আপনজন ডেস্ক: সুপ্রিম কোর্টে জোর ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার। গত সপ্তাহে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দায়ের করা বিশেষ অনুমতির আবেদন খারিজ করে বিচারপতি বি ভি নাগরত্না ও মনোজ মিশ্রের অবকাশকালীন বেঞ্চ বলেছে, যেহেতু কলকাতা হাইকোর্ট অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে, তাই তা মেনে চলতে কোনও আপত্তি থাকা উচিত নয়। কারণ, রাজ্য নির্বাচন কমিশন এক দিনে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করছে এবং তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বুথ স্থাপন করা হয়েছে। তাই হাইকোর্টের আদেশে কোনও হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীর দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমণ ও বিচারপতি উদয় কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ প্রথমে ১৩ জুন একটি আদেশ জারি করে কমিশনকে ‘সংবেদনশীল’ এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের জন্য অনুরোধ পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরপর ১৫ জুন এক আদেশে কমিশনকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যজুড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়। উভয় আদেশই সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল এবং সেই আর্জি খারিজ হয়ে যায়। বিচারপতি নাগারত্না মঙ্গলবার শুনানির সময় বলেন, নির্বাচন সহিংসতা সংঘটিত করে হতে পারে না। হাইকোর্ট এর আগেও সহিংসতার ঘটনা দেখেছে। নির্বাচনের সঙ্গে সহিংসতা হতে পারে না। বিচারপতি নাগারত্না শুনানির সময় প্রশ্ন তোলেন, যদি কোনও ব্যক্তি মনোনয়ন পত্র জমা দিতে না পারেন এবং জমা দেওয়ার সময় যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কোথায়? বিচারপতি আরও উল্লেখ করেন, পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে বাহিনী চেয়েছে যা “নিজের বাহিনীর অপর্যাপ্ততার স্বীকারোক্তি” এবং হাইকোর্টের আদেশে বাহিনী মোতায়েনের ব্যয়ের বোঝা কেন্দ্রের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্যের উপর নয়। আগামী ৮ জুলাই পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরের ৭৫ হাজারেরও বেশি আসনের জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, যার জন্য প্রায় ৬১,০০০ ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে এবং নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে। মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার সময় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে কমপক্ষে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং অনেকে আহত হয়েছেন। প্রায় সব প্রধান বিরোধী দলই রাজ্য পুলিশ বাহিনীর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে এবং সহিংসতার সময় ‘নিষ্ক্রিয়তা’ এবং রাজ্যের ক্ষমতাসীন দের পক্ষে ‘পক্ষপাতদুষ্টভাবে’ কাজ করার অভিযোগ করেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের পরাজয় আখ্যায়িত করে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, আবেদনকারী নম্বর ১ হিসাবে আমি এই রায়কে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। সুপ্রিম কোর্ট শুধু পঞ্চায়েত দখলের উত্তরাধিকার এবং পাঁচ বছর ধরে লুটপাটের সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপ করেছে।
অধিকারীর আইনজীবী হরিশ সালভে আদালতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে রাজ্য নির্বাচন কমিশন “পক্ষপাতদুষ্ট ভাবে” কাজ করছে। তিনি বলেন, রাজ্যের প্রকৃত কোনো অভিযোগ নেই। তারা বলতে লজ্জা পাচ্ছে যে তারা কেন্দ্রীয় বাহিনী চায় না, কারণ তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সৌগত রায় বলেন, এটা তৃণমূলের জন্য কোনো ধাক্কা বা বিব্রতকর কিছু নয়। আমরা ইতিমধ্যে আমাদের বৈঠকে এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছি। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে কোনও পার্থক্য হবে না এবং আমরা অপ্রতিরোধ্যভাবে জয়ী হব।তিনি আরো বলেন, এটা হতাশাজনক যে শীর্ষ আদালত এই ধরনের আদেশ দিয়েছে। কারণ আমরা মনে করি কেন্দ্রীয় বাহিনী স্থানীয় ভাষা এবং রীতিনীতি বুঝতে না পারার কারণে নির্বাচনী বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তুলবে। মনে রাখতে হবে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় কোচবিহারের শীতলকুচিতে চার জন গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছিল নিরাপত্তা বাহিনী। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ মেনে চলা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই, তবে এটি অবাধ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে না। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া কি ভুল পদক্ষেপ, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, রাজ্যকে চেষ্টা করতে হবে। আদালতকে বলতে হবে, স্থানীয় নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রয়োজন নেই এবং তারা কেবল আরও বিভ্রান্তি তৈরি করবে।সিপিআই (এম) এর রাজ্যসভার সদস্য এবং কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, শীর্ষ আদালতের এমন রায় অনিবার্য। তিনি বলেন, রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে আন্তরিক ছিল না এবং তাই তারা কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের প্রক্রিয়া বন্ধ করতে মরিয়া ছিল। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব যখন কমিশনের, তখন কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন বন্ধ করতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দাবি জানানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত। কারণ, এর পুরো খরচ কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে। বিজেপির জাতীয় সহ-সভাপতি তথা দলের লোকসভা সদস্য দিলীপ ঘোষ বলেন, রথযাত্রার শুভ দিনটি রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের জন্য অন্তর্জলি যাত্রার দিনে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি তথা প্রবীণ লোকসভা সদস্য অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে যে পুরো ঘটনায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কতটা পক্ষপাতদুষ্ট।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct