অযোগ্য
গোলাম মোস্তাফা মুনু
হেলাল বাজার থেকে বড় মাছ কিনে আনে। বাড়ি প্রবেশ করার মুহূর্তে ছোটছেলে রুবেল বলে ওঠে, ‘বাবা? আজকে আমিও বড় মাছ দিয়ে ভাত খাবো।’ বলে সে বাবার পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে। হেলাল থেমে গিয়ে ছেলেকে বোঝায়, ‘রুবেল, রান্না হয়ে গেলে তোকে ডেকে নেবো। তুই আর বাড়ির মধ্যে যাস না। বাইরে খেলাধুলা কর্।’ রুবেল বড় মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার আশ্বাস পেয়ে খুব খুশি হয়। বাড়ির বাইরে আবার মন দিয়ে খেলাধুলা শুরু করে।হেলালের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কিছু জমি জায়গা আছে। জমিতে মন দিয়ে খাটলে সংসারে অভাব হতো না। কিন্তু সে বছরে একবারও জমি দেখতে যায় না। নেশাতে ডুবে থাকে। সপ্তাহে একদিন দুদিন কাজে যায়। যত টাকা রোজগার হয়, সব টাকা তার নেশার পেছনে খরচ হয়ে যায়।হেলালের দুই বিয়ে। দুই স্ত্রীর আলাদা আলাদা বাড়ি রয়েছে। কাঁচা বাড়ি। প্রায় এক বছর পূর্বে বড় স্ত্রী দুটি ছেলে রেখে মারা গেছে। বড় ছেলের বয়স দশ বছর আর রুবেলের ছয়। মায়ের মৃত্যুর দিন থেকেই রুবেল ও তার বড়ভাই খাবার খায় হেলালের চাচাতো ভাইয়ের বাড়ি। বড়ভাই চাচার বাড়ি সাধ্যমত কাজকাম করে দেয়। চাচা তাকে কাজ করতে বাধ্য করে না। সে খুব ভালো মানুষ। খেটে খাওয়া মানুষ। রুবেল বাড়ির বাইরে গিয়ে বেশিক্ষণ খেলাধুলা করে না। সে সারা সারাদিন খেলে। দীর্ঘক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকে না। কিছুক্ষণ খেলে নিয়ে আবার বাড়ি আসে। কিন্তু আজ প্রায় দু’ঘণ্টা থেকে সে বাড়ি ফেরেনি। বড়ভাই তাকে খুঁজতে বের হয়। বাইরে বেরিয়ে দেখে, ছোটমায়ের বাড়ির দরজার সামনের দিকে একটা ইটের ওপর বসে আছে রুবেল। বড়ভাই রুবেলের কাছে গিয়ে বলে, ‘কী হয়েছে রুবেল? তুই আজ অনেকক্ষণ বাড়ি যাসনি। এখানে বসে কী করছিস?’
রুবেল মনে মনে বলে, ‘দাদাকে বড় মাছের কথা বলবো না। আমাকে বকা দেবে।’ সে নীরব থাকে। রুবেলের নীরবতার কারণ জিজ্ঞাসা না করে বড়ভাই আবার বলতে শুরু করে, ‘চল্ ভাই, দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে, খেতে চল্।’ সেই ইটের উপর বসেই রুবেল বলে, ‘তুই যা দাদা। তুই খেয়ে নে, যা। আমি একটু পরে আসছি।’ ‘আর বেশি দেরী করিস না, তাড়াতাড়ি আসিস।’ বলে বড়ভাই সেখান থেকে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এমন মুহূর্তে বাবা হেলাল বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। রুবেল বিদ্যুৎগতিতে বাবার কাছে ছুটে গিয়ে বলে, ‘বাবা, মাছ রান্না করতে এত দেরী হল কেন? চলো, ভিতরে চলো।’হেলাল রুবেলের কথার জবাব খুঁজে পায় না। নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। সে খাবার সময় রুবেলের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিল। বাড়িতে তিনজন অতিথি ছিল। তাদেরকে নিয়েই সে ব্যস্ত ছিল। মাছ খাইয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সে রুবেলকে কী বলবে ভেবে পায় না। রুবেল পুনরায় বলে ওঠে, ‘বাবা, ভিতরে চলো। বড় মাছ খাবো।’ রুবেলের বড়ভাই খানিক দূর থেকে সবই শুনছিল এবং দেখছিল। বাবাকে বড় মাছ কিনে আনতে সেও দেখেছিল। ছোটমায়ের দরজার সামনের দিকে রুবেলের বসে থাকার কারণ এবার বড়ভাই পরিষ্কার বুঝে যায়। এখন বাবার নীরবতার কারণও সে বুঝে যায়। আর দেরী না করে সে ছুটে আসে রুবেলের কাছে। সে রুবেলকে কোলে তুলে নিয়ে বোঝায়, ‘ছোটমা বাবাকে বকা দেবে। ভেতরে যাস না। চল্ ভাই, চাচার বাড়ি যা রান্না হয়েছে তা-ই খাবো।’ রুবেল বড় মাছের বায়না ধরে কাঁদতে শুরু করে। বড়ভাই সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘কাঁদিস না ভাই, চাচাকে কালকে বড় মাছ কিনতে বলবো। চল্ , এখন বাড়ি চল্।’ এ বলে সে রুবেলকে কোলে নিয়েই চাচার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। আর হেলাল নিজেকে অযোগ্য মনে করে অধোমুখে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct