সৌদি আরবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের একটি অভূতপূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এর ফলাফল গোটা আরব বিশ্বের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। দেশটি ‘রূপকল্প ২০৩০’ শীর্ষক যে পরিকল্পনা করেছে, তার মূল লক্ষ্য হলো অর্থনীতিকে জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেওয়া। লিখেছেন রাবাহ আরেজকি এবং তারিক এম ইউসুফ।
সৌদি আরবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের একটি অভূতপূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এর ফলাফল গোটা আরব বিশ্বের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। দেশটি ‘রূপকল্প ২০৩০’ শীর্ষক যে পরিকল্পনা করেছে, তার মূল লক্ষ্য হলো অর্থনীতিকে জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেওয়া। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে, তা বাস্তবে রূপ দিতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে হবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ তা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সৌদি আরবের পক্ষে তেল নির্ভরতার এই চ্যালেঞ্জকে উতরে যাওয়া কঠিন। কারণ সৌদির বেশির ভাগ সম্পদের মূল উৎস তার পেট্রোলিয়ামের বিশাল মজুত (দেশটি বিশ্বের শীর্ষ অপরিশোধিত তেলের রপ্তানিকারক)। এ কারণে তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে যাওয়ার মধ্যে এই সম্পদগুলোর আটকে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব প্রথম কোনো তেলনির্ভর দেশ নয় যে কিনা হাইড্রোকার্বনের ব্যবহার থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। গত কয়েক দশক ধরে আরবের অন্য দেশগুলোও তাদের অর্থনীতিতে একই ধরনের বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছে, যদিও তারা এ ক্ষেত্রে খুব কমই সাফল্য পেয়েছে। তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হলো দুবাই। দুবাই তার অর্থনীতিকে তেল-নির্ভরতা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য নিজেকে সফলভাবে একটি লজিস্টিক সেন্টার, সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য এবং অফশোর ফাইন্যান্স হাব হিসেবে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। এর বাইরে আরবের কোথাও কোথাও শহর রাষ্ট্রের মডেল সফল হলেও তা তেমন একটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। এ কারণে এই অঞ্চল ও তার বাইরের নীতি নির্ধারকেরা প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ লোকের দেশ সৌদি আরবের উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কর্মসূচিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।দুবাইয়ের সাফল্য অর্জনের সঙ্গে সৌদির তৎপরতার তুলনা করা কঠিন। তবে সৌদি আরবের নেতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ছোটখাটো কিছু করতে চান না এবং সে কারণেই তিনি সৌদির আর্থসামাজিক রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে কাড়ি কাড়ি অর্থ ও সম্পদ ঢালছেন। সৌদিকে সবুজ জ্বালানি (হাইড্রোজেনসহ), খনি, লজিস্টিকস ও অবকাঠামো, খেলাধুলা, সংগীত, পর্যটন, ডিজিটাল পরিষেবা, অর্থ এবং উদ্যোক্তাদের একটি ক্ষমতাকেন্দ্রে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। সরকার নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়ে, নীতি পুলিশের ক্ষমতা সীমিত করে এবং বিদেশি শ্রমিক নিয়োগকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর বাড়তি ফি আরোপ করে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে মোহাম্মাদ বিন সালমান এটিও পরিষ্কার করেছেন যে, রাজনৈতিক সংস্কারের ধারণা আলোচনার টেবিলের বাইরে থাকবে। ২০১৮ সালে মোহাম্মাদ বিন সালমানের সমালোচক সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল এবং মোহাম্মাদ বিন সালমান সৌদির কার্যত প্রধান নির্বাহী হওয়ার পর থেকে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর হাতে দমন করে আসছে। অর্থাৎ তিনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উদারপন্থা অনুসরণ করলেও রাজনৈতিকভাবে কঠোর নীতির পথেই হাঁটছেন। তবে সৌদি আরবের উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্থনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষাকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। সৌদির রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত তেল কোম্জল সৌদি আরামকো ২০২২ সালে ১৬ হাজার ১ শ ১০ কোটি ডলারের রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করেছে এবং এই অর্থ রাষ্ট্রটির সার্বভৌম সম্পদ তহবিল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড-এর মাধ্যমে দেশে ও দেশের বাইরে বিনিয়োগ করা হয়েছে। দেশের ভেতরে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে, নগর উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে, জ্বালানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে এবং পর্যটনকে উজ্জীবিত করতে মেগা-প্রকল্পের একটি দীর্ঘ তালিকা করেছে সৌদি সরকার। সেখানে তেল বিক্রির এসব অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। লোহিত সাগরের উপকণ্ঠে নিওম নামের যে কার্বনমুক্ত নগর গড়ে তোলা হচ্ছে, সেটি এই প্রচেষ্টার সাহসিকতাকে দৃশ্যমান করছে।
সৌদি আরব তার ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করেছে যাকে অভ্যন্তরীণ আয়ের একটি নতুন উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি এমন একটি দেশ যেখানে নাগরিকেরা রাজপরিবারের শাসন মেনে নেওয়ার বিনিময়ে দীর্ঘ দিন ধরে থোক বরাদ্দের অর্থ ও ভর্তুকি পেয়েছেন। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সম্প্রতি সৌদির চুক্তি হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৭ জুলাই তেহরান সফর করেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান (বাঁয়ে)। তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান। ভ্যাট বাড়ানোর ফলাফল ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। যেখানে ঐতিহাসিকভাবে সরকারের বাজেট রাজস্বের প্রায় ৯০ শতাংশ জোগান দিত তেল বিক্রির অর্থ, সেখানে ২০২২ সালের বাজেটের রাজস্বের ৩২ শতাংশ জুগিয়েছে তেল বহির্ভূত আয়। সবচেয়ে বড় কথা, রূপকল্প ২০৩০ নিয়ে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বেশ উৎসাহ রয়েছে। এএসডিএ’এ বিসিডব্লিউ আরব যুব জরিপ ইঙ্গিত করে, তরুণ সৌদিরা এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে, সৌদি আরব সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব এমন একটি দেশ যেখানে সরকারের বিষয়ে দুর্নীতি ও অবিশ্বাস নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। সে কারণে সেখানে একটি সাধারণ নীতি অবলম্বন করে নাগরিকদের এক হওয়া অস্বাভাবিক। সৌদির এই রূপকল্প ২০৩০ সৌদি নাগরিকদের অনেকটাই এক জায়গায় এনেছে। তবে সৌদির এই রূপান্তরের পরীক্ষা নিরীক্ষা একেবারে ঝুঁকিমুক্ত নয়। যেহেতু ভূ-রাজনৈতিক হটস্পটে সৌদি আরবের অবস্থান, সেহেতু এই অবস্থাটি রূপান্তর প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। মোহাম্মাদ বিন সালমান বুঝতে পারছেন, সৌদি আরবকে সমৃদ্ধ হতে হলে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এ অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহ থাকলে তা সৌদির সামনে এগোনোর পথে বাধা সৃষ্টি করবে। ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের সাম্প্রতিক চুক্তি, সুদানে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার চেষ্টা এবং আরব লিগে সিরিয়াকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে সৌদি আরব এক দশক আগের অবস্থান থেকে একেবারে উল্টো অবস্থানে চলে এসেছে। এর মাধ্যমে মোহাম্মাদ বিন সালমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ধরা পড়ে। তিনি বুঝতে পারছেন, সৌদি আরবকে সমৃদ্ধ হতে হলে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এ অঞ্চলে যুদ্ধ বিগ্রহ থাকলে তা সৌদির সামনে এগোনোর পথে বাধা সৃষ্টি করবে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, মোহাম্মাদ বিন সালমান তাঁর লক্ষ্যে সফল হলে গোটা আরব ভূমি উন্নততর হয়ে উঠবে।
সৌ: প্র: আ:
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
রাবাহ আরেজকি ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ (সিএনআরএস) এর গবেষণা পরিচালক ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের একজন সিনিয়র ফেলো। তারিক এম. ইউসুফ মিডলইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ও একজন সিনিয়র ফেলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct