কয়েক দশক ধরে একটি রেওয়াজ চালু আছে। যখনই মার্কিন নীতিনির্ধারক স্তরের কোনো নেতা ভারত সফরে আসেন, তখনই তাঁরা ভারতের রাজনীতি, দেশটির বাসিন্দাদের বৈচিত্র্য ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশংসাসূচক কথা বলেন। এযাবৎ যত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ‘বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র’ এবং ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ এর মধ্যে মূল্যবোধগত ঐক্যের কথা বলেছেন। লিখেছেন ড্যানিয়েল মার্কি।
কয়েক দশক ধরে একটি রেওয়াজ চালু আছে। যখনই মার্কিন নীতিনির্ধারক স্তরের কোনো নেতা ভারত সফরে আসেন, তখনই তাঁরা ভারতের রাজনীতি, দেশটির বাসিন্দাদের বৈচিত্র্য ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশংসাসূচক কথা বলেন। এযাবৎ যত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারত সফরে এসেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ‘বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র’ এবং ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ এর মধ্যে মূল্যবোধগত ঐক্যের কথা বলেছেন। এই কথাগুলোকে স্রেফ কথার কথা মনে হতে পারে। কিন্তু ওয়াশিংটনের কাছে আসলেই এ কথাগুলো ফাঁপা বাগাড়ম্বর ছিল না। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধই টেকসই সম্পর্কের সত্যিকার ভিত্তি হতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন ভারতীয় নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে লেখা একটি চিঠিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র ও ন্যায়পরায়ণতার প্রতি আমাদের অভিন্ন আগ্রহ আপনার দেশবাসী ও আমার দেশবাসীকে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম করবে। ’শীতল যুদ্ধের সময় মার্কিন প্রশাসন দিল্লিকে এই যুক্তিতে মস্কোর বিরোধিতা করতে আহ্বান জানাত যে একটি গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে ভারত স্বাভাবিকভাবেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু। ২০০৫ সালে ভারতের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করার সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছিলেন, ভারতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত অভিন্ন মূল্যবোধের বন্ধুত্বপূর্ণ সুতায় বাঁধা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ভারত সম্পর্কে এত ইতিবাচক কথা বলা হলেও ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার হতাশ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রিটিশ শক্তি জাপান ও নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে যে লড়াই চালাচ্ছিল, সে বিষয়ে অতি আগ্রহ না দেখিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে গান্ধী রুজভেল্টকে হতাশ করেছিলেন। শীতল যুদ্ধের সময় দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে জোট গঠনে শুধু অস্বীকৃতিই জানায়নি, উল্টো মস্কোর সঙ্গে গাঁটছড়াও বেঁধেছিল। এমনকি শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা শুরু করলেও তখনো ক্রেমলিনের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক ধরে রেখেছিল। এ ছাড়া দিল্লি ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সর্বশেষ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রকে হতাশ করে দিল্লি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে নিন্দা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। মোদি দুই দেশের ‘উষ্ণ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব’ আরও জোরালো করতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যখন আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ নেবেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য গণতন্ত্রবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ ভেসে বেড়াচ্ছেফাইল ছবি: এএফপি nগণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি ধরার বিষয়টি সব সময়ই সন্দেহযুক্ত ছিল। কিন্তু এখন আর তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কারণ, অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়টিই এখন বাস্তবতা থেকে দূরে। কারণ, ৯ বছর আগে নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারতের গণতান্ত্রিক মর্যাদা উত্তরোত্তরভাবে সন্দেহের মেঘে আচ্ছন্ন হয়েছে।
‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের’ দেশে প্রায়ই শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উসকানিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। এই গণতন্ত্রের দেশটি লাখো-কোটি মুসলমান বাসিন্দার নাগরিকত্ব বাতিল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই দেশটি এখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করছে এবং বিরোধী কণ্ঠস্বরকে চেপে ধরছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রচারে সরব থাকা বাইডেন প্রশাসন এ কারণেই অভিন্ন মূল্যবোধের বিচারে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারি টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে এখনো ওয়াশিংটন তার পক্ষ থেকে এই সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত জানুয়ারিতে ওয়াশিংটন ঘোষণা করেছিল, দুই দেশের যৌথ প্রযুক্তি উদ্যোগে ‘আমাদের অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি আমাদের অভিন্ন মর্যাদা প্রদর্শন’ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। জুনে (২১ জুন) মোদি দুই দেশের ‘উষ্ণ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব’ আরও জোরালো করতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যখন আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ নেবেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য গণতন্ত্রবিরোধী তৎপরতার অভিযোগ ভেসে বেড়াচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে মোদি সরকার ভারতের একটি নেতৃস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থ সংগ্রহ কার্যক্রমকে কঠিন করে তুলেছিল, যেটিকে বুদ্ধিজীবীদের ওপর সরকারের আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তার পরের মাসেই অর্থাৎ মার্চে ভারতের সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের নেতা রাহুল গান্ধী মোদির সমালোচনা করার পর পার্লামেন্ট থেকে সদস্যপদ হারান। এরপরও দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত—এই দুই দেশের অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যত দুর্বল হয়েছে, ততই পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক জোরালো হয়েছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বুঝতে পারছে, তাদের অভিন্ন ভূরাজনৈতিক শত্রু হলো চীন। চীনকে ঠেকাতে হলে ভারতের যেমন যুক্তরাষ্ট্রকে দরকার, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেরও ভারতকে দরকার। চীনকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের মূল্য অনেক। কারণ, এশিয়ায় ভারত একটি বৃহৎ শক্তি। ভারতের জলসীমায় গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ রয়েছে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে চীনের একটি বিস্তৃত স্থলসীমান্ত রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, শিক্ষা ও বিনিয়োগের একটি বিশাল উৎস। মস্কোর সঙ্গে দিল্লির এখনো হয়তো ভালো সম্পর্ক আছে। কিন্তু রাশিয়ার অস্ত্রের গুণমানহীনতা ও তা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তার মানে হলো, ভারত অস্ত্র কেনার বিষয়ে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি পশ্চিমাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আছে। এই পারস্পরিক পরিপূরক বস্তুগত স্বার্থকে কাজে লাগাতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এই ধারণা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে যে ভারতের সঙ্গে তার জোরালো সম্পর্কের ভিত্তি হবে অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। একই সঙ্গে নয়াদিল্লির গণতান্ত্রিক মূলবোধের পরিপন্থী আচরণকে দীর্ঘ মেয়াদে সহ্য করে যাওয়াকেও ওয়াশিংটনের স্বীকার করে নিতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct