আপনজন ডেস্ক: উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার পুরালা শহর। গত ২৬ মে এক কিশোরীকে অপহরণের চেষ্টার পর তিন সপ্তাহ ধরে শহরে উত্তেজনা বিরাজ করে। গ্রামে বসবাসকারী ৩৫-৪০টি মুসলিম পরিবারের বেশির ভাগকেই শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তাদের দোকানে তালা ঝুলছে। এর পিছনে কাজ করেছে লাভ জিহাদ তত্ত্ব। হিন্দু কিশোরীকে মুসলিম যুবক দ্বারা অপহরণের অভিযোগ ঘিরে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হয়। আর তার কারনে সেখানকার হিন্দু সংগঠনগুলি মুসলিমদের শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। সেই ঘটনা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম নেয়। কিন্তু যে হিন্দু মেয়েকে অপহরণের চেষ্টা ঘিরে এই সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সেই মেয়েটির মামা সন্তোষ (নাম পরিবর্তিত) হিন্দি দৈনিক ভাস্করের সাংবাদিক বৈভব পালিতকরকে অকপট জানিয়েছেন, পুরালার ঘটনা ‘লাভ জিহাদ’ নয়, নেতারা মানুষকে উস্কে দিয়েছে, তাই মুসলমানর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। যে হিন্দু কিশোরী অর্চনা (নাম পরিবর্তিত) কে অটোয় করে অপহরণের অভিযোগ সেই ঘটনায় শুধু মুসলিম উবায়েদ ছিল না, তার সঙ্গে ছিল জিতেন্দ্র সাইনি। আর দুজনই অর্চনার পরিবারের পরিচিত। অর্চনার মামা উবায়েদদের দোকান থেকে ফার্নিচার কিনতেন। সাংবাদিক বৈভব পালিতকর জানিয়েছেন, শুরু থেকেই বিষয়টিকে লাভ জিহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সারা রাজ্য থেকে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ও তাদের নেতারা আসছেন পুরালায়। যদিও তার সঙ্গে কথোপকথনে ‘লাভ জিহাদের’ তত্ত্ব নাকচ করেছেন মেয়েটির মামা। তিনি বলেন, কিছু লোক তাদের নিয়ে রাজনীতি করতে বিষয়টিকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অপহরণের চেষ্টা সংক্রান্ত ঘটনা এত নজর কাড়ল কীভাবে? উত্তর হল, মামলার সঙ্গে ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্ব যুক্ত হয়েছে। অভিযুক্ত দুইজনের একজন উবায়দ খান মুসলিম সম্প্রদায়ের। দ্বিতীয় অভিযুক্তের নাম জিতেন্দ্র সাইনি। উবায়েদের নাম সামনে আসতেই এই মামলাটি ‘লাভ জিহাদ’ নামে পরিচিতি পায়। প্রশ্ন হল এই লাভ জিহাদ তত্ত্ব কোথা থেকে এল? পুরালায় বিবাদের পর বহু মুসলিম পরিবার বাড়ি ছেড়েছে। শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা দেড়শো থেকে দুশোর থেকে মধ্যে। সাংবাদিক বৈভব পালিতকর জানান, আমরা ১৪ বছর বয়সী অর্চনার (নাম পরিবর্তিত) বাড়িতে পৌঁছলাম যার বিরুদ্ধে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্চনার বাড়ি মেইন পুরলা থেকে মাত্র ১ কিমি দূরে। অর্চনার বাবা-মা নেই এবং সে তার মামার বাড়িতে থাকে। মেয়েটির মামা সন্তোষ (নাম পরিবর্তিত) একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাড়িতে পৌঁছানোর আগে আমরা মেয়েটির মামা সন্তোষকে ফোন করি, ‘আমরা মিডিয়া থেকে এসেছি, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই’। উত্তর পেলাম- ‘কারো সঙ্গে দেখা করতে চাই না। ’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন। তার অস্বীকৃতি সত্ত্বেও আমরা ঘটনার সত্যতা জানতে তার বাড়িতে পৌঁছই।
সন্তোষের একেবারে নতুন বাড়ি যেটা এখনও রং করা হয়নি। জানা গেল, এই বাড়িতে মামা সন্তোষের সঙ্গে থাকতেন অর্চনা। বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। সন্তোষের বিষয়ে জানতে চাইলে বাইরে থেকে কুড়ি লাগানো কক্ষ থেকে একটা আওয়াজ এলো, ‘আমি সন্তোষ, মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। যা বলার আমরা আদালতে বলব। আমরা বলেছিলাম যে আমরা শুধু আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি, যাতে আমরা পুরালার ঘটনার সত্যতা জানতে পারি। অনেকক্ষণ নীরবতার পর স্ত্রীকে ডেকে ঘরের দরজা খুলতে বললেন। এর পর বেরিয়ে আসেন সন্তোষ। সন্তোষ জানান, ২৬ মে অর্চনাকে নিয়ে ঘটনার পর অবস্থা এতটাই খারাপ যে বাজারে যেতে পারছি না। দিনে কয়েক ডজন কল আসে। তাই আরেকটি সিম নিয়েছি। আমি ঘরে তালাবদ্ধ থাকি। ‘আসলে কী ঘটেছিল ২৬ মে’? জিজ্ঞেস করতেই অনেক দিন ধরে আটকে থাকা সন্তোষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সন্তোষ বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো ২৬ মে, আমি স্কুলের জন্য বাড়ি থেকে বের হলাম। বিকাল ৩টায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ৩.৭৫ মিনিটে পুরালা মেইন মার্কেটে কর্মরত আশীষ চুনার ফোন করে জানায়, দুটি ছেলে একটি টেম্পোতে বসে আমার ভাগ্নিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সাথে সাথে রওনা দিলাম মূল বাজারের দিকে। ততক্ষণে আশিস আওয়াজ তুলে দুই ছেলে উবায়দ ও জিতেন্দ্র সাইনিকে থামানোর চেষ্টা করলেও দুজনই পালিয়ে যায়। ’সন্তোষ আরো জানান, পুরলা একটা ছোট শহর, আমি আগে থেকেই উবাইদ আর জিতেন্দ্রকে চিনতাম। এর পর সেখানে ভিড় জমে যায়। ভাগ্নি অর্চনাকে নিয়ে সোজা উবায়েদের দোকানে গেলাম। আমরা বললাম উবায়দকে ডাকো। প্রায় এক ঘণ্টা পর উবায়েদ এলো। দোকানের বাইরে ছিল ভিড়। উবায়েদ এলে আমরা জিজ্ঞেস করলাম সত্যি করে বল, ওখানে কি করছিলে? উবায়েদ কিছু না বলে এদিক ওদিক কথা বলতে থাকে। এর পর মামা সন্তোষ থানায় অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং পুলিশ চৌকিতে যান। অর্চনা, মামা সন্তোষ এবং অভিযুক্ত উবায়দ-জিতেন্দ্র উভয়েই পুলিশ পোস্টে উপস্থিত ছিল। সন্তোষ বলেন, ‘আমরা দুজনকেই সত্য বলতে বলেছিলাম, তারা কী করতে যাচ্ছিল। চেয়েছিলাম ভুল স্বীকার করুক এবং সরি বলে বিষয়টি শেষ করুক। তারা করেনি। তখন সন্তোষ তখন পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন।ইতিমধ্যে ভিড় বেড়ে গিয়েছিল। এতে যোগ দেন স্থানীয় কিছু হিন্দুত্ববাদী নেতাও। স্থানীয় লোকজন অভিযোগপত্র দেন। সন্তোষ বলছেন, ‘পুলিশে যে অভিযোগ দিয়েছেন, তাতে মানুষ অনেক বানোয়াট জিনিস যোগ করেছে। ‘লাভ জিহাদের’ কথাও উল্লেখ করেছেন। আমি যখন এই চিঠিটি পড়েছিলাম, আমি এটি ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। ওই চিঠিতে লেখা ছিল, উবায়দ আমার ভাগ্নিকে রাজি করিয়ে একটি বড় ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিল। লাভ জিহাদের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি করার চক্রান্ত করছিল। এরপর আমি নিজেই এসএইচওর কাছে ঘটনার সত্যতা লিখে অভিযোগ জমা দিয়েছি।
পুলিশ গত ২৬ মে সন্ধ্যায় উভয় ছেলেকে আটক করে মামলা দায়ের করে। এরপর সন্তোষ তার ভাগ্নিকে নিয়ে বাড়িতে আসলেও সন্ধ্যা নাগাদ স্থানীয় গণমাধ্যম অপহরণের এই ঘটনাকে লাভ জিহাদের রঙ দেয়। সন্তোষ বলেন, ‘আমি বিষয়টিকে উস্কে দিতে চাইনি। যে কারণে একবারও কোনো বিক্ষোভ বা সমাবেশে অংশ নেননি। সন্তোষের অভিযোগ, পুরালা ব্যবসায়ী সমিতি নিজেদের সুবিধার জন্য বিষয়টিকে রাজনীতিকরণ করেছে এবং এটি নিয়ে রাজনীতি করছে। মেয়েটির মামা সন্তোষ আরও ব্যাখ্যা করেছেন, ‘২৭ মে নাগাদ, মামলার আলোচনা পুরো উত্তরাখণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার মনে হয়েছে, মানুষ এখন তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিষয়টিকে ভুল দিক নির্দেশনা দিচ্ছে। আমি সেদিনই থানায় গিয়ে থানায় জানিয়েছিলাম যে বিষয়টি অনেক বড় হয়ে গেছে। এর এফআইআর কি আটকে রাখা যাবে? থানায় উবায়দ আমার পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইছিল, কিন্তু আমি বললাম এখন আমার হাতে কিছুই নেই। সন্তোষ ২৭ মে থেকে পুরালায় কোনও সমাবেশ, সভা, বিক্ষোভে অংশ নেননি। গত ২৯শে মে পুরালায় ব্যবসায়ী ইউনিয়নের উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এই সমাবেশে মুসলমানদের বাড়ির বাইরে স্লোগান দেওয়া হয় এবং পুরালা ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। মিছিলটি প্রধান বাজারে পৌঁছালে শুরু হয় হট্টগোল। মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকানের বাইরের হোর্ডিং ভেঙে ফেলা হয়। ২৯শে মে এর পর, পুরালা, বারকোট, নোগাঁও, আরাকোট, মোরে কাছাকাছি শহরগুলিতে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ শুরু হয়, কিন্তু মেয়েটির মামা সন্তোষ নিজেকে প্রতিটি বিক্ষোভ থেকে দূরে সরিয়ে নেন। ৪ জুন স্বামী দর্শন ভারতী, একজন হিন্দুত্ববাদী নেতা যিনি দেরাদুন থেকে এসেছিলেন এবং ‘দেবভূমি রক্ষা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন চালান, তিনিও পুরালায় একটি সমাবেশ করেছিলেন। দর্শন ভারতী, জাফরান পরিহিত, স্থানীয় লোকজনের সাথে জড়ো হয় এবং প্রধান বাজারে উস্কানিমূলক স্লোগান দেয়। ৪ জুন রাতেই বাজারের মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকানে পোস্টার সাঁটানো হয়। এই পোস্টারে লেখা ছিল ‘জিহাদি তোমার দোকান খালি কর’। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছি, যেখানে একজন ব্যক্তিকে রাত ৯.০৭ মিনিটে পোস্টার সাঁটাতে দেখা যাচ্ছে। সন্তোষ বলেন, ‘পুরোলার বাইরে থেকে যখন ধর্মীয় নেতারা আসতে শুরু করেন, তখন এই মামলাটিকে সাম্প্রদায়িক করা হয়। অনেক হিন্দুত্ববাদী নেতা আমাকে ফোন করে বলেছেন আমরা আপনার সাথে আছি। আপনিও প্রতিবাদের অংশ হোন, কিন্তু যখন ধর্মের কোনো ইস্যু নেই, তখন আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সন্তোষ আরও বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু মুসলমান। উবায়দ নামের আসামি ছেলে, তার ফার্নিচারের দোকান থেকে মালামাল কিনেছি। আমি শুধু চাই যে সমস্ত মুসলমান যারা পুরালা ছেড়ে চলে গেছে তারা ফিরে আসুক। তার পালানো ভুল হয়েছে। মেয়েটির মামা যা বলেছেন তা নিশ্চিত করতে আমরা পুরালা থানার ইনচার্জ খাজন সিং চৌহানের কাছে পৌঁছেছি। তিনি বলেন, ‘প্রথম অভিযোগ ছেঁড়ার বিষয়টি ঠিক ছিল। তাতে ভুল লেখা ছিল। মেয়ের মামাকে আমি নিজেই কি হয়েছে লিখে অভিযোগ করতে বলেছি।পুরালা থানার ইনচার্জ খাজন সিং চৌহান জানান, ‘প্রথম দিনেই আমরা দুই ছেলের কল ডিটেইল চেক করেছি। তাতে আর্কনাকে নিয়ে মকোন কথা হয়নি। দুজনেই একে অপরকে চিনতেন না, তাই বোঝা যাচ্ছে লাভ জিহাদের মতো মামলা নেই।এ বিষয়ে উত্তরকাশী জেলা বিজেপি সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি জাহিদ মালিক বলেন, পুরোলার মানুষের মধ্যে বড় হয়েছি। এটা আমার কর্মস্থল ছিল, কিন্তু আজ পুরোলার লোকেরা আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দোকানের ব্যানার ছিঁড়েছে যারা প্রতিদিন আমাদের সাথে বসত। তাই এখন পুরোলায় ফেরার ইচ্ছে নেই। পুরালায় চলমান বিরোধের জেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। তার মতো আরও ৩০টি পরিবার পুরালা ছেড়ে চলে গেছে এবং ফিরে আসতে চায় না।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct