তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিআইএম বা আইএসএফ-এ নতুন নেতৃত্ব এসেছে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলকে তাঁরা কতটুকু এগিয়ে নিতে পারেন, সেটা দেখার বিষয়। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ও তার প্রধান সুকান্ত মজুমদারের চাপ কিছু কম নয়। গোড়াতেই বলা হয়েছে, বিজেপির সবচেয়ে সফল সভাপতি দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে তাঁকে সভাপতি করা হয়েছে। সুতরাং ফল ভালো না হলে তাঁকে প্রথমে বিপদে পড়তে হবে দলের ভেতরে। লোকসভা নির্বাচনের আগেই তাঁকে সরানোর দাবি উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বেশ ভালো ফল করেছে। তারা পেয়েছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট এবং ৭৭ আসন। এত ভালো ফল তারা অতীতে করেনি। এরপরেই তাদের পতন শুরু হয়। দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপনির্বাচনে তারা তৃণমূলের পরে দ্বিতীয় স্থানটি ধরে রাখতে পারেনি। যেমন মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি বা দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে যথাক্রমে কংগ্রেস ও সিপিআইএম। বিজেপি তৃতীয় স্থানে। সুকান্ত মজুমদার ও বিজেপির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দলের নেতা-কর্মীদের আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝানো, তাঁরা তৃণমূলকে হারানোর জায়গায় না পৌঁছালেও অন্তত বাম-কংগ্রেস জোটের চেয়ে এখনো এগিয়ে রয়েছেন। ‘রানার্সআপ’ জায়গাটি ধরে রাখতে তাঁরা এখনো সক্ষম। বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, বিজেপির ভোট কমলেও দ্বিতীয় স্থানটি তাঁরা ধরে রাখতে পারবেন। দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখলেও ভোটের হার কমে গেলেও চাপের মুখে পড়বেন সুকান্ত মজুমদার এবং বিধানসভায় বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে তাঁদের প্রচারের ভিত গড়ে তুলেছেন। দুর্নীতিকে সামনে এনে তাঁরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যেমন সিবিআই (কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো), ইডিসহ (এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট) নানা সংস্থা দিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপরে চাপ সৃষ্টি করলে ফল ভালো হবে। তাদের ইচ্ছায় ইডি-সিবিআই রাজ্যে এসেছে এবং তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকটি আদেশ বিজেপির পক্ষে গেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানো হচ্ছে। রাজ্যপালও তাঁদের কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা করে দিয়েছেন। এরপরও গত বিধানসভা নির্বাচনের চেয়ে এবার বিজেপি বেশি ভোট এবং বেশি আসন না পায়, তবে তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে নেতা-কর্মীদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে।
বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোটের চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন বিশাল প্রক্রিয়া। একেবারে নিচে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে, পঞ্চায়েত সমিতি হয়ে জেলা পরিষদ পর্যন্ত তিনটি স্তরে প্রায় ৭৪ হাজার আসনে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ভোট হবে। ফলে কোনো দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে দিল্লি বা কলকাতায় বসে বোঝা সম্ভব নয়, প্রত্যন্ত গ্রামে কে, কার সঙ্গে জোট বাঁধছে। কিছু ক্ষেত্রে বাম-কংগ্রেসের প্রার্থীরা বিজেপি বা সংখ্যালঘু পার্টি আইএসএফের সঙ্গে জোট বেঁধেও নির্বাচনে লড়ছে। অবশ্য এমন আসন খুব বেশি নয়। বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধেই লড়ছে অধিকাংশ আসনে। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল, বামফ্রন্টের ভোট দ্রুত চলে যাচ্ছে বিজেপিতে। কিন্তু ২০২১ সালের নির্বাচনের পরে আবার দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণপন্থীদের ভোট ফিরছে বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের জোটে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কংগ্রেসের পক্ষে আরও একটা ভালো খবর কর্ণাটক রাজ্যের জয়। কর্ণাটকে নির্বাচনী প্রচারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বলে আসছে, ‘মুসলমানেরা আমার ভাই’। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কোনো রাজ্যে বা কেন্দ্রে এতটা জোর দিয়ে কংগ্রেস বা অন্য বিরোধী দলের নেতৃত্বকে এমন কথা বলতে শোনা যায়নি। সেখানে জেতার পরে কংগ্রেস এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা সংখ্যালঘুদের খুশি করেছে। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের কিছুটা উত্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজে (যা জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) কংগ্রেস সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দলটির মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। এ কারণে মুসলমান-অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদের উপনির্বাচনে জিতেছে কংগ্রেস। মনে করা হচ্ছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে সামান্য হলেও কংগ্রেসের উন্নতি হবে। তবে শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে পেছনে ফেলে তাদের দ্বিতীয় স্থানে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
আইএসএফের ভূমিকা
অবিভক্ত বাংলার ঢাকায় ১৯১২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ গঠনের (১৯১২) পরে পশ্চিমবঙ্গে বড় আকারে সংখ্যালঘু সমাজের কোনো দল উঠে আসেনি। অথচ পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান। এমন মুসলমান যেসব রাজ্যে রয়েছে (কেরালা বা আসাম), সেখানে সংখ্যালঘু সমাজের শক্তিশালী দল আছে। হিন্দুত্ববাদী দলের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যতে মুসলমানপ্রধান দলের উত্থান হবে পশ্চিমবঙ্গে। নওশাদ সিদ্দিকীর দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ আইএসএফকে মুসলমানদের প্রধান দল হিসেবে গড়ে তোলা। এতে অবশ্য বিপদে পড়বে তৃণমূল, লাভ হবে বিজেপির। পঞ্চায়েত নির্বাচনে মুসলিম ভোটের ক্ষুদ্র বিভাজন ভবিষ্যতে তৃণমূলকে বড় বিপদে ফেলতে পারে। আইএসএফ অভিযোগ করেছে, তাদের নেতা-কর্মীদের ‘আক্রমণ ও হত্যা’ করা হচ্ছে এবং মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজ্যের ২৩টি জেলার মধ্যে ১০টিতে এক হাজারের বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছে আইএসএফ। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ তৃণমূল থেকে মুখ ঘুরিয়ে আইএসএফ বা বাম-কংগ্রেসের জোটকে সমর্থন দেয় কি না, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct