বলিউড এবং ভারতীয় সরকারের মধ্যে সম্পর্ক পারস্পরিক পিঠ চুলকানোর। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ইস্যুতে পুরো বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এমন সিনেমা প্রকাশ একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনই ঘরানার ছবি দ্য কাশ্মীর ফাইলস (২০২২), দ্য কেরালা স্টোরি (২০২৩) এবং সেভেন্টি টু হুরেইন (এ বছরের শেষার্ধে মুক্তি পাওয়ার কথা)। এটা পরিষ্কার, এই সিনেমাগুলো ২০২৪ সালে সংসদীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রচারের জন্যই তৈরি। প্রোপাগান্ডা এই ফিল্মগুলো এভাবে ভারতীয় ভোটারদের, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের কায়েমি রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে টানছে। লিখেছেন বাসিত পারায় ও নুজহাত খান।
বলিউড এবং ভারতীয় সরকারের মধ্যে সম্পর্ক পারস্পরিক পিঠ চুলকানোর। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ইস্যুতে পুরো বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এমন সিনেমা প্রকাশ একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনই ঘরানার ছবি দ্য কাশ্মীর ফাইলস (২০২২), দ্য কেরালা স্টোরি (২০২৩) এবং সেভেন্টি টু হুরেইন (এ বছরের শেষার্ধে মুক্তি পাওয়ার কথা)। এটা পরিষ্কার, এই সিনেমাগুলো ২০২৪ সালে সংসদীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী প্রচারের জন্যই তৈরি। প্রোপাগান্ডা এই ফিল্মগুলো এভাবে ভারতীয় ভোটারদের, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের কায়েমি রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে টানছে।দিল্লির আম্বেদকার ইউনিভার্সিটির সিনেমা ও সাহিত্যবিষয়ক সহকারী অধ্যাপক সায়ন দেব চৌধুরী বলেন, প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন নতুন ভোটাররা যুক্ত হন। এ ধরনের সিনেমা তাঁদের মধ্যে নতুন মতাদর্শের জন্ম দেয়। তিনি আরও বলেন, ‘এই সিনেমাগুলোই তরুণ প্রজন্মকে বলেছে গুজরাটে কখনো দাঙ্গা হয়নি। কমপক্ষে, গুজরাটের অপরাধকে ধুয়েমুছে দিতে নতুন সিনেমা আসতে পারে। সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে মানুষ যত বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, কোনো ঘটনায় কল্পিত একটি ভাষ্য নির্মাণ করা তত সহজ হয়। আমার মনে হয়, ঠিক এই জায়গাটায় প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্রগুলো তাদের ভূমিকা রাখছে।’সায়ন দেব চৌধুরীর ভাষায়, সিনেমা একটা পুরো পৃথিবী কিংবা পুরো ইতিহাস মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে। এই মিথ্যা ভাষ্য ভার্চ্যুয়াল জগতে মানুষকে প্রভাবিত করে। আর বাস্তব জগতে তাঁরা এর প্রকাশ ঘটান গন্ডগোল করে, গুজব ছড়িয়ে কিংবা দাঙ্গা বাঁধিয়ে।
লেখক ও সিনেমাবিষয়ক ইতিহাসবিদ অজয় ব্রাহমাতামাজ দ্য হিন্দুকে বলেন, স্বাধীনতার পর একটা দীর্ঘ সময় ভারতীয় সিনেমায় বামপন্থী ভাবাদর্শের প্রভাব ছিল। বিজেপি এবং আরএসএস এই সফট পাওয়ার তাদের কাজে লাগাচ্ছে কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই। ২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তারা তাদের নায়কদের ঘিরে সিনেমা বানাচ্ছে। প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্রের বাড়াবাড়ি ইদানীংকার ঘটনা। ২০১৯-এর এপ্রিলে ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে দ্য তাসখন্দ ফাইলস মুক্তি পায়। ওই সিনেমায় অভিযোগ করা হয়, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর জন্য প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস দায়ী। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় ওই চলচ্চিত্রটি মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। একই সময়ে নরেন্দ্র মোদির বায়োপিক মুক্তির প্রস্তুতি ছিল। বিবেক ওবেরয় সিনেমাটিতে মোদি চরিত্রে অভিনয় করেন। তবে নির্বাচন কমিশন সিনেমাটির মুক্তি পিছিয়ে দেয়। কংগ্রেস এ নিয়ে আদালতে গেলেও, শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায়। অভিযোগ ওঠে সিনেমাটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে প্রচারের কাজ করবে। সিনেমায় বিরোধী দলের নানা দুর্বলতা, বিশেষ করে গান্ধী পরিবারের প্রতি সিং এর আনুগত্য দেখানো হয়। প্রশ্ন ওঠে নির্বাচনের সময় এ ধরনের ছবি মুক্তির চেষ্টা আসলে কাকতালীয় কি না। কাশ্মীর ফাইলস এর সফলতা থেকে ২০২৪-এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ড. হেজওয়ার নামে একটি সিনেমা মুক্তির কথা রয়েছে। এই সিনেমা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেজওয়ারের বায়োপিক। এ ছাড়া তালিকায় আছে হিন্দুত্বদের পূজনীয় দীনদয়াল উপাধ্যায়কে নিয়েও বায়োপিক ম্যায় দীনদয়াল হুঁ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের পুরোধা পুরুষ ভি ডি সাভারকারকে নিয়ে স্বতন্ত্র ভির সাভারকার। ক্ষমতাসীন সরকার হিন্দু জাতীয়তাবাদনির্ভর যেসব সিনেমার প্রসারে কাজ করেছে, তার কয়েকটি মাত্র উদাহরণ এগুলো। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বলিউডের একটি প্রতিনিধি দল। ছবি: এএফপি গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যতম একটি প্রকল্প ভাগবা ধাজ। খুবই ব্যয়বহুল এই সিনেমা ঐতিহাসিক এবং আরএসএসের জন্ম নিয়ে তৈরি। আরএসএস একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
স্ক্রিপ্টরাইটার এবং সম্পাদক অপূর্ব আসরানি এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রোপাগান্ডা ফিল্মের ছড়াছড়ি দেখে আমি হতবিহ্বল। আমি আমার ২৩ বছরের পেশাগত জীবনে কখনো এত ধূর্ততার সঙ্গে সিনেমাকে ব্যবহার করে ভোটকে প্রভাবিত করতে দেখিনি। একদিকে যেমন আমি বিশ্বাস করি যে সেন্সরশিপ ও নিষেধাজ্ঞা অগণতান্ত্রিক, একই সঙ্গে আমি আশা করি কোনো কোনো প্রকৃত মেধাবী প্রোপাগান্ডা কারখানায় তাঁদের আত্মা বিক্রি করে দেননি।’৫৩তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জুরিবোর্ডের প্রধান হিসেবে গত নভেম্বরে ইসরায়েলি চলচ্চিত্র নির্মাতা নাদাভ লাপিদ ভারতে এসেছিলেন। তিনি বিবেক অগ্নিহোত্রীর কাশ্মীর ফাইলস ছবিটিকে নোংরা এবং প্রোপাগান্ডা সিনেমা বলে মন্তব্য করেন। পরে বিবেক অগ্নিহোত্রী টুইট করেন, ‘সত্য হলো সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়। এটা মানুষকে মিথ্যা বলায়।’ মন্তব্যের জন্য সমালোচনার শিকার হলেও সিনেমাটি সম্পর্কে লাপিদ তাঁর মন্তব্য থেকে সরে আসেননি। ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, খারাপ সিনেমা বানানো অপরাধ নয়। কিন্তু এটা একটা অত্যন্ত স্থূল, চাতুর্যপূর্ণ এবং হিংসাত্মক প্রোপাগান্ডা সিনেমা। জুরিবোর্ডের অপর তিন সদস্য লাপিদকে সমর্থন দেন। কেবল সুদীপ্ত সেন ভিন্নমত পোষণ করেন। এই সুদীপ্ত দ্য কেরালা স্টোরির নির্মাতা। বিজেপি সরকার এই সিনেমাকে সমর্থন জোগায়। সিনেমার কলাকুশলীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘কাশ্মীর ফাইলস সত্যের সাহসী প্রকাশ। সমাজ ও দেশকে এই সিনেমা এই দিকনির্দেশনা দিচ্ছে যে এ ধরনের ঐতিহাসিক ভুল যেন আর না হয়। সিনেমাটি নির্মাণে জড়িত পুরো দলকে আমি অভিনন্দন জানাই।’ অমিত শাহর এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয় সংসদীয় দলের সভায় মোদি দ্য কাশ্মীর ফাইলস-এর ভূয়সী প্রশংসা করার এক দিন পর। তিনি ওই দিন ইতিহাস উপস্থাপনে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভূমিকার কথা বলেন। দেড় শ মিলিয়ন রুপি বাজেটের এই সিনেমা করোনা-পরবর্তী প্রথম ছবি, যা আড়াই বিলিয়ন রুপির ব্যবসা করেছে। সিনেমা মানুষের বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক যে মানদণ্ড আছে, তাতে প্রভাব রাখতে পারে। গণমাধ্যমের অন্যান্য ধরনের তুলনায় সিনেমার জনমত গঠন ও ভাবাদর্শ প্রচারের ক্ষমতা বেশি। ফলে রাজনৈতিক সিনেমা, বায়োপিকের এমন বাড়বাড়ন্ত। সিনেমা মুক্তির সময় নিয়েও প্রশ্ন ওঠে যে রাজনীতিকেরা বলিউড এবং ভারতীয় সিনেমাকে আগামী নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহার করছে।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct