কয়েক দশক ধরে একটি রেওয়াজ চালু আছে। যখনই মার্কিন নীতিনির্ধারক স্তরের কোনো নেতা ভারত সফরে আসেন, তখনই তাঁরা ভারতের রাজনীতি, দেশটির বাসিন্দাদের বৈচিত্র্য ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশংসাসূচক কথা বলেন। এযাবৎ যত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ‘বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র’ এবং ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ এর মধ্যে মূল্যবোধগত ঐক্যের কথা বলেছেন। লিখেছেন ড্যানিয়েল মার্কি।
ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের অংশীদার হিসেবে মনে না করে বরং শুধু স্বার্থ অর্জনের সহযোগী শক্তি হিসেবে দেখতে হবে। ওয়াশিংটনের এই নীতি-পরিবর্তন সহজ হবে না; কারণ, যুগ যুগ ধরে ওয়াশিংটন গোলাপি চশমা পরে ভারতের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে হাল আমলের পরিস্থিতি উভয়কেই বুঝতে উৎসাহিত করবে যে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্যেই আটকে থাকবে। ইউক্রেন ইস্যুতে দিল্লির অবস্থান নিশ্চিতভাবেই গণতন্ত্রের মূল্যবোধের পরিপন্থী। এটি গণতন্ত্র ইস্যুতে ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। পরপর দুই দফা নির্বাচনে বড় জয়ের পর মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) উদারবাদের সঙ্গে ভারতের সংযুক্তিকে উত্তরোত্তর সন্দেহজনক করে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রীর আচরণে লাগাম টানতে পারে এমন সব প্রতিষ্ঠানকে বিজেপি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বেসামরিক আমলাতন্ত্রসহ সব প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকরণ করেছে। দলের প্রাধান্য ঠিক রাখার স্বার্থে পার্লামেন্টকে ‘রাবার স্ট্যাম্পে’ পরিণত করেছে। মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের দিক থেকে আসা সমালোচনাও মোদি সহ্য করতে পারেন না। ২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে বিবিসি চলতি বছর একটি তথ্যচিত্র সম্প্রচার করেছিল। সেটি মোদি সরকার ভারতে নিষিদ্ধ করে। ভি-ডেম (ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি) ইনস্টিটিউট, ফ্রিডম হাউস এবং ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট—এই তিনটি বিশ্বখ্যাত সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রের র্যাঙ্কিং নির্ধারণ করে থাকে। এই তিনটি সংস্থার হিসাবেই দেখা গেছে, মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে গণতন্ত্র সূচকে ভারতের অবস্থানের অবনমন হয়েছে। কর্তৃত্ববাদের দিকে ভারতের এই ঝোঁক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বহু সমস্যা তৈরি করছে। এর একটি হলো, দিল্লি ক্রমেই ওয়াশিংটনের কাছে কম বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠা। গণতান্ত্রিকভাবে দায়বদ্ধ নেতাদের তাঁদের নিজেদের নাগরিকদের কাছে বৈদেশিক নীতির ন্যায্যতা রক্ষা করতে হয়, যা তাঁদের সিদ্ধান্তগুলোকে অধিকতর স্বচ্ছ ও অনুমানযোগ্য করে তোলে। গত বছর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগত আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ‘অখণ্ড ভারত’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলেও ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যে প্রশ্ন উঠছে, হিন্দু সাংস্কৃতিক কনফেডারেশন বলতে কী বোঝায়। ভারত শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজেকে যেভাবে দাবি করে থাকে, তার সঙ্গে মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডের কোনো মিল আছে কি না, তা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ হিন্দু জাতীয়তাবাদ দেশের বাইরেও তাদের অনুদার লক্ষ্যকে উন্মোচিত করছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করেন, আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত আছে এমন প্রবাসী গ্রুপগুলোকে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটন ও অন্যান্য রাজধানীতে লবিং করে বিজেপির কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়াই হবে তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করেন, ভারতকে হিন্দু সভ্যতা সংস্কৃতির ভিত্তিতে আরও সম্প্রসারিত করা উচিত এবং তাঁদের অনেকেই এখন ‘অখণ্ড ভারত’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা থেকে তিব্বত পর্যন্ত এক করে দিল্লি একটি ‘সাংস্কৃতিক কনফেডারেশন’ গড়ে তুলতে চান। গত বছর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগত আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ‘অখণ্ড ভারত’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলেও ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যে প্রশ্ন উঠছে, হিন্দু সাংস্কৃতিক কনফেডারেশন বলতে কী বোঝায়। ভারত শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে নিজেকে যেভাবে দাবি করে থাকে, তার সঙ্গে মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডের কোনো মিল আছে কি না, তা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিজেপির এসব অনুদার তৎপরতার স্পষ্ট তথ্য–প্রমাণ থাকার পরও বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে মোদি সরকারের সমালোচনা এড়িয়ে চলছেন। শুধু তা–ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা এসব উদ্বেগকে পাশ কাটিয়ে ভারতের নীতির সাফাই গেয়েছেন। যেমন ২০২১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ভারতের গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, প্রতিটি গণতন্ত্রের ‘কাজ এগিয়ে নিতে’ কোনো না কোনো অসম্পূর্ণতা থাকে। সম্ভবত বাইডেন প্রশাসন মনে করছে, ভারতের নীতির সমালোচনা করলে তা দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং সে কারণেই ওয়াশিংটনের দিক থেকে কোনো সমালোচনা আসছে না। তবে নিজ দেশের রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য আবার বাইডেনের পক্ষে ভারতের গণতন্ত্রের প্রশংসা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রভাবশালী আইনপ্রণেতা ও ইভেনজেলিক্যাল খ্রিষ্টান গ্রুপ ভারতে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের নিগ্রহ, তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করা ও গণমাধ্যমের ওপর মোদি সরকারের চড়াও হওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ অন্যান্য মার্কিন সংবাদমাধ্যমে এসব নিয়ে বারবার খবর ছাপানো হয়েছে, যেগুলোতে বিজেপি নেতারা যথারীতি ‘ভারতবিরোধী’ তকমা সেঁটে দিয়েছেন। এরপরও চীনকে প্রতিহত করায় সহযোগী শক্তি হিসেবে ভারতকে চটাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। তবে শত্রুর শত্রু মিত্র—এই নীতি ধরে এগোলেও ওয়াশিংটনকে মোদির বিজেপিকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাওয়া বন্ধ করতেই হবে।
সৌ: প্র: আ:
ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত
লেখক, ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পলিসি প্ল্যানিং স্টাফের সদস্য ছিলেন। তিনি চায়নাস ওয়েস্টার্ন হোরাইজন: বেইজিং অ্যান্ড দ্য নিউ জিওপলিটিকস অব ইউরেশিয়া বইয়ের লেখক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct