ইউক্রেন যুদ্ধে ব্রাজিলের কী যায় আসে? এই প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর হতে পারে, সম্ভবত তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের সংঘাতে শান্তি আনতে প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলাপ করেছেন। লিখেছেন বোর্হে হেইনি।
ইউক্রেন যুদ্ধে ব্রাজিলের কী যায় আসে? এই প্রশ্নের স্বাভাবিক উত্তর হতে পারে, সম্ভবত তেমন কিছু যায় আসে না। কিন্তু বাস্তবতা এখন ভিন্ন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের সংঘাতে শান্তি আনতে প্রচেষ্টা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে আলাপ করেছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। এই ‘চলমান কূটনীতি’র অংশ হিসাবে লুলা তাঁর প্রধান পররাষ্ট্র বিষয়ে উপদেষ্টা চেলসো আমোরিমকে মস্কোয় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি সেখানে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে ব্রাজিল সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইউক্রেনের সংঘাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে ব্রাজিলের এই কূটনৈতিক আলোচনার একটা কারণ হলো, ব্রাজিল এই সংঘাতে কোনো পক্ষ নেয়নি। এর মধ্য দিয়ে ব্রাজিল মূলত ‘সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতা’র অবস্থান গ্রহণ করেছে। সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বিশ্ব; অর্থাৎ আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো পরাশক্তির মধ্যকার সংঘাতে কোনো পক্ষ নিচ্ছে না। দক্ষিণ বিশ্ব খুব জোরালোভাবে নিজেদের স্বার্থের দিকটাতে মনোযোগ দিচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্ট–এর ভাষায় এটিকে বলা যায়, ‘পরাশক্তির বিভক্তিতে টিকে থাকা। ’এখনকার ‘জোট নিরপেক্ষ’ আন্দোলন আর কয়েক দশক আগে ঠান্ডা যুদ্ধকালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য রয়েছে। বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলো আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। এ দেশগুলোর মধ্যে থেকেই উদীয়মান শক্তিগুলোর জন্ম হচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বিবেচনায় ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে ব্রিকসের পাঁচ দেশ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) অগ্রসর অর্থনীতির জোট জি-৭-কে ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষমতার কারণে সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ দেশগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রভাব তৈরি করতে পারছে। এ দেশগুলো এখন যেভাবে নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে ও কূটনৈতিক জোট গঠন করছে, সেটা অতীতে অভাবনীয় ছিল। আমার বিবেচনায়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যে দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটাই সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সৃষ্টিতে রসদ জোগাচ্ছে। দক্ষিণ বিশ্বের অনেক দেশই ওয়াশিংটন ও বেইজিং দুই পক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রবাহ যাতে অব্যাহত থাকে, এ কারণে দুই পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ দেশগুলো সংঘাতের ক্ষেত্রে কোনো পক্ষ না নিলেও চুপ করে বসে থাকার অবস্থান নেয়নি। দেশগুলো সক্রিয়ভাবেই কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কথায় ধরা যাক। এ ক্ষেত্রে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলো রাশিয়া কিংবা ন্যাটো কোনো পক্ষকেই সমর্থন দিচ্ছে না। আবার ইউক্রেন যুদ্ধে দুই পক্ষের মধ্যে যাতে শান্তিচুক্তি হয়, সে জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ বিশ্বে ব্রাজিল প্রথম দেশ নয়। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ ন্যাটোর পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত এশিয়ার ন্যাটো হিসাবে পরিচিত কোয়াডের সদস্য হওয়ার পরও, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে নিন্দা জানাতে রাজি হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনার পরিমাণ বিপুল পরিমাণ বাড়িয়েছে।
ওয়াশিংটনে জো বাইডেনের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বৈঠকে ভারতের জোট নিরপেক্ষ অবস্থানটি সম্ভবত একটি আলোচ্য বিষয় হিসাবে থাকবে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের এই অবস্থান বিষয়টির প্রতিফলন ঘটাচ্ছে যে আজকের দিনে ভূরাজনীতির প্রধান বিভাজনবিন্দু গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র নয় (বাইডেন এই যুক্তি দিয়েছেন)। ভূরাজনীতির প্রকৃত বিভাজনবিন্দুটি রয়েছে উত্তর বিশ্ব ও দক্ষিণ বিশ্বের মধ্যে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, মেক্সিকো ও আর্জেন্টিনার মতো অত্যন্ত জনবহুল গণতান্ত্রিক দেশগুলোও ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে। এ দেশগুলোই আবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে নিন্দা জানিয়ে তোলা এক প্রস্তাবের পক্ষে নির্দ্বিধায় ভোট দিয়েছে। ১৪০টির বেশি দেশ অব্যাহতভাবে সেটা করে আসছে। পরাশক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র সাধু আর শয়তানের মধ্যে সংঘাত বলে চিত্রিত করেছে। তারা বলেছে, এ যুদ্ধ ভবিষ্যতের ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’কে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে যেমন করে ‘অনৈতিক বলত’, এবারও সেই একই কথা বলছে। রাশিয়া নতুন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনকে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার সুযোগ হিসাবে নিয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা চষে বেড়াচ্ছেন মস্কোর বিরুদ্ধে দেওয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে পশ্চাৎ-দেশ দেখাতে। এদিকে চীন তাদের মুদ্রা রেনমেনবির প্রভাব বাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে। বেইজিংয়ের যুক্তি হলো, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডলারকে যেভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে প্রধান বিনিময় মুদ্রা হিসাবে ডলার থাকার বিপদ রয়েছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় সক্রিয় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ মূলত আঞ্চলিক বহুপক্ষীয়বাদ ও সহযোগিতার ওপর নির্ভর করবে। এর দৃষ্টান্ত হতে পারে সম্প্রতি ব্রাসিলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া দক্ষিণ আমেরিকান কূটনৈতিক সম্মেলনটি। ১০ বছর পর অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে লুলা দা সিলভা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার ওপর জোর দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্রাজিলের কূটনৈতিক উদ্যোগ চালিয়ে নেওয়ার জন্য আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন।বোর্হে হেইনি, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেডরিক এন পারদি সেন্টার ফর স্টাডি অব দ্য রেঞ্জ ফিউচাররে অস্থায়ী পরিচালক
সৌ: প্র: আ:
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct