যুক্তরাষ্ট্র সফরে বিরল সম্মান পেলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নয়াদিল্লির সঙ্গে আরও জোরালো সম্পর্কের আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু ভারতের দুর্বল গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে কিছু বললেন না। প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট–এ লিখেছেন টলিউস ওলোরুনিপা।
ভারত ও চীনের মধ্যে তুলনাও এখানে উঠে আসে। কারণ, সম্প্রতি বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে এর আগে অনানুষ্ঠানিক একটি মন্তব্য করেছিলেন।ক্যালিফোর্নিয়ায় এক নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে বাইডেন গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের সন্দেহজনক বেলুন ধ্বংসের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, সি এই বিষয় নিয়ে খোদ তাঁর সরকারকে অন্ধকারে রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটিই হচ্ছে স্বৈরশাসকদের জন্য বড় ধরনের এক বিব্রতকর মুহূর্ত—যখন তাঁরা জানেন না আসলে কী ঘটেছে। ’এভাবে তাদের নেতাকে তুলে ধরায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চীন। তারা বলেছে, ‘এটা চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য। ’ এরপরও হোয়াইট হাউস এই বক্তব্য থেকে সরে আসেনি। কংগ্রেসে পাঁচজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন রয়েছেন। এ ছাড়া রয়েছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। নাটকীয়ভাবে সেই কথা তুলে ধরে মোদি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষ রয়েছে, যাঁদের শিকড় প্রোথিত ভারতে। তাঁদের মধ্যে সম্ভবত কয়েকজন আজ এই চেম্বারে রয়েছেন। আর একজন রয়েছেন আমার পেছনে। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা বাড়বে। ’অন্যদিকে বাইডেন সাংবাদিকদের বলেছেন, মোদির সঙ্গে একান্তে বৈঠকে তিনি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, দুই দেশই এসব বিষয়ে ‘চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলা করছে।
মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ আমলে আসেনি
মানবাধিকার গ্রুপ, কংগ্রেস সদস্য ও অন্যদের উদ্বেগ সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি বাইডেন। এঁরা সবাই মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে তাঁর শক্ত অবস্থান দেখতে চেয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী ও ঘৃণা ছড়ানোসংক্রান্ত আইনে অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, শান্তিকামী প্রতিবাদী ও অন্যান্য সমালোচকের বিচার করছে’। সংস্থাটি বলছে, মোদি সরকার ‘এমন সব আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে মুসলমানদের পক্ষে বৈষম্যমূলক’। মানবাধিকারকর্মীরা আরও বলছেন, ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে ধর্মান্ধতার বিস্তার হয়েছে, বাক্স্বাধীনতায় আক্রমণ হয়েছে। তাঁরা বলছেন, একধরনের দায়মুক্তি এসব কর্মকাণ্ডে হিন্দুত্ববাদীদের উৎসাহিত করেছে। তাঁরা বলছেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও তাদের প্রতিবেদন ও বিবৃতিতে এসব বিষয় উল্লেখ করেছে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। তবে মোদি ভারতে ব্যাপক হারে গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তিনি বিস্মিত যে তাঁর দেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের কথা বলে সমালোচকেরা এসব কথা বলছে। ভারত প্রমাণ করেছে, সেখানে গণতন্ত্রে জাতপাত–মত–ধর্মীয় বিশ্বাস–লিঙ্গনির্বিশেষে সবাই সমান। মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসার আগে কংগ্রেসের ৭০ জনের বেশি সদস্য এক চিঠিতে বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি যেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, ইন্টারনেট বন্ধ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ এবং অন্যান্য ‘অস্বস্তিকর লক্ষণ’ নিয়ে কথা বলেন। কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য যৌথ অধিবেশনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা বর্জন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ইলহান ওমর ও রাশিদা তালিব (ডেমোক্র্যাট)। তাঁরা দুজনই মুসলমান।
সংবাদ সম্মেলনে সীমিত প্রশ্ন
গত বৃহস্পতিবার ক্যাপিটলের কাছে মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রতিবাদে ছোট আকারে বিক্ষোভ হয়। প্রতিবাদকারীরা ব্যানার–ফেস্টুন বহন করেন, যাতে ধর্মীয় স্বাধীনতার আহ্বান–সংবলিত লেখা ছিল। ছিল ‘খুনি মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন’ লেখা প্ল্যাকার্ড। ফিলাডেলফিয়া থেকে আসা বিক্ষোভকারী শিনা সুদ (৩৮) বলেন, ‘তিনি (মোদি) ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছেন। আমি এখানে এসেছি, কারণ যেখানেই কর্তৃত্ববাদী নেতা আছেন, সেখানে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দাবি করলেও তাঁর রয়েছে ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডা। ’ ইউএস ইনস্টিটিউট অব পিসের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা ড্যানিয়েল মারকি বলেন, ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যক্তিগতভাবে মোদিকে প্রশংসাবানে ভাসিয়ে দেওয়ায় তিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কড়া সমালোচনা করেন। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিদেশি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সব সময় মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন। মোদির এই সফরও ভিন্ন কিছু নয়। একই সময়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নীতির গুরুত্ব নিয়ে মোদিকে উপদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যবোধের সীমাবদ্ধতা আছে। সফর শুরুর আগে থেকেই যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মোদিকে রাজি করাতে মার্কিন কর্মকর্তারা ভারত সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেছিলেন। ভারতীয় এই নেতা বিগত বছরে এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে কখনো অংশ নেননি। মূলত গত বুধবার হোয়াইট হাউস ঘোষণা দেয়, মোদি ও বাইডেন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসছেন এবং তাঁরা সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেবেন। কিন্তু সেটাও ছিল খুবই সীমিত পরিসরে। মাত্র দুজন সাংবাদিককে প্রশ্ন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এঁদের একজন মার্কিন, অন্যজন ভারতীয়।
সৌ: প্র: আ:
টলিউস ওলোরুনিপা হোয়াইট হাউস ব্যুরোপ্রধান, ওয়াশিংটন পোস্ট
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct