তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিআইএম বা আইএসএফ-এ নতুন নেতৃত্ব এসেছে। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলকে তাঁরা কতটুকু এগিয়ে নিতে পারেন, সেটা দেখার বিষয়। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন মাথায় রেখে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসকে নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হচ্ছে। এক নতুন দল আর দলটির সভাপতি বছর ত্রিশের নওশাদ সিদ্দিকী তাদের চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তৃণমূলকে এই দলের পেছনে অনেকটা সময়ই দিতে হচ্ছে। কারণ, এই দলের নেতা সিদ্দিকীর রাজনৈতিক জনসভায় ব্যাপক ভিড় হচ্ছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে যখন সিদ্দিকীর দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) গঠিত হয়, ভিড় হয়তো তখনো হয়েছিল। তবে তখন মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বড়সড় ধাক্কা খাননি তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ধাক্কা অবশ্য মমতা খেলেন গত মার্চের গোড়ায়। সে সময় মুসলিম–অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি আসনে কংগ্রেসের এক মুসলিম প্রার্থীর কাছে তৃণমূল হারল। তখন থেকে একটা ধারণা তৈরি হতে শুরু করল, রাজ্যে মুসলমান ভোট তৃণমূল কংগ্রেস থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে চলে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন। ৮ জুলাই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফল ঘোষণা করা হবে ১১ জুলাই।
নতুন সেনাপতি
এই নির্বাচন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গের চারটি প্রধান রাজনৈতিক দল তাদের নতুন সেনাপতি নিয়োগ করেছে। মাত্র ১৪ মাসের ব্যবধানে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচটি প্রধান দলের মধ্যে চারটি দলের দায়িত্ব নতুন নেতৃত্বের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দুই বছর আগে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে প্রভাবশালী বাঙালি সুফি পরিবারের নেতৃত্বাধীন দল আইএসএফের সভাপতি করা হয় ওই পরিবারের সদস্য নওশাদ সিদ্দিকীকে। বিধানসভা নির্বাচনের পরপরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাতিজা এবং সংসদ সদস্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদোন্নতি ঘটে। দলের যুব সভাপতি থেকে জাতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। দলের প্রধান না হলেও এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। একইভাবে বিজেপির মধ্য বাংলার সংসদ সদস্য সুকান্ত মজুমদারকে দলের রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ১৯৮০ সালে দল গঠনের পরে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছিল ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। এই সাফল্য যাঁর নেতৃত্বে আসে, সেই দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে নেতৃত্বে আনা হয় সুকান্তকে। এ নিয়ে বিজেপির ভেতরের ক্ষোভ তখন অনেকটা প্রকাশ্যে চলে আসে। এই পরিবর্তনের পরে ছয় মাসের মধ্যে প্রধান বামপন্থী দলেও বড়সড় পরিবর্তন আসে। সিপিআইএম (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) তাদের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের জায়গায় নিয়ে আসে মহম্মদ সেলিমকে।১৯৬৪ সালে সিপিআই (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া) ভেঙে সিপিআইএম গঠনের পর প্রথম কোনো মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে দলের সম্পাদক হলেন। বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতরেও কম বিতর্ক হয়নি। সারা দেশে যখন হিন্দুত্ববাদের হাওয়া, তখন একজন সংখ্যালঘুকে দলের শীর্ষ পদে বসানো কতটা যৌক্তিক হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। চার নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত মজুমদার, মহম্মদ সেলিম এবং নওশাদ সিদ্দিকী—নিজ নিজ দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম কোনো বড় নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন। তাঁদের ‘পারফরম্যান্স’ কেমন হয়, সেদিকে তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তো বটেই, দলীয় নেতা-কর্মীসহ গোটা রাজ্যও তাকিয়ে থাকবে।
অভিষেকের চাপ বেশি
চার নেতার মধ্যে তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে দুটি কারণ বলা যেতে পারে। এক. ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম একটা বড় নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালকের আসন অভিষেককে ছেড়ে দিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে তাঁর জন্য বড় চাপ। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ‘সাকসেশন ওয়ার’ (স্থলাভিষেকের লড়াই) খুব বড় একটা বিষয়। বর্তমান প্রধানের পরে দলের দায়িত্ব কে নেবেন—পার্টির সবচেয়ে দক্ষ সেনাপতি নাকি পরিবারের কেউ, এটা নিয়ে লড়াই রাজনীতিতে লড়াই অহরহ দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দলের প্রধান রাজদণ্ডটি তুলে দেন পুত্র, কন্যা বা স্ত্রীর হাতে। বঞ্চিত করা হয় যোগ্য নেতাকে। তৃণমূলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কংগ্রেসের অভিজ্ঞ সব রাজনীতিবিদ, যাঁরা রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসে কাটিয়েছেন, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিন তাঁদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। এতে অনেকেই সন্তুষ্ট নন। ক্ষোভে-অভিমানে কয়েকজন দল ছেড়ে গেছেন, বাকিরা বাধ্য হয়ে থেকে গেছেন। নতুন রাজনৈতিক সহচরদের নিয়ে নতুন করে দল সাজিয়েছেন অভিষেক। পঞ্চায়েত নির্বাচন তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা।মমতাহীন এই পরীক্ষা যদি অভিষেকের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ হয়, তবে দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ দলের নিচু স্তরের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা। তাঁরা একেবারেই সাধারণ মানুষ, কিন্তু দলের জন্য অপরিহার্য। তাঁরা সাধারণভাবে আদর্শহীন (অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের সে অর্থে কোনো আদর্শ নেই), আবার অপরিহার্য। তাঁদের ছাড়া দল চলবে না। তাঁরা নির্বাচনের সময় দ্বারে দ্বারে গিয়ে প্রচার চালাবেন, যেখানে বোমা ফেলার সেখানে বোমা ফেলবেন, প্রয়োজনে বুথ দখল করবেন, দলকে জেতাবেন। তাঁরা একই সঙ্গে দলের সম্পদ ও বিপদ। এই বিপদ কত বড় আকার ধারণ করতে পারে, সে সম্পর্কে অভিষেক ভালোই জানেন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ আসনে এই কর্মীরা বিরোধীদের প্রার্থী দিতে দেননি। এরপরই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি আসন হারায়, যা তাদের জন্য বড় ধাক্কা। বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে অরাজকতা সৃষ্টির ফলেই তৃণমূল লোকসভায় (২০১৯) হেরেছে। অতএব অভিষেককে একদিকে নির্বাচন জিততে হবে এবং অন্যদিকে এই দলীয় ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাজটা সহজ নয়, বিশেষত ১২ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূলের প্রতি একধরনের জন-অসন্তোষ রয়েছে। অভিষেকের জন্য অবশ্য কিছু সুখবরও আছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় বলা হয়েছে, তৃণমূল তাদের প্রতিপক্ষের থেকে অনেকটা এগিয়ে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এ ধরনের সমীক্ষা অতীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
সৌ: প্র: আ:
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct