সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়...
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হঠাৎ কেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এতটা সরব, সে প্রশ্নে ভারতের রাজনৈতিক মহল তোলপাড়। পাশাপাশি, বিজেপির অভ্যন্তরেও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ভোটের আগে এ নিয়ে জোরাজুরি করাটা শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়ে উঠবে কি না। কারণ, বিজেপি যাদের নতুন করে কাছে টেনে জোটবদ্ধ হতে চাইছে, তাদের মতো বিরোধীরাও মনে করছে, এই বিধি হিন্দুসমাজকেও বিভাজিত করবে। বিরোধীদের দাবি, বিজেপি আগে সব জাত ও শ্রেণির হিন্দুর জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করুক; তারপর অন্য ধর্মাবলম্বীদের দিকে তাকাক।প্রধানমন্ত্রী মোদি দুই দিন আগে মধ্যপ্রদেশে বুথ কর্মীদের এক সভায় সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরব হন। তিনি বলেছিলেন, পরিবারে একেকজনের জন্য একেক রকম নিয়ম থাকলে যেমন সংসার চালানো কঠিন হয়ে ওঠে, তেমনই নানা ধরনের আইন থাকলে দেশ চালানোও কঠিন। সবার জন্য তাই এক নিয়ম থাকা উচিত। এই প্রসঙ্গে তিনি সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে বলেছিলেন, সেখানেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বলা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলার কিছুদিন আগে দেশের ২২তম আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের জন্য সব ধর্মাবলম্বীর মতামত জানতে চায়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সংগঠনদের অভিমতও জানতে চাওয়া হয়। জুলাই মাসের মাঝামাঝি নাগাদ সবাইকে এই বিষয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছে। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদীরা ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার শুরু করে দিয়েছে। আইন কমিশন জানিয়েছে, তাদের কাছে এখনই সাড়ে আট লাখের বেশি পরামর্শ জমা পড়েছে।এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য জন্ম দিয়েছে নতুন জল্পনার। শুরু হয়েছে নানান বিশ্লেষণ, কেন হঠাৎ এ প্রসঙ্গের অবতারণা তা নিয়ে।বিরোধী মহল মনে করছে, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের আগামী নির্বাচনগুলোর আগে বিজেপি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তুলে ধরে দেশে নতুন করে ধর্মীয় আধারে মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাইছে। সেই ‘ফাঁদে’ পা না দেওয়ার জন্য কংগ্রেস সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে। ২২তম আইন কমিশনকে একহাত নিয়ে কংগ্রেস বলেছে, ২১তম কমিশন দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘এই সময়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কাঙ্ক্ষিত নয়, প্রয়োজনও নেই।’ কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘পরিবার এক থাকে রক্তের বন্ধনে, দেশকে এক রাখে সংবিধান। সেই সংবিধানে বহুত্ববাদের কথা বলা আছে। প্রধানমন্ত্রী আসলে নিজের ব্যর্থতা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে চাইছেন।’বুধবার দলের এক বৈঠকে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধী ভোটমুখী রাজ্যগুলোর নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও সার্বিক দুর্ভোগের বিষয়গুলোকেই প্রচারে তুলে আনতে হবে। বিজেপির পাতা ধর্মীয় মেরুকরণের ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। রাহুল সেই সভায় বলেন, ‘সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রশ্ন রাখতে হবে, অমৃতকালটা কাদের? দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, খেটে খাওয়া মানুষের, নাকি করগুনতি শিল্পপতিদের? তুলে ধরতে হবে সবকিছুর আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের হতাশা ও সরকারের চরম উদাসীনতাকে।’
কংগ্রেসের পাশাপাশি জেডিইউ, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, এনসিপি, আরজেডি, বামপন্থী দলগুলো তো বটেই, বিজেপি যাদের নতুন করে কাছে টানতে চাইছে, সেই অকালি দল পর্যন্ত এই অভিন্ন বিধির বিরোধিতা শুরু করেছে। অকালি দল মনে করছে, শিখপ্রধান পাঞ্জাব এর বিরোধিতায় নামতে বাধ্য হবে। কারণ, শিখসমাজের নানান প্রথা উঠিয়ে দিতে হবে। বিজেপির জোটসঙ্গী এআইএডিএমকেও বিষয়টি সন্তর্পণে এড়িয়ে যেতে চাইছে, যেহেতু ডিএমকে জোরালোভাবে অভিন্ন বিধির বিরোধিতা করেছে।এআইএডিএমকে বলেছে, দল ঠিক সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু ডিএমকে খড়্গহস্ত। তারা বলেছে, মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার সরকারের নেই। এই বিধি চালু করতে হলে বিজেপি আগে হিন্দুদের মধ্যে চালু করুক। দলিত, অনগ্রসর, অস্পৃশ্যরা যাতে দেশের সব মন্দিরে প্রার্থনার সুযোগ পান, তার বন্দোবস্ত করে দেখাক। হিন্দুধর্মের বৈষম্য দূর করুক। বিজেপিবিরোধী সব দলেরই এক কথা, সবদিক থেকে চূড়ান্ত ব্যর্থ বিজেপি এখন দুর্দশা থেকে মানুষের নজর ফেরাতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির চাল চালতে শুরু করেছে। তাদের বক্তব্য, বারবার একই চালে দাঁও মারা যায় না।তবে কিছুটা অন্য সুর শোনা গিয়েছে আম আদমি পার্টির মুখে। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা নীতিগতভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে। কিন্তু তা চালু করার আগে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন।দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, সব সময় দেখা গিয়েছে ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী জটিল সব বিষয়ের অবতারণা করেন। এবারও তাই করলেন। দলের নেতা সন্দীপ পাঠকের মতে, বিজেপি বিভ্রান্তি ও সংশয় সৃষ্টি করে বিভাজন ঘটিয়ে ভোটে ফায়দা তুলতে চায়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়েও তেমনই করতে চাইছে। এই নীতি বলবৎ করতে চায় না।মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড গত বুধবার রাতে এ নিয়ে বৈঠকে বসেছিল। সেখানে সবকিছু খতিয়ে দেখে ঠিক হয়েছে, ২১তম আইন কমিশনের কাছে যেসব যুক্তি পেশ করা হয়েছিল, এবারও তেমনই জানানো হবে। বিরোধিতা করা হবে। মুসলিম নেতারা বুঝতে পারছেন, বিজেপি এ বিষয় হিন্দু বনাম মুসলমানে পরিণত করতে চাইছে। তারা মনে করছে, মুসলমানরা এর বিরোধিতায় যত সরব হবে, ততই হিন্দু মেরুকরণ ঘটিয়ে ভোটে জিততে বিজেপির সুবিধে হবে। বিরোধী দলগুলোও তা বুঝতে পারছে।
বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের ক্ষেত্রে তারাও শাসক দলের এ প্রচেষ্টাকে হাতিয়ার করতে চাইছে।ভোটের আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অতিসক্রিয়তায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) কিছুটা চিন্তিত। তাদের চিন্তার কারণ, জনজাতি সমাজ এবং অন্য সংখ্যালঘুরা। বিশেষ করে দেশের বিস্তীর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে তারা ভাবিত। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে জনজাতির সমাজের উপস্থিতি বিরাট। এই নীতি নির্বাচনী ইস্যু হয়ে দাঁড়ালে বিরোধীরা সেখানে ফায়দা তুলতে পারে, বিশেষ করে মূল্যবৃদ্ধি ও কর্মহীনতার দরুন জনজাতি সমাজ যখন ব্যতিব্যস্ত। তা ছাড়া কোনো কোনো জনজাতি সমাজে মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু আছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তাতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। দেশে জনজাতিদের জন্য ৫০টির মতো লোকসভা আসন সংরক্ষিত। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে বিরোধী প্রচারে সেখানে ভিন্ন প্রভাব পড়লে বিজেপির পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে বলে সংঘের আশঙ্কা।অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার দাবি জনসংঘের সময় থেকে। তিনটি বিষয় তাদের অন্য সব দল থেকে পৃথক করে রেখেছিল। অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরি, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ ও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন—জনসংঘ থেকে বিজেপির জন্ম হওয়ার পরও এই তিন দাবি কোনো দিন তারা ছাড়েনি। সংবিধানপ্রণেতারা কিন্তু বুঝেছিলেন, ভারতের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহুধর্ম, ভাষা ও প্রথার দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন নানান অশান্তি ও অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। সে কারণেই ঐকমত্য স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ২১তম আইন কমিশনও বলেছিল, এখনই এর প্রয়োজন নেই।বিজেপি নেতারা অবশ্য বলছেন, তাঁরা শুধু তিনটি বিষয়ে সবার জন্য এক আইন চালু করতে আগ্রহী—বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার। স্বীকার না করলেও বিজেপি চায় এর মধ্য দিয়ে মুসলমানদের কোণঠাসা করতে এবং হিন্দু মানসিকতাকে জয়ী করতে। মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা বন্ধ করাতে তারা যতটা আগ্রহী, ততটাই আগ্রহ তাদের সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথা রদে। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারীদের পাশে দাঁড়াতে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীও মুসলিম দেশের উল্লেখ করে তিন তালাক প্রথা না থাকার ওপরে জোর দিয়েছিলেন।কিন্তু আরএসএসের শঙ্কা, এতে হিতে বিপরীত হলে শোধরানোর অবকাশ পাওয়া যাবে না। তাই বিজেপিকে তারা সতর্ক পদচারণের পরামর্শ দিয়েছে। খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, পারসি, জৈন, শিখ ও বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের প্রতিক্রিয়া ভালোভাবে বোঝার ওপর জোর দিয়েছে।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct