স্বপ্নের চোরাবালি
আহমদ রাজু
বাবার ব্যবসার সুবাদে আমাকে বছরে অনেকবার ঢাকায় যেতে হয়। এর একটা বিশেষ কারণও আছে, আমিযে বাড়ির বড় ছেলে! বয়স আহামরি বেশি, তাও নয়। কলেজে উঠেছি সবেমাত্র। হলফ করে বলতে পারি, যতবার ঢাকায় গিয়েছি আমার সহপাঠীরা ততবার স্থানীয় বাজারেও যায়নি। কথাটা একদম বাড়িয়ে বলছি না। বাড়িয়ে বলার কারণও নেই। বাবাকে এলাকার সবাই এক নামে চেনে। সাংঘাতির প্রতাপশালী লোক তিনি। বছরের অনেকটা সময় ঢাকায় পড়ে থাকেন। কি ব্যবসা তা জানি না; তবে শুনেছি কোন এক ফ্যাক্টরীতে কাঁচামাল সরবরাহ করেন। মাঝে মাঝে বিদেশে চামড়াও রফতানী করেন। বাবা যখন বাড়িতে আসে তখন এলাকার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিরা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। বদ্ধ ঘরে তাদের সাথে কি আলোচনা হয় তা আমার বোধগম্য হয়নি কোনদিন। বুঝতেও চেষ্টা করিনি। তার অবশ্য প্রয়োজন পড়েনি। দু’একবার বিশেষ প্রয়োজনে বাবার রুমে গিয়ে দেখেছি বাবাকে খাটের ওপর কোলবালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায়। হাতে মদের গ্লাস। পাশে দু’চারটা বিদেশী মদের বোতল। সামনে উপস্থিত ব্যক্তিরা উৎসুক হয়ে আছে তার পরবর্তী কথার অপেক্ষায়। মা বাবার এ অভ্যাসের ব্যাপারে কিছু কোনদিন বলেছে কিনা জানি না। তবে আমরা দেখলেও বিশেষ কিছু বুঝতে চেষ্টা করিনি। যার বাবা এমন ব্যক্তি তার ছেলে হিসাবে আমার কেমন থাকার কথা তা অনুমান করতে পারেন। চাওয়ার আগেই হাতের কাছে পেয়ে যাই সবকিছু। পোষাক পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে খাবার-দাবার সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া। বাবা বাড়িতে আসলে আমাদের যা প্রয়োজন না তাও নিয়ে আসেন। তবুও তার পকেট থেকে এক’শ টাকার নোট দু’একটা সরাতেও পিছপা হইনি কোনদিন। আর ঢাকাতে গেলে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বাড়িতে মনোপূত রান্না না হলে বাজারের আবুল হোটেলের খাবার আমাকে ঠেকাই কে। হোটেলের মুরগীর মাংস, লুচি, মুড়িঘন্ট আমাকে প্রতিনিয়ত টানে। এমন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় আমার বেড়ে ওঠা। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষকরা আমাকে অন্য নজরে দেখতো। এখন কলেজে উঠেছি। বাড়ির পাশে কলেজ হওয়ায় স্কুলের মতোই এখানেও আমার আধিপত্য বিস্তৃত। পড়াশুনায় যে ভাল তা নয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হবার জন্যে বাউন্ডুলেপনা সবাইকে হার মানায়। জিন্স প্যান্ট, বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকার ছবিওয়ালা টি-শার্ট, চোখে কালো চশমা আর পায়ে পেগাসাস কেটস্ পরে স্কুলে গেলেও ঠিকমত ক্লাস করা হয় না। একদিন হয়তো বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখতে গেলাম তো পরের দিন গেলাম সেলিমদের বাগানে জলপাই চুরি করতে। একবারতো সেলিমের বাবা ধরেই ফেলেছিল। আমরা কোনরকমে পালিয়ে এসে জানালা দিয়ে ক্লাস রুমের ভেতরে ঢুকে বেঞ্চে বসে পড়ি। নতুন কলেজ। ইটের গাঁথুনিতে টিনের ছাউনি দিলেও জানালায় গ্রীল লাগানো হয়নি টাকার অভাবে। সেলিমের বাবা কলেজে এসে অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করে। তিনি তখনি আমাদের রুমে এসে দেখেন, খগেন পন্ডিত বাংলা ক্লাস নিচ্ছেন। আমরা সবাই শান্ত হয়ে বেঞ্চে বসে আছি। খগেন পন্ডিতকে আমাদের কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘কী বলিতেছেন ইহা! উহারা প্রথম থাকিয়াই মোর ক্লাসে রহিয়াছে। ক্লাস চলাকালীন সময়ে কেহ রুমে ঢোকেনাই।’ মোটা ফ্রেমের চশমা পরা খগেন পন্ডিত এমনিতে চোখে কম দেখেন; তাছাড়া তিনি ক্লাসে ঢুকে চেয়ারে বসে বইয়ের পাতায় চোখ রেখে পড়াতে শুরু করেন। যে কারণে সামনে কি হচ্ছে তাঁর বোধগম্য হয় না। সে যাত্রা খগেন পন্ডিতের জন্যে আমরা সবাই বেঁচে গিয়েছিলাম। তা না হলে আর কিছু না হোক অন্তত চুরির অপরাধে অধ্যক্ষের বেতের বাড়ি থেকে আমাদের কেউ রক্ষা করতে পারতো না। আমার বলতে আপত্তি নেই, যতবারই ঢাকায় যাই ততবার টিকিট কাউন্টারে বলি মহিলা যাবে। তাতে একটা বাড়তি সুবিধা হয়; তারা চায় অন্তত মহিলার পাশে মহিলাই বসুক। আমি তাদের এই সরল ইচ্ছাটাকে কাজে লাগাই প্রতিনিয়ত। দু’একদিন পাশের সীটে মনোপূত মেয়ে বসলেও অধিকাংশ দিন বয়স্ক মহিলা পেয়েছি। তখন যে মনের কী অবস্থা হয়েছে বোঝাতে পারবো না। তারপরও মন খারাপ না করে আমার নিয়মে অনড় থাকি, যদি কোনদিন ভাগ্যে কোন সুন্দরী মেয়ে জোটে সেই অপেক্ষায়। তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি, এখনও কোন মেয়ের সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। কেমন আছেন? ভাল আছি, এমনও নয়। পাশে বসে চুপচাপ সারারাত কাটিয়ে দিয়েছি। বাস থেকে নামার পরে বরাবরই মনে হয়েছে, কেন কথা বললাম না? একটু হায়-হ্যালো বললে কি এমন ক্ষতি হতো! আসলে আমি যে বলতে চেষ্টা করিনি তা নয়; করেছি। পারিনি। মনের গভীর থেকে সাহস হয়নি। যদি পাছে আমাকে বেশি কিছু বলে বসে- অপমান করে। দুষ্টুর সেরা হয়েও মেয়েদের সামনে এসে ভেজা বিড়ালের আকার ধারণ করার কারণ মনের কাছে প্রশ্ন করেছি অনেকবার; কোন উত্তর পাইনি।সকালে কলেজে যাবার জন্যে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার সময় বড় আপা পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘নীলম মা তোকে ডাকছে?’আমি থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাই। বললাম, ‘ক্যান, কিছু হয়েছে নাকি বড় আপা?’‘আমি তা জানিনা। আর তোকে ডাকতে হলে কি কিছু হতে হবে? খুবতো বড় হয়ে উঠেছিস!’‘সকাল বেলা এত কথা শোনাচ্ছিস ক্যান? তোকে প্রশ্নটা করলাম; পারলে বল, না পারলে না।’আমার কথার উত্তর না দিয়ে ‘দিন দিন একটা বাঁদর তৈরী হচ্ছে’ বলতে বলতে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে চলে যায় বড় আপা।সীমা আপা সবার বড়, সেঝো উপমা। বড় আপার বিয়ে হয়েছে গত বছরের ষোলই ডিসেম্বর-বিজয় দিবসের দিনে। উপমা ক্লাস এইটে পড়ে। আমি ভাইদের ভেতর বড়। সবার ছোট মুরাদ। সে ক্লাস সিক্সে উঠেছে এবার।মা কেন ডাকছে জানতে তাঁর কাছে যাই। মা তখন রান্না ঘরে ব্যস্ত। আমাকে দেখে বললেন, ‘নীলম বাবা, বাজারের টাকাতো শেষ প্রায়। তোকে যে একবার ঢাকায় যেতে হবে।’ মায়ের এটুকু কথায় আমি মনে মনে যারপরনাই আনন্দিত হই। তবুও মুখে চিন্তার ছাপ এঁকে বললাম, ‘কী বলেন আম্মা!’‘হ্যা বাবা, যা আছে তাতে আর বড়োজোর এ সপ্তাহ চলতে পারে।’‘এভাবে কলেজ বন্ধ করে ঘন ঘন ঢাকায় গেলে লেখাপড়া.....’আমার কথা শেষ না হতেই মা বললেন, ‘আমি বুঝি, কিন্তু কি করবো বল? বাড়ির তুইতো বড় ছেলে। তাছাড়া তুই ঢাকা যেভাবে চিনিস আর কেউ সেভাবে চেনে না।’‘আমাকে এখন কি করতে হবে তাই বলেন।’‘নওয়াপাড়া এক্সচেঞ্জে যেয়ে তোর আব্বাকে ফোন করে দেখ, আজ আসতে বলে কি না।’আমি মনে মনে ভাবছিলাম মা যেন এখন কলেজে যাওয়া বাদ দিয়ে বাবাকে ফোন করতে যেতে বলেন। তবুও মাকে মন বোঝানোর জন্য বললাম, ‘তাহলে কলেজ ছুটি হলে তারপর যাই।’আমার ভাবনাকে তাড়িয়ে দিয়ে মা বললেন, ‘যা; কলেজ থেকে ফিরে বিকেলে যাস ফোন করতে। যদি যেতে বলে তাহলে আগামীকাল রাতে যাস ঢাকায়।’মনটা আমার মুহূতে খারাপ হয়ে যায়। বললাম, ‘আম্মা আজ কলেজে তেমন কোন ক্লাস নেই। এখন যাই বাবাকে ফোন করে আসি। টাকা দেন।’‘এখন যেতে হবে না। আগে কলেজ থেকে আয়। খেয়ে দেয়ে বিকেলে নিরিবিলি যাস।’আমি জানি মা যখন বলেছেন তখন তার না হ্যাঁতে রূপান্তরিত করা যাবে না। অগত্যা কলেজের পথ ধরি। কলেজে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ ঢাকায় যাবার আনন্দটা মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করছিল।অন্যদিন ক্লাস শেষ হলে বাড়ি আসতে দেরি হতো বিভিন্ন কারণে। কখনও আড্ডা দেওয়া- কখনও সিনেমা দেখতে যাওয়া। আজ দেরি না করে সরাসরি বাড়িতে চলে আসি। তাড়াতাড়ি নাকে মুখে খেয়ে নওয়াপাড়া যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াই। মা বুঝতে পেরে আমার হাতে দশ টাকার তিনটা নোট দিয়ে বললেন, ‘তোর বাবার কাছে ভাল করে শুনিস, কখন যেতে হবে।’‘আচ্ছা আম্মা।’ বলে আমি আর সেখানে না দাঁড়িয়ে নওয়াপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই।আমি জানতাম বাবাকে ফোন করলে টাকা আনার জন্যে আমাকে ঢাকায় যেতে বলবেনই; কখনও না করবেন না। বিগত দিনগুলোতে ফোন করার পর তিনি বলেননি আসতে হবে না কিংবা ক’দিন পরে আসিস ইত্যাদি। তারপরও মায়ের দেওয়া ত্রিশ টাকা নিজের পকেটস্থ করতে বাবাকে ফোন করা জরুরী। নতুবা বাবা যখন বাড়িতে আসবেন তখন মা যদি কথায় কথায় বাবাকে ফোনের কথা বলে দেন তো সর্বনাশ! আমি এ ব্যাপারে কোন রিক্স নিতে চাই না। এমনিতে নওয়াপাড়ায় যাওয়া-আসা দেড় দেড় তিন টাকা, ফোন বিল সাত টাকা। এই মোট দশ টাকা। আমার পকেটে থাকবে বিশ টাকা; যা মা ফেরত চাইবে না কখনও। যাইহোক নওয়াপাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জ-এ যেয়ে হোটেলের নম্বরে ফোন করে আমার পরিচয় দিতেই ওপাশ থেকে বলল, ‘ওনাকে ডেকে ফোন করতে বলছি। তুমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো।’ দু’মিনিট বাদেই ফোন বেজে ওঠে কিড়িং কিড়িং। ‘হ্যালো.. কে? নীলম?’‘হ্যা আব্বা। আসসালামু আলাইকুম।’‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস তুই?’‘জ্বী আব্বা আমি ভাল। আপনার শরীর কেমন?’বাবা আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘বাড়ির সবাই ভাল আছে তো?’‘হ্যা আব্বা, সবাই ভাল আছে।’‘তুই কলেজে ঠিকমত যাচ্ছিস, নাকি মাস্তানী করে বেড়াচ্ছিস?’বাবার কথায় আমি থতমত খেয়ে যাই। বললাম, ‘না আব্বা যাচ্ছি।’‘ফোন করেছিস, কিছু বলবি?’‘হ্যা আব্বা।’‘বল।’ ‘বলছিলাম বাড়ির খরচের টাকা প্রায় শেষ....’আমার কথা শেষ না হতেই বাবা বললেন, ‘সেতো বুঝতে পারছি। ব্যবসার যে চাপ তাতে দু’ছয় মাসের মধ্যে বাড়ি যেতে পারবো কিনা সন্দেহ। তুই কি একটু আসতে পারবি?’‘কেন পারবো না!’‘আমি বুঝি, তোর পড়াশুনা বাদ দিয়ে ঢাকায় আসতে হচ্ছে। কিন্তু কি করবো বল, সবার ওপরতো আর ভরসা করা যায় না।’‘আমার কোন অসুবিধা হবে না।’আমার কথায় কর্ণপাত না করে তিনি বললেন, ‘গত বছর জয়নালের কাছে বাড়িতে দেবার জন্যে হাজার দুই টাকা পাঠিয়েছিলাম; শুয়ার সেই টাকাটা আজো দিলো না। ওর-ই বা দোষ কী? অভাবের সংসার খরচ করে ফেলেছে; এখন জোগাড় করতে পারছে না।’চলবে...‘থাক বাবা যা গেছে...।’‘ওটাতো আমি ভুলে গেছি। আজ হঠাৎ মনে পড়লো তাই বললাম। ও কি যেন বলছিলি..’‘বলছিলাম আমি কবে আসবো?’‘আমি আছি, তুই আজ কাল যখন সময় পাস তখনই চলে আসিস।’‘আচ্ছা আব্বা। তাহলে আমি এখন রাখি?’‘আচ্ছা রাখ।’ বলে বাবা ফোন রেখে দেন। আমি পুলকিত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, আগামীকাল রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। খুলনা থেকে ঢাকায় তিনটি পরিবহন যাতায়াত করে। বলাকা, দ্রুতি, সৌখিন আর সোহাগ। আমি বরাবরই বলাকা পরিবহনে যাতায়াত করি। এর অবশ্য কারণও আছে, চেয়ার কোচ বলাকা আর সৌখিন পরিবহনের আছে। বলাকা পরিবহনের কোচ অপেক্ষাকৃত আরামদায়ক। যদি অন্য কোন পরিবহনে ভাল কোচ থাকতো তাহলে হয়তো দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতাম। বাবার টাকা, আমার সমস্যা কোথায়। বাবা আমাকে কখনও বলেননি নরম্যাল কোচে যাতায়াত করতে। তাছাড়া তিনি কখনও চেয়ার কোচ ছাড়া যাতায়াত করেন না। তার ছেলে হয়ে আমি নরম্যাল বাসে ঢাকায় গেলে তার সম্মান থাকবে বলে আমার মনে হয় না। যথারীতি কাউন্টার মাষ্টারকে বলি আগামীকাল রাতে একজন মহিলা ঢাকায় যাবে, ভাল সিট দিতে। সে বলল, রাতে টিকিট কেটে রাখবে সকালে এসে আমি যেন নিয়ে যাই। আগের দিন বলার কারণ, যাতে ভাল সিট পাই। তা না হলে দিনের দিন ভাল সিট নাও থাকতে পারে। তাছাড়া আর একটা চিন্তা মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। এবার আমার পাশে কে বসবে? সে অল্প বয়সী কোন সুন্দরী মেয়ে- নাকি মায়ের বয়সী কেউ! এমন চিন্তায় যখন আমি অস্থির তখন নিজেই নিজের মনকে বোঝাই- যা হোক একটা কিছুতো হবেই। এত চিন্তা করে কাজ কি?ঢাকায় যাবার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হবার সময় বাবাকে কি কি কথা বলতে হবে মা সব বারবার বুঝিয়ে দিলেন। গাড়ি থেকে গাবতলী নেমে সোজা হোটেলে যেন চলে যাই, সে কথাও বলতে ভুললেন না। আর আমি যেন বাইরের কোন খাবার না খাই তার জন্যে কয়েকটা রুটি, ডিম-আলুভাজি করে আমার ব্যাগে ভরে দিলেন। বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাস কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়েছি তার কিছুক্ষণ পর কাক্সিক্ষত বাসটি সামনে এসে দাঁড়ায়। বাসে ওঠার পর সুপারভাইজার আমার কাছ থেকে টিকিটটা নিয়ে সিট দেখিয়ে দিলেন। সাথে থাকা ব্যাগ মাথার ওপর বাংকারে রেখে সিটে বসে পড়ি।গাড়ি চলছে তার নিজস্ব গতিতে। পাশে কে বসেছে এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। আর আমার মনের ভেতরে যা-ই সৃষ্টি হোক না কেন; সেটা বাস্তবায়ন করতে গেলে নিজেকে সামলাতে পারি না। বিশেষ করে যতই মন চায় মেয়েদের সংস্পর্শে আসতে- কাছে আসলে ততই নিজেকে সরিয়ে নিই। কেন এমন হয় তা জানি না। তা না হলে এতদিন মনে মনে যেমনটি চেয়েছিলাম ঠিক তেমন একটা মেয়ে আমার পাশের সিটে বসে আছে অথচ আমি তার দিকে খেয়ালই করিনি!
ইতিমধ্যে গাড়িটা যশোর শহরের মনিহারে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ইঠা খোন্ জাইগা?’ কথাটা কানে যেতেই সঞ্চিৎ ফিরে পাই। আমি মেয়েটার দিকে এক নজর তাকাই। হঠাৎ মনের ভেতর এক অন্য রকম অনুভূতি দোলা দিয়ে যায়। তবে কিসে যেন মিলছে না মনের সাথে। আসলে প্রশ্নের সাথে চেহারার কোন মিল নেই। সাদা ধবধবে গায়ের রং, সোনালী চুল, জিন্স প্যান্ট আর সাদা টি শার্ট, একদম বিদেশী, অথচ বাংলায় কথা বলে! শুধু কথায় একটু আলাদা টান। মানুষের মতো মানুষতো হতেই পারে। তাছাড়া ঢাকার মেয়েরা ইদানীং বেশ মর্ডান হয়েছে- হবার চেষ্টা করছে। আমি আকাশ পাতাল ভাবতে থাকি।‘হাপনি কি ভলিতে ফারিবেন ইঠা খোন্ জাইগা।’ ক্ষণেক পরে ভাঙা বাংলায় আবারো প্রশ্ন করে মেয়েটি। মনিহার সিনেমা হলের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে বড় অক্ষরে মনিহার লেখা দেখেও আমাকে প্রশ্ন করছে দেখে বিস্মিত হলাম। বললাম, ‘যশোর মনিহার।’‘ও আইচ্চা।’মেয়েটি আমার সাথে যেচে কথা বলছে দেখে আমার মনের আড়ষ্টতা কেটে যেতে থাকে। বললাম, ‘আপনাকে দেখেতো এ দেশীয় মনে হয় না।’মেয়েটি স্বভাব সুলভ ভাঙা বাংলায় বলল, ‘হাপনি ঠিক ভলিয়াছেন; হামার কান্ট্রি এ্যামেরিকা।’‘ভালইতো বাংলা বলতে পারেন।’ বিস্মিত আমি।‘ভেশ খ’বার ভাংলাদেশে হাসিয়াছি। হাস্থে হাস্থে শিখিয়া ফেলিয়াছি।’‘এখানে কী করেন?’‘খ্রিস্টান মিশনারী হসপিটালের জুনিয়র ডক্টর হামি। এইবার হাসিয়াছিলাম খুলনায়।’আমি মনে মনে খুশি হই, যা বাইরে প্রকাশ করি না। বললাম, ‘খুলনায় কতদিন থাকবেন?’আমার খুশিটাকে ম্লান করে দিয়ে বলল, ‘ঘতকাল হামার খাজ শেষ হইয়াছে। ঠাইতো পরিবারসহ এ্যামেরিকায় ফিরিয়া যাইতেছি।’‘কে কে আছে আপনার পরিবারে?’‘ফাদার-মাদার হার হামি। ঐ যে বসিয়া আছে।’ বাসের প্রথম সিটের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল কথাটি।‘এবারে কতদিন থাকলেন?’তিন আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ‘থ্রি মানথ্।’ ‘আরো কিছুদিন থেকে যেতে পারতেন?’‘হাসলে প্রোজেক্টের খাজ, ঠাকার খোন সুযোগ নাই।’‘আপনার নামটা.....’ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘হামি মার্টিনা স্মিথ। হাপনি?’‘নীলম; নীলম বিশ্বাস।’‘নীলম! গ্রেট রিভার; ফাইন।’আমি অর্থটা ভাল বুঝতে না পেরে শুধুমাত্র সামাজিকতা রক্ষা করার জন্যে বললাম, ‘থ্যাংকউ।’মার্টিনা স্মিথ আমাকে অপ্রস্তুতভাবে প্রশ্ন করলো, ‘নীলম রিভার খোথায় হবস্থিত ভলিতে পারিবেন?’আমি না সূচক মাথা দুলাই।‘হাফনার ফ্রতিবেশি দেশ। যেইখানে বছরের হধিকাংশ সময় যুদ্ধ বাঁধিয়া থাকে, সেই কাষ্মীরে। হেই নদী-ই হালাদা খরিয়াছে ভারত হার ফাকিস্তানকে। বহু রক্তের স্বাক্ষী হেই নীলম নদী।’‘আপনি গিয়েছেন সেখানে।’‘হু; থবে নদীর ফানি ছুঁয়ে দেখিবার সাহস হয় নাই। শুধুমাত্র নিকট থেকে দেখিয়াছি।’‘আপনিতো অনেক দেশে গিয়েছেন তাই না?’আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘খি জব খরেন হাপনি?’‘তেমন কিছু না, কলেজে পড়ছি এখনো।’‘এক্সসিলেন্ট।’‘মানে!’‘খলেজ স্টুডেন্ট এঠাইবা খম খিসে?’‘বুঝিনি।’‘এ্যামেরিকান সরখার কলেজ স্টুডেন্টদের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিয়া থাকে।’‘আমেরিকাতো স্বপ্নের দেশ।’‘হ্যা, স্বপ্নের দেশ ভলিতে ফারেন। তবে হাপনাদের মত রিলেশনশীপ এ্যাবল এ্যাবল নাই সেখানে।’‘জীবনতো গঠন করা যায়। আমার খুব ইচ্ছা ছিল...।’‘হাপনি যাবেন হামাদের দেশে?’ উৎসুক প্রশ্ন মার্টিনা স্মিথের।‘কীভাবে?’ বিস্মিত প্রশ্ন আমার।‘সেঠা হামার ওপর ছাড়িয়া দিন।’ঘড়ির কাটা রাত দুটো পার করেছে আরো ত্রিশ মিনিট আগে। এইমাত্র বাসটি আরিচা ঘাটে এসে পৌঁছেছে। ঘাটে তেমন জ্যাম না থাকলেও সামনে শ’দুয়েক গাড়ি ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায়। মার্টিনা স্মিথের সাথে কথা বলতে বলতে কখনযে গাড়িটি ফেরির ওপর উঠেছে টেরই পাইনি। যখন বুঝতে পারি তখন গাড়িতে দু’চারজন বাদে আর সবাই নিচে নেমে গেছে। আমি মার্টিনা স্মিথকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘ফ্রেস হবার জন্যে নিচে যেতে চাইলে যেতে পারেন। গাড়ি এখন ফেরির ওপর।’আমার কথা শুনে সে সামনের সিটে তাকিয়ে দেখে তার বাবা-মা দুজনেই নেই। আমি বুঝতে পেরে বললাম, ‘হয়তো তারাও ফ্রেস হবার জন্যে নিচে গ্যাছে।’‘পড়িয়া যাইবো নাতো?’ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে মার্টিনা স্মিথ।‘আমি আছি আপনার সাথে। চলুন কোন ভয় নেই।’আমার হাত ধরে নিচে নামে। ওয়াশ রুম দেখিয়ে দিলে সে ফ্রেস হয়ে আসে। আমি ঝালমুড়ি কিনি। সে খায় আমিও খায়। যেন দু’জন দু’জনকে অনেক আগে থেকে চিনি। আমি এই মুহূর্তে ভুলে গেছি আমি আসলে কে? তাছাড়া সেই দুষ্টুমী, মেয়েদের দেখলে বিশেষ দুর্বলতা কোন কিছুই আর কাজ করছে না। তবে মনে হচ্ছে আমি মার্টিনা স্মিথের প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছি। হয়তো তারও এমন অবস্থা। তা না হলে সে কেন আমার হাত ধরে বাস থেকে মানবে? কেন সে আমার সাথে এত কথা বলবে?
ফেরি পার হয়ে রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করলে যেচে বলল, ‘হামি হাগামী সানডে ভিকেলের ফ্লাইটে এ্যামেরিকায় চলিয়া যাইবো।’‘এই তিন দিন কোথায় থাকবেন?’‘হোটেল সোনারগাঁও। সিট বুক খরিয়া রাখা।’হোটেল সোনারগাঁও আমি চিনি। বাবার ওখানে যেতে পথের ডান পাশে পড়ে। তাইতো দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন না করে বললাম, ‘ও আচ্ছা।’‘হামার ফোন নম্বরটা রাখুন। আর হ্যাঁ, হাপনি যেইখানে থাকিবেন সে জায়গার ফোন নম্বরটা দিন। হাপনার সাথে যোগাযোগ খরিবো।’আমি কালক্ষেপন না করে পকেট থেকে কাগজ-কলম বের করে বাবা যে হোটেলে থাকে সেই হোটেলের টেলিফোন নম্বরটা লিখে দিলাম। আর মার্টিনা স্মিথের টেলিফোন নম্বরটা নিয়ে মানিব্যাগের গোপন কুঠুরিতে রেখে দিলাম। সায়েদাবাদ বাস ডিপোয় সকাল সাতটায় পৌঁছাই আমরা। সবাই একে একে গাড়ি থেকে নামি। মার্টিনা স্মিথ তার বাবা-মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। তাঁরাও সুন্দর বাংলা বলতে পারে। হয়তো মেয়ের সাথে এদেশে এসেছে অনেকবার কিংবা তারাও এদেশে চাকুরী করে। তা না হলে এমন শুদ্ধ বাংলা বলতে পারার কথা নয়। তাদের জন্যে আগেই একটা পাজারু গাড়ি অপেক্ষায় ছিল। আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে গাড়িতে উঠে বসে। মিনিট খানেকের মধ্যে আমার চোখের সামনে থেকে যখন অদৃশ্য হয়ে যায় গাড়িটি তখন আর আমার মনের ভেতরে প্রতি সেকেন্ড ঘুর ঘুর করতে থাকে মার্টিনা স্মিথের স্মৃতি। কেন জানি দুনিয়ার সকল চিন্তা এক জায়গায় এসে আটকে গেছে মুহূর্তে।হোটেলে যেয়ে সরাসরি বাবার রুমে চলে যাই। রিসিপশনে কোন কিছু শোনারও প্রয়োজন বোধ করি না। আসলে এই হোটেলের তিন’শ আট নম্বর রুমে বাবা আছে বেশ ক’বছর ধরে। বাবা রুমটাকে বাড়ির মতোই ব্যবহার করেন। এমনকি বাড়িতে তাঁর যেমন একটা কোলবালিশ আছে এখানেও ঠিক তেমনি কোলবালিশ আছে। আর আমি যে কতবার এসেছি তার ঠিক নেই। যে কারণে হোটেলের ম্যানেজার থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সবাই আমাকে চেনে।দরজার পাশে লাগানো কলিংবেল চাপতেই বাবা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘আয়; আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?’‘না আব্বা।’ আমি রুমের ভেতরে ঢুকে টেবিলের ওপর ব্যাগ রেখে তার থেকে লুঙ্গিটা বের করি। প্যান্ট-শার্ট খুলে আলনায় রেখে লুঙ্গিটা পরে খাটের ওপর নিজেকে এলিয়ে দিই। এসি রুম। না চাইলেও একটু পরে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাবে।আমার ক্লান্তি দেখে বাবা বললেন, ‘তুই ঝটপট গোসলটা সেরে নে। আমি ততক্ষণে নাস্তার কথা বলছি।’আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি। ফ্রেস হয়ে যখন বের হই তখন দেখি টেবিলের ওপর গরম পরটা, ডিম-ডালভাজি আমার জন্যে অপেক্ষায় আছে। অন্যদিন হলে খিদেয় পেটটা চো চো করতো। আজ অবশ্য তা একবারের জন্যেও করছে না। বরং খাবারের কথা আমার মনের ভেতরে আসেনি একবারও। মা যে খাবার দিয়ে দিয়েছিলেন তা হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।‘নে খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিবি।’‘আপনি খাবেন না?’ আমি বাবাকে প্রশ্ন করি।‘না; তুই খা। আমি কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি।’আমি খাওয়া শুরু করেছি। বাবা বললেন, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি। আসতে রাত হয়ে যেতে পারে। দুপুরে খাবার দিয়ে যাবে রুমে। কোন সমস্যা নেই তো?’‘না আব্বা, কোন সমস্যা নেই।’‘কোন কিছুর দরকার হলে ম্যানেজারকে জানাস।’আমি মুখে উত্তর না দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াই। বাবা বাইলে চলে যায়। আমি নাস্তা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুরে ওয়ার্ড বয় খাবার দিয়ে গেলেও সেটা খাওয়া হয় না। ঘুমের মধ্যে কখন দরজা খুলে দিয়েছি- কখন সে খাবার দিয়ে গেছে কিছুই মনে নেই। ঘড়ির কাটা যখন পাঁচটার ওপর তখন ওয়ার্ড বয়ের কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বলল, ‘আপনাকে কেউ ফোন করেছে; আসুন তাড়াতাড়ি।’কে ফোন করেছে তা জানতে বাকী থাকে না। কারণ এর আগে কেউ কোনদিন ফোন করে আমাকে চায়নি। আজ যখন ফোন এসেছে তখন মার্টিনা স্মিথ ছাড়া আর কেউই হতে পারে না। আমি তড়িঘড়ি নিচতলায় অফিস রুমে যাই। ম্যানেজার রিসিভারটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘কথা বলো লাইনে আছে।’আমি কাঁপা কাঁপা হাতে সিরিভারটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, ‘হ্যালো।’স্বভাব সুলভ ভাঙা বাংলায় মার্টিনা স্মিথ বলল, ‘হ্যালো হামাকে ভুলিয়া গিয়াছেন নাকি?’আমি থতমত খেয়ে যাই। এদিক ওদিক তাকায়। সামনে হোটেল ম্যানেজার বসে তার কাজে ব্যস্ত। দু’চারজন সোফায় বসে টিভি দেখছে। বুঝতে পারি যা কিছু বলতে হবে, এদের ভেতরে থেকেই বলতে হবে। বললাম, ‘সেটা কী সম্ভব?’‘তাহা হইলে ফোন ধরিতে দেরি হইলো?’‘আসলে হোটেলের অফিস রুম নিচে। আমি আছি তিন তলায়। নামতে যতটুকু সময় লেগেছে এই যা।’‘কী খরিতেছিলেন?’‘ঘুমিয়ে ছিলাম।’‘হামিও সেই সকাল থেকে ঘুমাইয়া ছিলাম। ঘুম থেকে উঠিবার ফর হাপনার কথা মনে হইলো থাই ফোন খরা।’‘আমারও আপনার কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়েছে। কিন্তু আপনার হোটেলের নম্বর আমার কাছে নেই। যে কারণে ফোন করা হয়নি। আপনি যদি হোটেলের ফোন নম্বরটা দিতেন।’‘তাহার আর দরকার হইবে কী? সানডে তো হামরা চলিয়া যাইতেছি। যে নম্বরটা দিয়াছি ওঠা যত্ন করিয়া রাখিবেন। এ্যামেরিকায় যাইয়া হাপনার সাথে কথা হইবে।’আমি মনে মনে বললাম, ‘যত্ন কী, আমিযে হৃদয় দিয়ে আগলে রেখেছি। ঐ নম্বরটাই হয়তো তোমাকে আমার আরো কাছে নিয়ে আসবে।’আমার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে মার্টিনা স্মিথ বলে ওঠে, ‘কী হইলো খথা ভলিতেছেন না যে?’আমি সঞ্চিৎ ফিরে পেয়ে বললাম, ‘আপনি টেলিফোন নম্বর দিয়েছেন আর আমি তাকে অবজ্ঞা করবো তাই কি হয়?’‘হামি তা বলিনাই। আচ্ছা যাইবার হাগে হাপনার সাথে হামার কি দেখা হইতে ফারে না।’‘অবশ্যই পারে। কোথায় দেখা করবো বলুন।’‘ঢাকা হামি খম্ বেশি চিনি। হাপনি বলুন খোথায় হাপনি হাসিবেন।’‘তাহলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে আসুন।’‘খাল্ সকাল এগারোটায় হাসিতে আপত্তি নেই তো?’‘আপত্তি কি বলছেন! আসতেতো আমাকে হবেই।’‘থ্যাংকউ। হামি হাপনার হপেক্ষায় থাকিবো।’মার্টিনা স্মিথ লাইন কেটে দেয়। আমি রিসিভারটা রেখে দিয়ে মনের আনন্দে সিঁড়ি বেয়ে রুমে চলে যাই। হোটেলে লিফট থাকলেও খুশির জোয়ারে সেটাও ভুলে গেছি নিমেষে। মন প্রাণ সব একাকার হয়ে আছে এক অদৃশ্য আবেশে। এমন ভাললাগা বোধকরি আর আসেনি জীবনে। এখন শুধু অপেক্ষা কাল সকাল এগারোটার। জানিনা সেই কাক্সিক্ষত সময় আসতে আর কত দেরি হবে। কোকাপ শহরের মায়ায় ভুলে গেছি বাড়ির কথা, সহপাঠীদের কথা, কলেজের কথা, তমা- সুমা- মিতুয়া- মনিরাদের কথা। যাদের নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে কাটাতাম রাতের পর রাত। বাস্তবে কাউকে ভালবাসার কথা না বলতে পারলেও স্বপ্নতো দেখতে পারতাম। এটাইবা কম কিসের!প্যাকেট ভরে আপেল, কমলা আর জুস নিয়ে রাত সাড়ে ন’টায় হোটেল রুমে আসে বাবা। টেবিলের ওপর ব্যাগ রেখে বললেন, ‘নে খা, আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।’আমার খিদে নেই বললেই চলে। আসলে মার্টিনা স্মিথের সাথে কথা বলে আনন্দে পেট আমার তখনি ভরে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, আগামীকালের সকাল এগারোটা আমার মনের ভেতরে উত্থাল পাথাল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কি কথা বলবে সে? আমাকে ভালবাসি বলবে- নাকি বলবে তার স্বামী-সংসার আছে! সব উল্টো পাল্টা চিন্তা মাথার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে। বাথরুম থেকে বাবা বের হলে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। বললেন, ‘কই খাচ্ছিস না তো? খা, একদম তাজা ফল। যশোরে এমন তাজা ফল সহজে পাওয়া যায় না।’আমি প্যাকেট থেকে একটা আপেল বের করে তাতে কামড় বসাই। বাবা বললেন, ‘তা বল, বাড়ির সবাই কেমন আছে?’আমি আপেল চিবোতে চিবোতে বললাম, ‘ভাল আছে আব্বা।’‘তোর পড়াশুনা কেমন চলছে?’‘ভাল।’‘সীমা বেড়াতে এসেছিল শুনেছিলাম। ওকি চলে গেছে?’‘না বড় আপা বলছিল শুক্রবারে দুলাভাই এসে নিয়ে যাবে। আজ হয়তো চলে গেছে।’‘উপমা ঠিকমতো স্কুলে যায় তো?’‘হ্যা আব্বা যায়। ওর জন্যে একটা ছাতা কিনে নিয়ে যেতে বলেছে। রোদে স্কুলে যেতে ওর খুব কষ্ট হয়।’‘বাজার থেকে একটা কিনে দিতে তো পারতিস?’‘আমি চেয়েছিলাম; ও ঢাকার ছাতা ছাড়া নেবে না।’‘কেন! ঢাকার ছাতা কেন?’‘তা জানিনা। বললো ঢাকার ছাতা নাকি ভাল।’‘ছাতা তো একই হয়। কি ভেবে বলেছে কি জানি।’‘আপনি একটা ছাতা কিনে দিয়েনতো। ওর শখ অন্তত পূরণ হোক।’‘ঠিক আছে কিনে দেবো কালকে। বাড়িতে খরচের জন্যে কয় টাকা দিতে বলেছে তোর মা?’‘আম্মা তেমন কিছু বলেননি। আপনি হিসাব মতো দিয়েন।’‘ও হ্যাঁ মুরাদের আর কী জ্বর হয়েছিল?’‘মাস খানেক আগে একবার হয়েছিল; তারপর আর হয়নি। হয়তো ঠিক হয়ে গেছে।’‘কী যে হলো ছেলেটার!’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বাবা।কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন, ‘কাল সকালে তাহলে টাকা নিয়ে বাড়িতে চলে যাস।’বাবার কথায় আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কাল সকালে বাড়ি ফিরে যাবো মানে! বললাম, ‘কাল রাতে যাই আব্বা? দিনের বেলা গাড়িতে বসতে খুব কষ্ট হয়। মনে হয় সময় আর শেষ হবে না। তার চেয়ে রাতে গেলে এক ঘুমে যশোর।’আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আর কোন কথা বলে না বাবা। বললেন, ‘ঠিক আছে রাতে যেতে চাস যাবি।’বাবার কথায় আমি স্বস্তি ফিরে পাই। বাবা যদি রাজি না হতেন তাহলে আমার মনের কি অবস্থা হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে সময় যত পার হয় ততই মার্টিনা স্মিথের প্রতি দুর্বলতার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সারাক্ষণ চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার মায়াভরা মুখ, সোনালী চুল, সেই হাসি- লাজুক পেলবতা। জানিনা কেমন করে তার বাঁধনে বাঁধা পড়লাম! একবার অবশ্য একজন জ্যোতিষী আমাকে বলেছিল, একসময় আমার নাকি অনেক টাকা পয়সা হবে। জানতে চেয়েছিলাম, কপালে বিয়ে টিয়ে আছে কিনা? সে আবারো আমার ডান হাতটা কোলের ভেতরে টেনে নিয়ে মিনিট খানেক রেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আমার নাকি খুব বড় জায়গায় বিয়ে হবে। আজ মার্টিনা স্মিথের সাথে পরিচয়-ঘনিষ্টতার কারণে সেই জ্যোতিষীর কথা মনে পড়ে যায়। হয়তো জ্যোতিষী সেদিন ঠিকই বলেছিল।সকালে বাবা বাইরে চলে গেলে আমি ন’টার দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশ্যে বাসে উঠে পড়ি। সকালে রাস্তায় জ্যাম না থাকায় পনের মিনিট বাদে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। মূল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে অশ্বথ গাছের নিচে যেয়ে বসে হাত ঘড়িটার দিকে চোখ রাখি। দশটা পনের। এগারোটা বাজতে আরো অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকী। বুঝতে পারি, বেশ আগেই এসে পড়েছি; কিন্তু যদি রাস্তায় জ্যাম থাকতো তাহলে সময় মতো আসা কষ্টকর হয়ে যেতো। আগে আসা ভাল কিন্তু জ্যামে পড়ে কথা না রাখাটাকে আমি কোনভাবে সমর্থন করতে পারি না। আশপাশের দু’একজন আমার দিকে আড়চোখে তাকায়। তারা কি দেখছে তা জানি না- জানার চেষ্টাও করি না। যেখানে সেখানে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে প্রেমিক-প্রেমিকারা জোড়ায় জোড়ায় বসে গল্প করছে- কেউ কেউ খুনসুটিতে মাতোয়ারা। কেউবা আবার আমার মত একা বসে কারো জন্যে অপেক্ষায় আছে। আমি অজান্তেই ঘাসের একটা লতা ছিঁড়ে নখ দিয়ে তার শরীর থেকে পুরোনো খোসা ছড়াই আর এদিক ওদিক তাকাতে থাকি। মার্টিনা স্মিথ আসছে না দেখে আমার কেন যেন একবারও মনে হয় না সে আসবে না কিংবা ভুলে গেছে কিংবা অন্য কিছু। আমার সব সময় মনে হয় সে আসবে-অবশ্যই আসবে।আমার বিশ্বাসকে দৃঢ় করে মার্টিনা স্মিথ সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে তার অসম্ভব হাসি। আমি উঠে দাঁড়াতে যাবো এমন সময় সে নিজেই আমার সামনে ঘাসের ওপর বসে পড়ে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘তুমি ঘাসের ওপর বসতে পারবে! না হয় চলো ঐখানটায় যেয়ে বসি।’‘নো থ্যাংকস্। এইকানেই ভাল। আর থুমি যে বলিলে ঘাসের কথা, অল কান্ট্রিতে ঘাস রহিয়াছে। হামি ইটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ খরি।’‘কেমন আছো তুমি?’‘প্রশ্নটা ভোকার মতো খরিলে।’‘মানে?’ থতমত খেয়ে যাই আমি।‘বালোতো আছিই। অন্য কিছু বলো। হামি তুমার মুখ থেকে অন্য খথা শুনিবার জন্যে হাসিয়াছি।’‘কি কথা?’ সহজে বললেও সমস্ত শরীর আমার শিহরিত হয়ে ওঠে। কি বলবো আমি মার্টিনা স্মিথ কে? থরথর করে কাঁপতে থাকি।‘আমার অবস্থা দেখে বলল, ‘থুমি কি বালবাস?’আমি আবারো বোকার মত প্রশ্ন করি, ‘কাকে?’‘কেন, হামাকে?’‘তা কি সম্ভব?’‘খেনো?’ উৎকণ্ঠায় ভরা প্রশ্ন মার্টিনা স্মিথের মুখ। আমি বুঝতে পারি তার চেহারায় এক নিমেষে আঁধার নেমে আসে।‘তুমি খ্রিষ্টান আর আমি মুসলমান। তোমার আমার ব্যবধান অনেক।’‘দুই ধর্ম থাতে কি? থোমার ধর্ম থোমার আর হামার ধর্ম হামার।’‘তা হয় না। আর তোমার বাবা-মা তা মেনে নেবেই বা কেন?’‘ওঠা নিয়ে তুমার চিন্তা করিতে হইবে না। হামার ওপর ছাড়িয়া দাও। শুধু বলো হামাকে বালবাস কি না?’আমি যেন এমন একটা মুহূর্তের জন্যে অপেক্ষায় ছিলাম জনম জনম। বললাম, ‘সব কথা কি মুখে বলতে হয়?’‘হামি থোমার মুখ থেকে শুনিথে চাই।’‘তোমাকে ভাল না বাসার কোন কারণ আছে বলেতো আমার মনে হয় না।’‘থুমি বাঙালি। থুমার মুখের খথার দাম অনেক বেশি। হামি থুমার মুখ থেকে শুনিথে চাই হামাকে বালবাস কি না।’‘তোমাকেই ভালবাসি মার্টিনা স্মিথ।’‘থ্যাংকউ। যেদিন হামি ভাংলাদেশকে চিনিতে শিখিয়াছিলাম সেদিন থেকে ভাবিয়া আসিয়াছি হ্যাকজন বাঙালিই হইবে হামার জীবন সাথী।’‘আমাকেই কেন তুমি পছন্দ করলে?’‘বাললাগা-বালবাসা কখন খীভাবে হইয়া যায় কেইবা ভলিতে ফারে?’মার্টিনা স্মিথ ক্ষণেক থেমে বলল, ‘তুমি কি ভাবিয়াছিলে হামার সাথে তুমার ফরিচয় হইবে?’‘কখনও না- কোনদিনও না। তবে কপালে ছিল এটাতো ঠিক।’কপালে ছিল কথাটার অর্থ মার্টিনা স্মিথ বুঝতে না পেরে বলল, ‘কিসের খপালে ছিল?’আমাদের ইসলাম ধর্মে কপালকে মানা হয়। আমাদের বিশ্বাস জীবনে যা কিছু ঘটে তার সবই এই কপালে লেখা থাকে আগে থেকে।’‘হামাদের খ্রিষ্টান ধর্মে হবশ্য কর্মকে ফ্রাধান্য দেওয়া হয়। হিসাব খরিলে পরোক্ষভাবে সেই খপালই চলিয়া আসে।’‘কি খাবে?’‘এমন ঘাসের ওপড় চীনা ভাদামের বিকল্প নাই।’পাশ দিয়ে বাদাম বিক্রেতাকে যেতে দেখে তার কাছ থেকে পাঁচ টাকার বাদাম নিয়ে দু’জনের মাঝে রাখি। এতক্ষণ যে বিষয়টা আমার একদম খেয়াল হয়নি সেটা হঠাৎ করে মনে হলো- আমরা দু’জনে কেমন সাবলীল ভাষায় তুমি-আমি করে যাচ্ছি! অথচ কারো মাঝে কোন আড়ষ্টতা নেই! কেমন করে হলো এমন। কে আগে আপনি থেকে তুমিতে নামলো তা মনে করার
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct