছে। অর্থাৎ একটা বন্য বিড়াল একবার মাছ খাবার অভ্যাস করলে, সে তার অভ্যাস তাকে আজীবন ধরে রাখার চেষ্টা করে যেকোনো ভাবেই হোক না কেনো।
খ) নিয়ম কানুন বা আইন ব্যবস্থা নাগরিকের অধিকার কে সঠিকভাবে সুনিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হয়। আর যখন সেই আইন ব্যাবস্থা কালোহাতে এক পাক্ষিক ভাবে প্রদান করা হয়, তখনই বিশৃঙ্খলা ও পাশবিক অত্যাচার শুরু হয় এবং নাগরিকের অধিকার রক্ষার নামে তাদের অধিকার কে ছিনিয়ে নেয়। পঞ্চায়েত নির্বাচন-২০২৩ মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটা সুস্পষ্ট নজির তৈরি করলো। আইন কানুনের যারা রক্ষক তারাই বিভিন্ন মত্দান কেন্দ্রে, নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষায়, সশস্ত্র গুন্ডার ভূমিকা পালন করে আইন ভঙ্গ করে নাগরিকের অধিকার কে কেড়ে নিয়েছে। যেমন রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের পুলিশ বাহিনী অনেক ভোটদান কেন্দ্রে নিশ্চুপ হয়ে থেকেছে আবার অনেক কেন্দ্রে একপক্ষ হয়ে পশুর মতো আচরণ করেছে। আইন-কানুন তৈরির পরে যে তার সঠিক পরিচালনার জন্যে যে পরিমান পুলিশ বাহিনী বা আইন রক্ষক দরকার, তার তুলনায় অনেক কম ছিল বা নিয়োগ করা হয়েছে। যেমন মত্দান কেন্দ্রে কোনো মহিলা পুলিশ বা বাহিনী ছিলোনা রামেশ্বর পুর মত্দান কেন্দ্রে, যার জন্যে মত্দান কেন্দ্রে অনেক অসাংবিধানিক কাজ হয়েছে যেখানে নিযুক্ত পুলিশ কর্মী অসহায় হয়ে চোখের সামনে সেগুলো কে পরোক্ষ ভাবে সম্মতি দিয়েছে। একদিকে যেমন সাধারণ নাগরিকের অধিকার ছিন্ন হয়েছে, অন্য দিকে নির্বাচনকর্মী তথা প্রিসাইডিং ও সহ কর্মীগণ আত্ম রক্ষার তাগিদে ভোটকেন্দ্র ছেড়ে পালিয়েছে, অনেক সময় আবার “যে যার ইচ্ছা সে তা করো” সেই বার্তা দিয়েছে যেটা বিশৃঙ্খলা ও হিংসার প্ররোচনা করেছে।
গ) নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের যে উদাসীনতা এবং পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তা যে চরম সীমা অতিক্রম করেছে সেটা না বললেও হয়। তাদের এই উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার ফলস্বরূপ যে পরিনাম হয়েছে তা না বলাও বাহুল্য। তবুও যে অসহায় প্রাণ হানি, অগণিত আহত, মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব, গণতান্ত্রিকের ধজ্জা ওড়া, এই সব গুলোই কিন্তু রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয়। এই নির্বাচনে যে শুধুমাত্র মানুষের অধিকার খর্ব হয়েছে সেটা নয়, সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুলোর অবসান হচ্ছে। সুতরাং, ভোট পূর্ব এবং ভোট কালীন ও ভোট পরবর্তী যে হিংসা, দাঙ্গা যার ফলে প্রাণনাশ, এই সব গুলো যে একটা কারণেই হচ্ছে সেটা নয় উপরোক্ত সব গুলোর কারণেই হচ্ছে। নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায় স্বাধীনতা যদি বিকাশ বা উন্নতির পরিমাপক হয়, তাহলে এ রাজ্যে এ কেমন উন্নতি, কোন দিকে “এগিয়ে বাংলা”? যেখানে স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষার বঞ্চনার সাথে সাথে আজ বাংলার নাগরিক তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা টুকুও হারিয়ে ফেললো, বঞ্চনার শিকার হয়ে গণতন্ত্রের ভিটি ভঙ্গুর করে দিলো। এ কেমন রক্ত খেকো পিপাসা, এ কেমন নেতা হাজারো প্রাণঘাত করে নেতৃত্ব অর্জন করে, চিরকালের বীর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র রক্ত চেয়েছিলো দেশকে বাঁচাতে, আজ পিশাচ গুলো রক্ত নিচ্ছে কিসের নেশায়? এ প্রসঙ্গে, একটা গল্প না বললেই নয়, ফুটন্ত ব্যাঙ এর গল্প। একটা ব্যাঙকে কোনো পাত্রে জলের মধ্যে রেখে যদি সেই জলকে ফুটানো হয়, তাহলে জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে ব্যাঙ টিও তার শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে ওই গরম জলের মধ্যেই থেকে যায়, যতই না তাপমাত্রা বৃদ্ধি হোক জলের, জল থেকে লাফ মারেনা ব্যাঙ, যার পরিণতি ব্যাঙটির মৃত্যু।
লেখক: গবেষক, ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ, গুজরাট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct