ঘৃণিত ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ নয়, বিশ্বাসঘাতকতার মহড়া
এম ওয়াহেদুর রহমান
ভাগ্যাহত সিরাজউদ্দৌলা নানা আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি কুচক্রী মীর জাফর, রাজবল্লভ, রায়দুরলভ সহ প্রায় সকল অমাত্য বর্গের হিংস্র রাজনীতি, ইংরেজ বেনিয়াদের গোপন কূটকৌশল এমনকি আপন খালা ঘসেটি বেগম ও খালাতো ভাই শওকত জংয়ের হিংস্র তৎপরতায় তিনি ছিলেন দুশ্চিন্তাগ্ৰস্ত। মীর মদন, মোহনলালের মতো কিছু সেনাপতি ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার বন্ধু। তিনি মাত্র পনেরো মাস সিংহাসনে সমাসীন ছিলেন। ২৩ জুন পালিত হয় পলাশী ট্রাজেডি দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী মৌজার লক্ষবাগ নামক আম্রকাণনে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফর ও জগৎশেঠদের মতো কিছু ক্ষমতালিপ্সু স্বার্থাণ্বেষীর চরম বিশ্বাসঘাতকতায় এক যুদ্ধের নামে ‘ ষড়যন্ত্রমূলক ‘ যুদ্ধে পরাজয় বরণ করলে বাংলার তথা ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ আসলে ছিল প্রহসনের নামান্তর। পলাশী পরাধীনতার ইতিহাস, ষড়যন্ত্রের ইতিহাস সর্বোপরি ট্রাজেডি ও বেদনাময় শোকস্মৃতির ইতিহাস। বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীর জাফর ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তুচ্ছ নবাবীর লোভে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি। ষড়যন্ত্রের মূল হোতা জগৎশেঠ হলেও পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত বিশালাকার নবাব বাহিনী, সাকুল্যে সাড়ে তিন হাজার সৈন্যের কোম্পানি বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিল মূলত মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলা কেবলমাত্র ইংরেজদের দ্বারা নয়, নিজের লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার দরুন অধিকাংশ সৈন্য সেদিন নীরব দর্শকের মতো নবাবের পরাজয় দেখেছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিজের জীবন দিয়ে ও বাংলার স্বাধীনতা সেই দিন রক্ষা করতে পারে নি। উপনিবেশিক ইংরেজ শক্তির অর্থ - বিত্ত ও ক্ষমতার মোহে সেই দিন অন্ধ হয়ে বাংলার স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল বিশ্বাসঘাতকরা। ২৩ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের দিন শুধু নয়, ইতিহাসের বাঁক ঘোড়ানোর রক্তাক্ত উপখ্যান। একটি জাতির উত্থান পতনই শুধু নয়, বিশ্বের ইতিহাস পাল্টে দেয়া এক দুষ্টু ক্ষতের নাম। উপমহাদেশের ইতিহাসে বিয়োগান্তক এই ঘটনা শুধু এ জনপদেরই নয়, গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় এক সুদূর প্রসারী প্রভাব রেখে গেছে।
সুদীর্ঘ উপনিবেশিক শাসনের সূচনাকারী পলাশীর যুদ্ধ, যত না যুদ্ধ ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ষড়যন্ত্র। মাত্র এক ঘণ্টার মতান্তরে কয়েক ঘন্টার যুদ্ধ খেলায় নবাবের সেনাপতি ও সৈন্যরা পুতুলের মত দাঁড়িয়ে ছিল। বিপুল শক্তি থাকা সত্ত্বেও নিকটজনের ষড়যন্ত্রের কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন এবং পালাতে গিয়ে ভগবান গোলায় মীর জাফরের জামাতা মীর কাশিমের হাতে সপরিবারে গ্ৰেফতার হলে মীর জাফরের পুত্র মিরনের ইশারায় মোহাম্মদী বেগ কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিণত হন। নিকটজনদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রই পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। পলাশীর যুদ্ধোত্তর বাংলায় চালু হয়েছিল ‘ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা ‘। ফলস্বরূপ নবাব পেয়েছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর ইংরেজরা পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। নবাবের মসনদটি ছিল নিছকই আলঙ্কারিক। অর্থাৎ ‘ ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার ‘ এ পরিনত হয়েছিল নবাবেরা। ষড়যন্ত্র কারীরাও ষড়যন্ত্রের পুরস্কার স্বরুপ পেয়েছেন চরম অবমাননা। মীর জাফর সিংহাসন লাভ করলেও ইংরেজদের দ্বারা চরম ভাবে অপমানিত হন। মীর জাফর মৃত্যু বরন করেন দুরারোগ্য কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে। মোহাম্মদী বেগের মাথায় গোলমাল দেখা দিলে তিনি নিজেই কুপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঘসেটি বেগমকে বন্দি করে শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে মেরে ফেলা হয়। বুড়িগঙ্গা নদীতে বজ্রপাতের শিকার হয়ে মারা যান মিরন। জগৎশেঠ কেও গঙ্গাবক্ষে ডুবিয়ে মারা হয়। রায়দুরলভ ও ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। উমিচাঁদ হয়ে পথে পথে ঘুরে মৃত্যু বরন করেন। রর্বাট ক্লাইভ নিজের গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীদের ভাগ্য ও সুপ্রসন্ন ছিল না, তাঁরা প্রত্যেকেই নির্মম পরিনতির শিকার হন। মীর জাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠ, রর্বাট ক্লাইভের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের মৃত্যু হলে ও আজ ও তাঁদের প্রেতাত্মা এ জমিনের কিছু কিছু মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। পলাশীর দু:সহ ঘটনা আমাদের ইতিহাস, অস্তিত্ব আর বিশ্বাসের শক্তিশালী ভিত গুলিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পলাশী শুধু একটি মাঠের নাম নয়, আম গাছের সারি নয়, ভাগীরথী নদীর তীরের আম্রকাণনে দুই শক্তির লড়াইয়ের নাম নয়, এ হলো আপোষহীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতিগাঁথা এক ময়দান, বিশ্বাসঘাতকদের প্রহসনের ভূমি। পলাশী মানে স্বাধীনতা রক্ষায় একদল সাহসী বীর সেনানীদের করুন বাঁচার ফরিয়াদ আর অন্য দিকে অজস্র বিশ্বাসঘাতকদের পৈশাচিক অট্টহাসি। মীর জাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগমের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত পরিণতিতে ঘটে পলাশীর প্রান্তরে ইতিহাসের এক নিকষ কালো অধ্যায়ের, যা কখনই ক্ষমার যোগ্য নয়।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct